সূরা সাবা: আয়াত ১৪-১৭ (পর্ব-৪)
কুরআনের আলো অনুষ্ঠানের আজকের পর্বে সূরা সাবার ১৪ থেকে ১৭ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা শুরু হবে। এই সূরার ১৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
فَلَمَّا قَضَيْنَا عَلَيْهِ الْمَوْتَ مَا دَلَّهُمْ عَلَى مَوْتِهِ إِلَّا دَابَّةُ الْأَرْضِ تَأْكُلُ مِنْسَأَتَهُ فَلَمَّا خَرَّ تَبَيَّنَتِ الْجِنُّ أَنْ لَوْ كَانُوا يَعْلَمُونَ الْغَيْبَ مَا لَبِثُوا فِي الْعَذَابِ الْمُهِينِ (14)
“অতঃপর যখন আমি সুলায়মানের মৃত্যু ঘটালাম, তখন একমাত্র ঘুণ পোকাই জিনদেরকে তাঁর মৃত্যু সম্পর্কে অবহিত করল। (এগুলো) সুলায়মানের লাঠি খেয়ে যাচ্ছিল। যখন সুলায়মানের (দেহ) মাটিতে পড়ে গেল, তখন জিনেরা বুঝতে পারল যে, অদৃশ্য বিষয়ের জ্ঞান থাকলে তারা এই লাঞ্ছনাপূর্ণ শাস্তিতে আবদ্ধ থাকতো না।” (৩৪:১৪)
আগের আসরে আমরা হযরত সুলায়মান (আ.)-এর প্রতি মহান আল্লাহর তিনটি অনুগ্রহের কথা বর্ণনা করেছিলাম। আজকের এই আয়াতে বলা হচ্ছে: হযরত সুলায়মানকে বিশাল সাম্রাজ্য ও শান-শওকত দেয়া সত্ত্বেও আল্লাহর নির্ধারিত সময় অনুযায়ী তাঁর মৃত্যু হয়ে যায়। লাঠিতে ভর করে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় মৃত্যুর ফেরেশতা তাঁর জান কবজ করে নিয়ে যান। মৃত্যুর পরও তাঁর দেহ লাঠিতে ভর করে দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু ঘুণ পোকা লাঠির অগ্রভাগ খেয়ে ফেললে তাঁর দেহ মাটিতে পড়ে যায়। একমাত্র তখনই মানুষ হযরত সুলায়মানের মৃত্যুর কথা জানতে পারে। সাধারণ শ্রমিকদের পাশাপাশি আল্লাহর নির্দেশে কর্মরত জিনেরাও এতদিন জানতে পারেনি হযরত সুলায়মান মারা গেছেন। তাঁর দেহ মাটিতে পড়ে যাওয়ার পরই তারা বিষয়টি উপলব্ধি করে। কিন্তু তারা যদি আগেই বিষয়টি জানতে পারত তাহলে যে কষ্টসাধ্য ও ভারী কাজে তাদের নিয়োজিত করা হয়েছিল তা ছেড়ে তারা চলে যেত।
হযরত আলী (আ.) এ সম্পর্কে নাহজুল বালাগার ১৮২ নম্বর খুতবায় বলেছেন: যদি কারো পক্ষে মৃত্যুকে ফাঁকি দিয়ে পৃথিবীতে চিরদিন বেঁচে থাকা সম্ভব হতো তাহলে তিনি হতে পারতেন হযরত সুলায়মান (আ.)। আল্লাহ তায়ালা জিন ও মানুষকে তাঁর আজ্ঞাবহ করে দিয়েছিলেন, তিনি বিশাল সাম্রাজ্যের অধিকারী ছিলেন, নবুওয়াতের মর্যাদা লাভ করেছিলেন এবং আল্লাহ তায়ালার দরবারেও তাঁর অনেক উচ্চ মর্যাদা ছিল। কিন্তু এতকিছু সত্ত্বেও মহান আল্লাহ মৃত্যুর অবধারিত নিয়মের ব্যতিক্রম কারো জন্য রাখেননি।
এ আয়াতের একটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:
১. মানুষ যদি নবুওয়াত ও সাম্রাজ্য দু’টিরই মালিক হয়ে যায় তারপরও তাকে মৃত্যুর অমীয় সুধা পান করতেই হবে। কাজেই আমরা যেন ধন-সম্পদ বা পদমর্যাদার কারণে অহংকারী হয়ে না যাই। সারাক্ষণ যেন আমাদের মৃত্যুর কথা স্মরণে থাকে।
এবারে এই সূরার ১৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
لَقَدْ كَانَ لِسَبَإٍ فِي مَسْكَنِهِمْ آَيَةٌ جَنَّتَانِ عَنْ يَمِينٍ وَشِمَالٍ كُلُوا مِنْ رِزْقِ رَبِّكُمْ وَاشْكُرُوا لَهُ بَلْدَةٌ طَيِّبَةٌ وَرَبٌّ غَفُورٌ (15)
“সাবার অধিবাসীদের জন্যে তাদের আবাসভূমিতে ছিল (আল্লাহর ক্ষমতা ও অনুগ্রহের) এক নিদর্শন। দুটি উদ্যান, একটি ডানদিকে এবং একটি বামদিকে। তোমরা তোমাদের পালনকর্তার রিযিক খাও এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। স্বাস্থ্যকর শহর এবং ক্ষমাশীল পালনকর্তা।” (৩৪:১৫)
গত আসরে আমরা আল্লাহর দু’জন নবী অর্থাৎ হযরত দাউদ ও হযরত সুলায়মানের কথা উল্লেখ করেছিলাম যাদেরকে পার্থিব জীবনের বিশাল সম্পদ ও ক্ষমতার অধিকারী করা সত্ত্বেও তারা ছিলেন আল্লাহর কৃতজ্ঞ বান্দা। তারা তাদের ক্ষমতা ও সম্পদ মানবকল্যাণে নিয়োজিত করেছিলেন। আর এই আয়াত এবং এর পরবর্তী আয়াতগুলোতে সাবা জাতির ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। এই জাতিকে আল্লাহ তায়ালা পার্থিব জীবনে অসংখ্য নিয়ামতে পরিপূর্ণ করে রাখলেও তারা আল্লাহ তায়ালার অবাধ্য হয়ে কৃতকর্মের শাস্তি লাভ করেছিল।
ইয়েমেনের অনুকূল আবহাওয়াসমৃদ্ধ একটি সুন্দর এলাকায় সাবা জাতি বাস করত। তারা পাহাড়ে বাঁধ নির্মাণ করে নিজেদের সারা বছরের পানির চাহিদা মেটাত। কৃষিকাজ ও পশুপালনে তারা ছিল সমৃদ্ধ জাতি এবং তাদের ছিল একটি সুখী ও সমৃদ্ধ দেশ।
পাহাড় থেকে নেমে আসা নদী এই দেশের ভেতর দিয়ে চলে গিয়েছিল এবং নদীর দুই তীরে ছিল নানা ফুল ও ফলের বাগান। তাদের ছিল উর্বর কৃষিজমি। এক কথায় ধন-দৌলতে কোনো কমতি ছিল না সাবা জাতির।
এ আয়াতের দু’টি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:
১. প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, গাছ-গাছালি, ফল-মূল এ সব কিছুই আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টি এবং তাঁর ক্ষমতা ও অনুগ্রহের নিদর্শন।
২. কৃষিকাজের মাধ্যমে ফসল ফলানো আল্লাহর অনুগ্রহ লাভের মাধ্যম এবং এ বিষয়টি পারলৌকিক জীবনে বিশ্বাস এবং তার জন্য প্রস্তুতি নেয়ার সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়।
সূরা সাবার ১৬ ও ১৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
فَأَعْرَضُوا فَأَرْسَلْنَا عَلَيْهِمْ سَيْلَ الْعَرِمِ وَبَدَّلْنَاهُمْ بِجَنَّتَيْهِمْ جَنَّتَيْنِ ذَوَاتَيْ أُكُلٍ خَمْطٍ وَأَثْلٍ وَشَيْءٍ مِنْ سِدْرٍ قَلِيلٍ (16) ذَلِكَ جَزَيْنَاهُمْ بِمَا كَفَرُوا وَهَلْ نُجَازِي إِلَّا الْكَفُورَ (17)
“কিন্তু তারা (আল্লাহর কাছ থেকে) মুখ ফিরিয়ে নিল। ফলে আমি তাদের উপর প্রেরণ করলাম প্রলয়ংকর বন্যা। আর (ফলমূলে ভরা) তাদের দুটি উদ্যানকে পরিবর্তন করে দিলাম এমন দুই উদ্যানে, যাতে উদগত হয় বিস্বাদ ফলমূল, ঝাউ গাছ এবং দারূবৃক্ষ।” (৩৪:১৬)
“এটা ছিল কুফরের কারণে তাদের প্রতি আমার শাস্তি। আমি কি কাফের (ও অকৃতজ্ঞ) ব্যতীত কাউকে শাস্তি দেই?” (৩৪:১৭)
আল্লাহর নেয়ামত হাতে পেলে মানুষ দুই ধরনের আচরণ করে। একদল আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে এবং অন্যদল অকৃতজ্ঞ হয়। প্রথম দল নেয়ামত হাতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে, এটা আল্লাহই আমাকে দিয়েছেন। এরপর সে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের কাজে সেই নেয়ামত ব্যবহার করে। দ্বিতীয় দল আল্লাহ সম্পর্কে পুরোপুরি উদাসিন। তারা নেয়ামত হাতে পাওয়ার পর নিজের জৈবিক চাহিদা পূরণের নেশায় লিপ্ত হয়; যদি সেটা আল্লাহর নিষিদ্ধ পথেও হয় তাতেও তার কোনো ভ্রুক্ষেপ থাকে না। সাবা জাতি আল্লাহর নেয়ামতের মধ্যে ডুবে থাকা অবস্থায় এক স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর পরিবর্তে তাদের খেয়ালখুশি মতো চলা শুরু করেছিল এবং কিয়ামতকে পুরোপুরি ভুলে গিয়েছিল।
এই অকৃতজ্ঞতার কারণে প্রবল বন্যায় এই জাতির ঘরবাড়ি, ফল ও শস্যের বাগান পানিতে তলিয়ে যায়। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর মাটি তার উর্বরতা হারায় এবং গাছে ফল উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। যদিও বা কোনো কোনো গাছে কিছু ফল উৎপাদিত হতো তা ছিল এতটা বিস্বাদের যে তা মুখে দেয়া মানুষের পক্ষে সম্ভব ছিল না।
এই দুই আয়াতের শিক্ষাণীয় দিকগুলো হলো:
১. কথা কিংবা কাজে আল্লাহর নেয়ামতের অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলে দুনিয়াতেই তার কিছু শাস্তি পেতে হয়।
২. প্রতিটি জাতির ভাগ্য ওই জাতির হাতেই রয়েছে। তারা যে আচরণ করবে ঠিক অনুরূপ ফল পাবে। এ ছাড়া, অতীত জাতিগুলোর ইতিহাসে ভবিষ্যত জাতিগুলোর জন্য রয়েছে শিক্ষা।
৩. গোনাহর কাছে লিপ্ত থেকে তার উপর অটল থাকলে আল্লাহর শাস্তি পাওয়ার ক্ষেত্র তৈরি হয়ে যায়। কিন্তু বান্দা যদি গোনার কাজ থেকে সরে আসে তাহলে আল্লাহ তার প্রতি দয়াপরবশ হয়ে তাকে ক্ষমা করে দেন। #