ইরানে দুনিয়া-কাঁপানো ইসলামী বিপ্লবের গৌরবময় ৪০ বছর (পর্ব-৭)
ইরানের ইসলামী বিপ্লব হাজার বছরের এক মহাবিস্ময়। এর অন্য যে কোনো সাফল্য বাদ দিলেও কেবল ৪০ বছর ধরে টিকে থাকাই এক মহাবিস্ময়।
সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর পক্ষ থেকে প্রবল ও অবিরাম শত্রুতা, আগ্রাসন, নিষেধাজ্ঞা ও সন্ত্রাসের শিকার হওয়া সত্ত্বেও এ বিপ্লবের টিকে থাকাটা এক অনন্য সাফল্য। ইরানের ইসলামী বিপ্লব প্রকাশ্য শত্রু ছাড়াও ভেতর ও বাইরের মুনাফিক শক্তিগুলোর পক্ষ থেকেও অনেক বড় বড় আঘাত ও শত্রুতার শিকার হয়েছে।খোদাভীরু নেতৃবৃন্দ ও জনগণের ত্যাগ-তিতিক্ষার সুফল হিসেবেই ইরানে টিকে রয়েছে ইসলামী সরকার-ব্যবস্থা যা সত্যিই মুসলিম বিশ্ব ও ইরানিদের জন্য বড় ধরনের গর্বের বিষয়। বলতে গেলে প্রায় গোটা বিরূপ বিশ্ব, অবিচারপূর্ণ বিশ্ব-ব্যবস্থা ও দাম্ভিক শক্তিগুলোর অশেষ বাধা ও শত্রুতা মোকাবেলা করে ইরানি জাতি তার স্বাধীনতা বজায় রেখেছে প্রকৃত অর্থেই।
পরাশক্তিগুলোর দুই প্রধান শিবিরের যে কোনো একটিতে যোগ দেয়া ও ইহুদিবাদী ইসরাইলের সঙ্গে বন্ধুত্ব বা আপোষ করা যখন ছিল বিশ্ব-রাজনীতির স্বাভাবিক রীতি তখন এইসব শক্তিকে উপেক্ষার ও প্রতিরোধের এক নতুন ধারা তথা স্বাধীন ইসলামী বিপ্লবী ধারার সুচনা করে ইমাম খোমেনীর নেতৃত্বাধীন ইরান। পরাশক্তিগুলোর কাছে নতজানু না হয়ে ও ইসলামী মূল্যবোধ ধরে রেখে সত্য আর ন্যায়বিচারের দাবিতে অবিচল থাকতে গিয়ে ইসলামী ইরানকে স্বাভাবিকভাবেই ব্যাপক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞার পর নিষেধাজ্ঞা ও কঠোর হতে থাকা নানা অবরোধের মধ্যেও ইসলামী বিপ্লবী ইরান উন্নয়নের অনেক মৌলিক ক্ষেত্রে দুনিয়াকে তাক লাগিয়ে দেয়ার মত বহু সাফল্য অর্জন করেছে। যেমন, অতি সম্প্রতিও ইরান মহাশূন্যে পাঠিয়েছে নিজস্ব প্রযুক্তির দু'টি কৃত্রিম উপগ্রহ। ইরানের দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র এবং ক্রুজ ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলো এখন লক্ষ্যবস্তুর মাত্র কয়েক মিটারের মধ্যেই নিখুঁত আঘাত হানতে সক্ষম। বিজ্ঞান-গবেষণায় ইসলামী ইরান এখন বিশ্বের শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকটি দেশের অন্যতম।

ভূকৌশলগত ক্ষেত্রে ইসলামী বিপ্লবী ইরান এখন পশ্চিম এশিয়ার সবচেয়ে বড় শক্তি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী পর্যায়ে এশিয়া ও আফ্রিকার উপনিবেশ-কবলিত দেশগুলো স্বাধীনতা অর্জন করলেও তা নামমাত্র স্বাধীনতাই থেকে গেছে। অর্থ সাহায্য বা ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে সরকারগুলো হয় সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বাধীন সমাজবাদী ব্লকে অথবা মার্কিন নেতৃত্বাধীন পুঁজিবাদী ব্লকে যোগ দিত। এ দুই মহাজোট ছিল যেন দুই বিশাল কারাগার যা থেকে মুক্ত হওয়া ছিল বাস্তবে অসম্ভব। দেশগুলো ছিল যেন দুই পরাশক্তির যে কোনো একটির ক্ষুদ্র জেলা বা প্রদেশ। কথিত জোট-নিরপেক্ষ আন্দোলন নামের একটি আন্দোলন থাকলেও তা ছিল প্রায় নাম-সর্বস্ব!
ইরানে যখন ইসলামী বিপ্লবের উত্তাল আন্দোলন শুরু হয় তখনও দেশটি ছিল পুরোপুরি মার্কিন কর্তৃত্বাধীন। এর প্রায় এক বছর আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার তার সরকারের সেবাদাস শাহের স্বৈরশাসনের প্রশংসা করে বলেছিলেন ইরান হচ্ছে অশান্ত মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ও স্থিতিশীলতার এক দ্বীপ! ইরানের রন্ধ্রে রন্ধ্রে তখন চলছিল মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ'র কর্তৃত্ব। নৃশংস নির্যাতনের জন্য কুখ্যত শাহের গোয়েন্দা সংস্থা স'ভাক জনগণের ওপর এত ব্যাপক নজরদারি করত যে তারা সে সময় ঘনিষ্ঠ আত্মীয়কেও সন্দেহ করত! প্রায় অর্ধ লক্ষ ইরানি সভাকের হাতে বন্দি বা নৃশংস নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ইসলামী জাগরণের জন্য কাজ করতে গিয়ে প্রায় এক লাখ ইরানি সরকারের নৃশংস দমন-নীতির শিকার হয়ে শহীদ হয়েছিলেন। শ্বাসরুদ্ধকর ও নৃশংস নির্যাতনের এমন পরিবেশে ইসলামী বিপ্লব সফল হবে এমনটা ছিল অবিশ্বাস্য! ইমাম খোমেনীর নেতৃত্বাধীন এই ইসলামী গণজাগরণের চালিকাশক্তি ছিল খাঁটি ইসলামী আদর্শ এবং তাতে পশ্চিমা মতাদর্শের কোনো দূষণ বা মিশ্রণ ছিল না। অথচ কথিত স্বাধীন মুসলিম দেশগুলোর উচ্চ-শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যে এ ভাবনা জোরদার হয়েছিল যে পরাশক্তিগুলোর ওপর নির্ভর না করে তাদের রাষ্ট্র টিকতে পারে না!
পরাশক্তির ওপর নির্ভরতা ছাড়া আধুনিক যুগে স্বাধীনভাবে কোনো মুসলিম ও ইসলামী রাষ্ট্রের টিকে থাকা অসম্ভব এই ধারণাকে অসার বলে প্রমাণ করেন মহান সংস্কারক ইমাম খোমেনী (র)। এ ছাড়াও সেরা ইসলামী আইনবিদের নেতৃত্বে ইসলামী সরকার গড়ে তোলার গুরুত্বও কাগজে-কলমে ও বাস্তবে প্রমাণ করতে সক্ষম হন। তার ক্যারিজমাটিক নেতৃত্ব ও ব্যক্তিত্ব, দূরদৃষ্টি এবং জাতিকে পরিচালনার যোগ্যতার কারণে শিশু ও নারীসহ প্রায় এক লাখ ইরানিকে হত্যা করেও মার্কিন ও ইসরাইলি মদদপুষ্ট শাহের সশস্ত্র বাহিনী দেশটিতে ইসলামী বিপ্লবের অবিচল ও উত্তাল গণজোয়ারকে স্তব্ধ করতে ব্যর্থ হয়। এভাবে আধুনিক বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় এক স্বৈরশাসনতন্ত্রের অবসান ঘটে। জনগণের সম্মিলিত ইচ্ছার অপ্রতিরোধ্য শক্তি, সব ধরনের হীন স্বার্থ-চিন্তার দুষণ-মুক্ত খাঁটি ইসলামী নেতৃত্ব, দেশের সর্বত্র আমূল পরিবর্তন আনার মত সংগ্রামী চেতনা এবং বাইরের বিশ্বকে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে মোকাবেলা করার মত আত্মবিশ্বাস ও যোগ্যতা ছিল এই বিপ্লবের অবিশ্বাস্য নানা সাফল্য অর্জনের কিছু চালিকাশক্তি।#
পার্সটুডে/এমএএইচ/মো.আবুসাঈদ/ ৮