সুরা মুজাম্মিলের প্রাথমিক পরিচিতি ও কয়েকটি আয়াতের ব্যাখ্যা
সুরা মুজাম্মিল পবিত্র কুরআনের ৭৩ তম সুরা। মক্কায় নাজিল হওয়া এ সুরায় ২০ আয়াত ও দু'টি রুকু রয়েছে। মুজাম্মিল শব্দের অর্থ বস্ত্রাবৃত বা চাদরে আবৃত ব্যক্তি। এ সুরায় মুজাম্মিল বলতে মহানবী (সা)-কে বোঝানো হয়েছে।
ইসলামী বর্ণনায় এসেছে যখন বিশ্বনবী যখন প্রকাশ্যে ইসলামের দাওয়াত দেয়া শুরু করেন তখন কুরাইশরা দারুন্নাদওয়া নামে খ্যাত পরামর্শ-সভা কেন্দ্রে সমবেত হয়ে এই দাওয়াত প্রতিরোধের উপায় নিয়ে ফন্দি আঁটতে লাগল। অবিশ্বাসী কুরাইশদের কেউ কেউ বলল,মুহাম্মাদকে গণক বলে প্রচার করব! অন্য একদল এই ফন্দির বিরোধিতা করে বলল,না,তাঁকে পাগল বলে প্রচার করতে হবে! অনেকে বলল, না,এটাও ঠিক হবে না;মুহাম্মাদকে জাদুকর বলে প্রচার করাটাই হবে তার দাওয়াত প্রতিরোধের জন্য বেশি কার্যকর!। সমবেত কুরাইশরা এই শেষোক্ত প্রস্তাব মেনে নেয়। তারা বৈঠক শেষ করল এই বলে যে,বন্ধুরা! মুহাম্মাদ যা-ই হোক না কেন সে আমাদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করছে। অন্য কথায় মুহাম্মাদ আমাদের বন্ধুদের মধ্যে সৃষ্টি করছে বিচ্ছেদ ও বন্ধুদেরকে কেড়ে নিচ্ছে আমাদের একে-অপরের কাছ থেকে।
মহানবী (সা) কুরাইশদের এসব কথা অবগত হওয়ার পর ইসলাম প্রচারের গুরু-দায়িত্বের অত্যন্ত ভারী বোঝা ও ব্যাপক বাধা-বিপত্তির কথা ভেবে একটি আলখাল্লা বা লম্বা-ওভারকোট জাতীয় জামা গায়ে দিয়ে বিশ্রামে রত হলেন। আর এ সময় ওহির ফেরেশতা হযরত জিবরাইল (আ) আসেন এবং তিনি বিশ্বনবীকে(সা) সুরা মুজাম্মিল পড়ে শোনান।

এ সুরার প্রথম অংশে মহানবীকে (সা) রাতজেগে ইবাদত করার ও বিশেষ করে কুরআন তিলাওয়াতের আহ্বান জানানো হয়েছে যাতে তিনি ইবাদতের এক বড় কর্মসূচি পালনের জন্য প্রস্তুত হতে পারেন। এরপর সুরা মুজাম্মিলে বিশ্বনবীকে (সা) ধৈর্যের আহ্বান জানানো হয়েছে এবং ইসলামের দাওয়াত প্রচারের এই প্রাথমিক পর্যায়ে বিরোধিদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব-বিরোধ সুন্দরভাবে বা কৌশলে এড়িয়ে চলার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
এরপর সুরা মুজাম্মিলে পরকাল সম্পর্কে,খোদাদ্রোহী ফেরাউন ও তার দলবলের কাছে হযরত মুসাকে পাঠানোর বিষয়ে এবং ফেরউনকে শাস্তি দেয়া ও নৈশ-ইবাদত প্রসঙ্গে বক্তব্য এসেছে। নৈশ-ইবাদত প্রসঙ্গে রাত-জেগে কুরআন তিলাওয়াত করা ও নামাজ পড়া,জাকাত দেয়ার বিষয়ে এবং সামগ্রিকভাবে আল্লাহর রাস্তায় দান-খয়রাত করা ও তওবা সম্পর্কিত বক্তব্য পর্যায়ক্রমে এসেছে এই সুরায়। (তাবাশি)
সুরা মুজাম্মিলের প্রথমে মহানবীর (সা) দাওয়াতকে অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী সুরে তুলে ধরা হয়েছে। সুরটা এমন যেন মানবজাতির দিকে ধেয়ে আসছে ধ্বংসাত্মক জলচ্ছ্বাস বা সুনামি। আর এমন অবস্থায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কিশতি বা নৌকাগুলো যেন সন্ধান করছে নিরাপদ আশ্রয়। আর এ অবস্থায় উথাল-পাতাল সাগরের আকাশচুম্বি ঢেউয়ের আঘাতে ডুবে পড়ার বিপদ থেকে মানবজাতিকে রক্ষা করতে পারে কেবল মহানবী (সা) এবং পবিত্র কুরআন নামক তাঁর কিশতি বা জাহাজ। তাই এই কিশতির কাণ্ডারি তথা মহা-ত্রাণকর্তাকে মানবজাতির মুক্তি দেয়ার লক্ষ্যের মত বিশাল গুরু-দায়িত্ব পালনে প্রস্তুত হতে রাত জেগে ইবাদত করতেই হবে।
সুরা মুজাম্মিলের প্রথম চার বাক্যে মহান আল্লাহ বলছেন:
'হে বস্ত্রাবৃত! রাত্রিতে নামাজ বা ইবাদতের জন্য দাঁড়ান কিছু অংশ বাদ দিয়ে; অর্ধরাত্রি অথবা তারচেয়ে কিছু কম; অথবা এরচেয়ে কিছুটা বেশী এবং কোরআন আবৃত্তি করুন চিন্তা-সহকারে,পুরোপুরি নিখুঁত, সুললিত, সুবিন্যস্ত ও স্পষ্টভাবে।
-রাত মানুষের জন্য প্রশান্তির মাধ্যম। প্রাত্যহিক নানা ব্যস্ততা ও চিন্তার প্রভাব থেকে মুক্তি দেয় রাতের বিশ্রাম। মহানবীর দৈনন্দিন কর্মসূচি ছিল প্রচার আর হেদায়াতসহ নানা জরুরি কাজ ও প্রচেষ্টায় ঠাসা। মানুষের সামাজিক ও ব্যক্তিগত নানা সমস্যার সমাধানে তিনি ব্যস্ত থাকতেন বলে দিনের বেলায় তাঁর জন্য ইবাদতের সময় ছিল বেশ সংকীর্ণ বা মনের চাহিদা অনুযায়ী অপর্যাপ্ত। তাই আল্লাহর সর্বশেষ রাসুল ও সর্বশ্রেষ্ঠ খোদাপ্রেমিককে রাতের নীরব ও প্রশান্ত সময়কে বাড়তি ইবাদতের কাজে লাগানোর আহ্বান জানানো হয়েছে। এ সময় ইবাদত করা যায় ভাবনার ছাপ বা ক্লেশমুক্ত মন নিয়ে। রাতের এই ইবাদত কুরআন তিলাওয়াত, মুনাজাত ও নামাজ দিনের বড় বড় ধর্মীয় তৎপরতার জন্য যোগায় বাড়তি অনুপ্রেরণা বা মানসিক শক্তি। কোলাহলমুক্ত পরিবেশে চিন্তা-ভাবনা ও আত্মিক প্রশিক্ষণের জন্য রাতই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ সময়।
রাতের বেলায় কুরআন তিলাওয়াত নৈশ-ইবাদতের অন্যতম বড় দিক। কারণ, কুরআনে রয়েছে আত্মগঠনের সব ধরনের জরুরি শিক্ষা। কুরআন অধ্যয়ন মানুষের ঈমানকে করে শক্তিশালী এবং খোদাভীতির বিকাশ,ধৈর্য-সহিষ্ণুতা বৃদ্ধি ও আত্মিক পরিশুদ্ধির জন্যও কুরআন অধ্যয়নের কোনো বিকল্প নেই।
গাফেল বা উদাসীন লোকদের মত সারা রাত ঘুমিয়ে থাকা খোদাপ্রেমিকদের জন্য শোভনীয় নয়। মধ্যরাত ও ভোররাতের ইবাদত অন্তরকে করে পরিচ্ছন্ন এবং তা খোদাপ্রেম ও এর নানা ভিত্তিকে করে মজবুত। ঈমানকে সজীব ও প্রাণবন্ত করার জন্য কুরআন তিলাওয়াতের যে ব্যাপক গুরুত্ব রয়েছে তা নানা হাদিসে ও ইসলামী বর্ণনায়ও বলা হয়েছে। যেমন,বিশ্বনবীর আহলে বাইতের সদস্য হযরত ইমাম জাফর সাদিক (আ) বলেছেন,তিনটি বিষয় মহান আল্লাহর অন্যতম প্রধান দয়া বা মহা-অনুগ্রহ। এসব হচ্ছে রাত জেগে ইবাদত করা,রোজাদারকে ইফতার দেয়া ও মুসলমান ভাইদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করা।#
পার্সটুডে/আমির হুসাইন/আবু সাঈদ/ ১৭
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।