সুরা মুদ্দাস্সিরের কয়েকটি আয়াতের ব্যাখ্যা
সুরা মুদ্দাস্সিরের ১৮ থেকে ২৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন:
সে কুরআনের সঙ্গে লড়াইয়ের চিন্তা করেছে এবং চক্রান্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ধ্বংস হোক সে,কিরূপে সে এমন সিদ্ধান্ত তথা সত্যের সঙ্গে লড়াই করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে! আবারও,ধ্বংস হোক সে,কিভাবে সে সত্যের সঙ্গে লড়াই করার এমন শয়তানি সিদ্ধান্ত নিল! সে আবার তাকিয়ে দেখল,এরপর ভ্রুকুঞ্চিত করল ও মুখ বিকৃত করল তথা তড়িঘড়ি কাজে নেমে পড়ল। এরপর সে সত্যের দিকে পিঠ ঘুরিয়ে দিল ও অহংকার করল। এবং বলল,‘এ তো এক জাদু ছাড়া অন্য কিছু নয় যা অতীতের জাদুকরদের জাদুর মতই।’ (২৫) এতো কেবল মানুষেরই কথা।
গত পর্বের আলোচনায় আমরা জেনেছি যে, সুরা মুদ্দাস্সিরের ১১ থেকে ৩৬ নম্বর আয়াত বিখ্যাত কুরাইশ নেতা ওয়ালীদ বিন মুগায়রা মাখজুমি সম্পর্কে নাজিল হয়েছে। মহান আল্লাহ তাকে বিপুল নেয়ামত দান করা সত্ত্বেও সে সত্যকে অস্বীকার করেছিল এবং মহানবীকে (সা) জাদুকর ও কুরআনকে জাদু বলে মন্তব্য করেছিল। অথচ পবিত্র কুরআনের আয়াত শুনে সে বলেছিল: ‘আল্লাহর কসম,আমি মুহাম্মাদের মুখে এমন বাণী শুনেছি যা না মানুষের,আর না জিনের। তার ভবিষ্যত খুবই ভাল হবে এবং সে কখনও হবে না পরাভূত।’ তার এ কথা তথা মুখ-ফসকে বের হওয়া সত্য মন্তব্য শুনে কুরাইশ কাফের নেতারা চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল যে ওয়ালিদ কি মুসলমান হয়ে গেলো!? শুধু তাই নয় মহানবীর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রচারণার শ্লোগান তথা অপবাদ কি হবে তা নির্ধারণের জন্য সমবেত একদল কাফির কুরাইশ নেতার প্রস্তাবগুলোকেও ওয়ালিদ একের পর এক অযৌক্তিক বলে উড়িয়ে দিচ্ছিল সেদিন। কাফের কুরাইশ নেতারা একের পর এক প্রস্তাবে বলতে থাকে যে মুহাম্মাদকে (সা) কবি অথবা পাগল কিংবা গণক অথবা মিথ্যাবাদী বলা হবে!।
কিন্তু ওয়ালিদ যুক্তি তুলে ধরে দেখায় মুহাম্মাদের কথাগুলো কবিতার মত নয় বা তার কথাগুলো গণকের বক্তব্যের মতও নয়, তার মধ্যে পাগলামিরও কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি কখনও; আর তার মধ্যে মিথ্যাচারের কোনো আভাসও কখনও দেখা যায়নি ! বরং বিশ্বস্ততা ও সত্যবাদিতার জন্য কুরাইশরা যে মহানবীকে আল-আমিন বলত তাও তারা সেদিন স্বীকার করেছিল। অবশেষে তারা যখন মুহাম্মাদকে জাদুকর বলে প্রচার করার প্রস্তাব দিল তখন ওয়ালিদ তা মেনে নিল। সে প্রশ্ন করেছিল যে কোন্ অর্থে মুহাম্মাদকে জাদুকর বলা যায়? কুরাইশরা বলল, এ অর্থে যে সে আমাদের বন্ধু ও শত্রুদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করছে। ওয়ালিদ কুরাইশদের মন পাবার জন্যই কিছুটা ভেবে বলল: হ্যাঁ!, মুহাম্মাদ জাদুকর! অথচ কিছুক্ষণ আগেই মুহাম্মাদ ও কুরআনের অসাধারণ প্রশংসা করে ওয়ালিদ বলেছিল: ‘আল্লাহর কসম, আমি মুহাম্মাদের মুখে এমন বাণী শুনেছি যা না মানুষের, আর না জিনের। তার ভবিষ্যত খুবই ভাল হবে এবং সে কখনও হবে না পরাভূত।’

কুরআনের বাণী আধ্যাত্মিকতা, দৃঢ়তা ও শক্তিমত্তায় ভরপুর। হৃদয়ের ওপর অনন্য প্রভাব ফেলে কুরআনের প্রতিটি শব্দ ও বাক্য! কুরআনের সঙ্গে জাদুকরদের কাজের কোনো মিলই নেই। ওয়ালীদ বিন মুগায়রা মাখজুমির বক্তব্য থেকেই বোঝা যায় কুরআন যদি মানুষের কথা হত তাহলে অন্যরাও এ ধরনের কথা ও বাক্য রচনা করতে পারত। কুরআনেই বার বার চ্যালেঞ্জ দেয়া হয়েছে কেউ পারলে কুরআনের একটি সুরার মত সুরা রচনা করুক! ইসলামের কঠোর অনেক শত্রু আরবি ভাষায় অসাধারণ দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও কুরআনের সুরার মত কোনো সুরা রচনা করতে কখনও সক্ষম হয়নি এবং কখনও কোনো মানুষ তা পারবে না।
সুরা মুদ্দাস্সিরের তিন আয়াতে শপথ রয়েছে। এ সুরার ৩২ থেকে ৩৪ নম্বর আয়াতে চাঁদ, রাত ও প্রভাতের শপথ নেয়া হয়েছে। এসব প্রাকৃতিক জগতের জ্ঞানগত রহস্যের বিষয় এবং মহান আল্লাহর ক্ষমতা ও একত্ববাদ বা তাওহিদের নিদর্শন। মহান আল্লাহর এসব শপথের মধ্যে এই ইঙ্গিতও রয়েছে যে মানুষের প্রাণ তাদের তৎপরতার ওপর নির্ভরশীল।
সৎ ও পবিত্ররা পরকালে ডান দিকের গ্রুপে থাকবেন এবং খোদাভীতির কারণে তাদের আমলনামা তাদের ডান হাতে দেয়া হবে। তারা ঈমান ও সৎকর্মের মাধ্যমে বন্দিত্বের বাঁধনগুলো খুলে ফেলেন। এই শ্রেণীর মানুষ বিনা হিসাবে বেহেশতে যাবেন।
সুরা মুদ্দাস্সিরে ডান দিকের গ্রুপ তথা বেহেশতি গ্রুপের ও দোযখিদের গ্রুপের অবস্থা সম্পর্কে বলা হয়েছে:
তারা থাকবে জান্নাতে এবং পরস্পরে জিজ্ঞাসাবাদ করবে। অপরাধীদের সম্পর্কে বলবেঃ তোমাদেরকে কিসে জাহান্নামে নীত করেছে?
আর অপরাধীরা এর জবাবে তাদের অপরাধের কথা স্বীকার করবে। তারা প্রথমে বলবে: আমরা নামায পড়তাম না।
জাহান্নামিরা যদি দুনিয়ার জীবনে নামাজ পড়ত তাহলে আল্লাহকে স্মরণ করত এবং অসৎ ও অন্যায় কাজে বাধা দিত। আর নামাজ তাদেরকে আল্লাহর সরল পথের দিকে আহ্বান জানাত।
দোযখবাসীরা দোযখে আসার কারণ সম্পর্কে বেহেশতবাসীদের প্রশ্নের জবাবে আরও বলবে, আমরা অভাবগ্রস্তকে আহার্য্য দিতাম না।
-এখানে দরিদ্র ও অভাবগ্রস্তদের খাবার দেয়ার কথা বলা হলেও তাদের প্রতি যে কোনো ধরনের সাহায্যের বিষয়টিও এর অন্তর্ভুক্ত। যাকাত অন্য মানুষদের অধিকার। তবে এখানে ওয়াজেব যাকাতের কথা বলা হয়েছে। কারণ যেসব দান মুস্তাহাব বা সুন্নাত তা না করার কারণে দোযখে যাওয়ার প্রশ্ন ওঠে না।
দোযখিরা দোযখবাসী হওয়ার কারণ সম্পর্কে বেহেশতিদের প্রশ্নের জবাবে আরও বলবে: (৪৫) এবং আমরা বিভ্রান্তিতে লিপ্তদের সাথে তাল মিলিয়ে অন্যায় কর্মে লিপ্ত থাকতাম। (৪৬) আর আমরা প্রতিফল তথা কর্মফল দিবস অস্বীকার করতাম। (৪৭) এমতবস্থায় নিশ্চিত বিশ্বাসের বিষয় তথা মৃত্যু আমাদের কাছে আসল।’
এ আয়াত থেকে স্পষ্ট নামাজ, যাকাত ও বিভ্রান্তদের সঙ্গী না হওয়া এবং কিয়ামত বা বিচার-দিবসের প্রতি বিশ্বাস মানুষের সুপথ লাভে ও প্রশিক্ষণে অসাধারণ ভূমিকা রাখে। আসলে নামাজ ও যাকাতসহ এই বিষয়গুলো ছাড়া শাফায়াত কোনো কাজে আসবে না। তাই সুরা মুদ্দাস্সিরে ৪৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে: 'ফলে সুপারিশকারীদের সুপারিশ তাদের কোন উপকারে আসবে না।' অন্য কথায় তাদেরকে দোযখেই থাকতে হবে চিরকাল। শাফায়াত হচ্ছে এমন পানির মত যা দুর্বল চারা গাছকে সজীব করে তোলে কিন্তু তা পুরোপুরি শুকিয়ে যাওয়া বা মৃত গাছকে আর বাঁচাতে পারে না। শাফায়াত শর্তহীন নয় কিংবা তা অবাধ পাপাচারের গ্যারান্টিও নয়, বরং তা দুর্বল ছাত্রকে সাহায্য দিয়ে ভাল ছাত্রের কাছাকাছি করার মতই এক ব্যবস্থা। শাফায়াতের জন্য কিছুটা ঈমান ও কিছু ভাল কাজ থাকতে হবে যাতে তার জন্য ক্ষমার ব্যবস্থা করা যায় এবং আল্লাহ ও আল্লাহর আওলিয়ার সঙ্গে তার সম্পর্ক পুরোপুরি ছিন্ন না হয়ে যায়।#
পার্সটুডে/আমির হুসাইন/আবু সাঈদ/ ১২
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।