জুলাই ২৬, ২০১৯ ১৭:০৮ Asia/Dhaka

রংধনু আসরের শিশু-কিশোর বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছো যে, প্রায় গোটা বিশ্বেই দুর্বল দেশ ও মানুষের ওপর শক্তিশালী দেশগুলো চালাচ্ছে অত্যাচার। নির্যাতিত দুর্বল মানুষেরা যতোই চিৎকার আর কান্নাকাটি করুক না কেন, অত্যাচারি শাসক কিংবা দেশগুলো তাদের অত্যাচার থামাচ্ছে না। তারা দুর্বল দেশগুলোর সম্পদ লুট করে নিয়ে যাচ্ছে।

যারা প্রতিবাদ করছে তাদেরকে নানাভাবে হয়রানি করছে। তবে আশার কথা হচ্ছে, জালিম শাসকদের বিরুদ্ধে এখন দুর্বল, মজলুম মানুষেরা প্রতিবাদী হয়ে উঠছে এবং জালিমদের ওপর দুর্বল, মজলুমেরা কখনও কখনও বিজয়ীও হচ্ছে।

এই অবস্থা কেবল মানুষের মধ্যেই নয়, পশু-পাখির মধ্যেও লক্ষ্য করা যায়। রংধনু আসরে আমরা এ সম্পর্কেই একটি গল্প শোনাব। গল্পটির নাম 'চড়ুই পাখি ও হাতি'। এ গল্পটি নেয়া হয়েছে তেরশ শতকের বিশিষ্ট ইরানী লেখক আহমদ বিন মুহাম্মদ শিরবানীর 'তোফহাতুল ইয়ামিন' গ্রন্থ থেকে। গল্পটির পর থাকবে চড়ুই পাখি সম্পর্কে কিছু জানা-অজানা তথ্য। আর সবশেষে থাকবে একটি গান। আমাদের আজকের অনুষ্ঠানটিও তৈরি করেছেন আশরাফুর রহমান। তাহলে প্রথমেই গল্পটি শোনা যাক।

হাতি

এক বনে বাস করতো এক ঝাঁক চড়ুই পাখি। তারা ঝুপড়িতে ডিম পাড়ত এবং বাচ্চা ফোটাত। ওই বনেই বাস করত একটি হাতি। একদিন ঝুপড়ির পাশ দিয়ে নদীতে পানি খেতে আসার সময় হাতির পায়ের নিচে পড়ে কয়েকটি চড়ুই পাখির বাচ্চা মারা গেল। চড়ুইরা এ খবর পেয়ে খুবই কষ্ট পেল। তাদের একজন এ ঘটনাকে ‘ভাগ্যের লিখন' বলে এড়িয়ে যেতে চাইল। কিন্তু কাকলী নামের এক চড়ুই প্রতিবাদ করে বলে উঠল : আমি এসব মানি না। হাতি বড় প্রাণী বলে অপরাধ করে পার পেয়ে যাবে তা হয় না। এর একটা বিহিত হওয়া দরকার। নইলে এই বনে আমরা কেউ বাস করতে পারব না।

কাকলীর যুক্তি ও বলিষ্ঠ বক্তব্য অন্য পাখিরা সমর্থন করলেও তারা কেউই হাতির কাজের প্রতিবাদ করার আগ্রহ দেখাল না। এর পরিবর্তে তারা ওই বন ছেড়ে অন্য স্থানে চলে যাওয়ার পক্ষে মত দিল। কিন্তু কাকলী কিছুতেই তা মেনে নিতে রাজি হলো না। সে বলল : এ বন হচ্ছে আমাদের জন্মভূমি। শত্রুর ভয়ে আমরা যদি এখান থেকে চলে যাই তাহলে আমরা আমাদের জন্মভূমির মর্যাদা রক্ষা করবো কী করে? তাছাড়া অপরাধ করেছে হাতি, চলে যেতে হলে তারই যাওয়া উচিত এখান থেকে।

একথা শুনে অন্য চড়ুই বলল : ঠিক বলেছ তুমি। কিন্তু অধিকার আদায় করতে গেলে তো লড়াই করতে হবে। আমরা কি হাতির সাথে লড়াই করতে পারব?

কাকলী : কেন পারব না? আমরা সবাই যদি বুদ্ধি খাটিয়ে, নিজেদের সামর্থকে কাজে লাগাই তাহলে নিশ্চয়ই হাতিকে পরাস্ত করতে পারবো। তবে লড়াইয়ে নামার আগে আমি হাতিকে শেষবারের মত সাবধান করতে চাই যাতে সে আর আমাদের ঝোপঝাড়ের কাছে না আসে।

অন্য চড়ুই : বেশ ভালো কথা। কিন্তু হাতি যদি না মানে তখন কী করবে?

কাকলী : হাতি যদি না শোনে তাহলে তাকে এমন শিক্ষা দেবো যা ইতিহাস হয়ে থাকবে।

এসব আলাপ আলোচনার পর কাকলী গেল হাতির কাছে। হাতিকে পেয়ে সে বলল:

কাকলী : এই হাতি ! তুমি আজ ঝোপের পাশ দিয়ে পানি খেতে যাওয়ার সময় আমাদের ক'টি বাচ্চাকে পায়ের তলায় পিষে মেরেছো। আমি জানতে এসেছি, তুমি কি ইচ্ছে করে এমনটি করেছো নাকি ভুল করে করেছো?

হাতি : আমি ইচ্ছে করে করি আর ভুল করে করি তাতে হয়েছেটা কী? না হয় ক'টা চড়ুইর বাচ্চা মারাই গেল, তাতে দুনিয়া উল্টে গেছে নাকি?

কাকলী : না, দুনিয়া উল্টে যায়নি। কিন্তু সবাই যদি আইন-কানুনের তোয়াক্কা না করে একে অপরের অনিষ্ট করে চলে তাহলে নিশ্চয়ই একদিন দুনিয়া উল্টে যাবে।

হাতি : ওসব ফালতু কথা বাদ দিয়ে এখান থেকে চলে যাও। নইলে তোমাদের সবাইকে আমার পায়ের নিচে পিষে মারব। জেনে রেখো, তোমার মত হাজারটা চড়ুই'র দাম আমার এক পায়ের সমানও না।

কাকলী : তুমি অনেক বড় প্রাণী-এটা আমি মানি। তবে তুমি শুধু নিজের দেহটার দিকে তাকিও না। আমরা ছোট হলেও আমাদের প্রাণেরও দাম আছে। আর তাছাড়া আমরা যদি ইচ্ছে করি তাহলে তোমার অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতে পারি।

হাতি : আমার প্রতিশোধ নিবি তোরা? ঠিকাছে তোরা যা করতে পারিস করগে। আর কথা না বাড়িয়ে এক্ষুণি আমার সামনে থেকে চলে যায়।

কাকলী : ঠিকাছে, যাচ্ছি। তবে তুমি তোমার অহংকার ও পাপের শাস্তি শিগগিরই পাবে।

এই বলে কাকলী নিজের আস্তানায় ফিরে এসে চড়ুইদের কাছে হাতির দুর্ব্যবহারের কথা জানাল। সব শুনে পাখিরা ভীষণ ক্ষেপে গেল এবং হাতিকে কিভাবে শায়েস্তা করা যায় তা জানতে চাইল। কাকলী বলল:

কাকলী : আমরা শক্তিতে হাতির সাথে পারব না ঠিকই, তবে হাতি যেহেতু উড়তে পারে না সেহেতু সে আমাদের আকাশে পিষে মারতে পারবে না। বরং আমরাই উপর থেকে নখ ও ঠোঁট দিয়ে হাতির ওপর হামলা করব। আমরা যদি হাতির চোখ ফুটো করে দিতে পারি তাহলে তার পরাজয় নিশ্চিত।

যুদ্ধের কৌশল নিয়ে আলোচনার পর সবাই মিলে একযোগে হামলা শুরু করল হাতির উপর। তারা হাতির চারপাশ ঘিরে ধরল। হাতি প্রতিরোধ গড়ে তোলার আগেই পাখিরা তার চোখ ফুটো করে দিল। কিছু দেখতে না পেয়ে হাতি পাগলের মতো ছুটাছুটি করতে লাগল।

এ সময় কাকলী ব্যাঙদের ডাকল এবং হাতির অত্যাচারের কাহিনী শোনাল। তারাও হাতির অত্যাচারের শিকার। হাতিকে সমুচিত শিক্ষা দেয়ার জন্য তারাও শপথ নিল।

এদিকে পাখিদের হামলায় চোখ হারিয়ে ছুটাছুটি করতে গিয়ে হাতির ভীষণ পিপাসা পেল। এ সময় কাকলীর নির্দেশে সব ব্যাঙ হাতির কাছে গিয়ে 'মেঘ হো', 'মেঘ হো' বলে ডাকাডাকি শুরু করল। ব্যাঙের ডাক শুনে হাতি ভাবল, ব্যাঙ যেহেতু ডাকছে সেহেতু খুব আশপাশে নিশ্চয়ই পানি পাওয়া যাবে।

যেমন ভাবা তেমন কাজ। পানি পাবার আশায় ব্যাঙদের শব্দ শুনে শুনে হাতি সামনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। এ সময় কাকলীর নির্দেশে ব্যাঙরা পৌঁছে গেল মস্তবড় এক গর্তের পাশে। সেখানে গিয়ে ব্যাঙরা 'মেঘ হো', 'মেঘ হো' বলে চিৎকার দিতে দিতে গর্তে লাফিয়ে পড়ল। ব্যাঙের ডাক অনুসরণ করতে গিয়ে হাতিও হুড়মুড় করে পড়ে গেল গর্তে। চোখে না দেখায় শত চেষ্টা করেও আর গর্ত থেকে বের হতে পারলো না। এভাবে হাতিকে উচিত শিক্ষা দিতে পেরে চড়ুই আর ব্যাঙরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।

চড়ুই

 চড়ুই পাখি সম্পর্কে জানা-অজানা কিছু তথ্য

জনবসতির মধ্যে থাকতে ভালোবাসে বলে চড়ুইয়ের ইংরেজি নাম 'হাউস স্প্যারো' অর্থাৎ 'গৃহস্থালির চড়ুই'। কোনো কোনো অঞ্চলে এই পাখিটি 'চড়াই' নামেও পরিচিত। পৃথিবীতে মোট ৪৮ প্রজাতির চড়ুই দেখতে পাওয়া যায়। এদের আদি নিবাস ছিল মূলত ইউরেশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশ। তবে বর্তমানে ইউরোপ থেকে গিয়ে জনবসতি স্থাপনের মধ্য দিয়ে এরা উত্তর আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডেও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে।

খড়কুটো, শুকনো ঘাস পাতা দিয়ে এরা কড়িকাঠে ও কার্নিশে বাসা বাঁধে। সমস্ত দিন এরা লাফিয়ে বেড়িয়ে মাটি থেকে পোকামাকড় শস্য খুঁটে খায়।  

চড়ুই ছোট আকারের পাখি। দৈর্ঘ্য ১৫ সেন্টিমিটার। ওজন মাত্র ২৪ গ্রাম। চড়ুইয়ের স্ত্রী-পুরুষে ভিন্নতা রয়েছে। পুরুষ চড়ুই স্ত্রী তুলনায় দেখতে সুন্দর। এদের মাথার চাঁদি ধূসর, ঘাড় ও চোখে তামাটে ডোরা। পিঠ জলপাই-বাদামি। বুক-পেট ও গাল সাদা। গলা কালো। মোটা ঠোঁট দুটো কালচে।

অন্যদিকে স্ত্রী চড়ুই হালকা হলদে-বাদামি। বুক ও পেট বাদামি-ধূসর। ঠোঁট গোলাপি। উভয়েরই চোখ বাদামি এবং পা ও পায়ের পাতা গোলাপি-বাদামি। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখি দেখতে মায়ের মতো, তবে অপ্রাপ্ত পুরুষ বাচ্চাগুলোর থুতনি কালো ও দেহ উজ্জ্বল বাদামি।

চড়ুই বহুল দৃশ্যমান আবাসিক পাখি। শহর, বন্দর, গ্রাম তথা লোকালয়ে এরা বাস করে। দালান ঘরে, কৃষি জমিতে, ফলের বাগানে, ছোট ঝোপঝাড়ে এরা বিচরণ করে। সচরাচর জোড়ায় বা ছোট দলে দেখা যায়। মাটিতে হেঁটে হেঁটে শস্য, ঘাসবিচি, ফুলের কুঁড়ি, ফল, পোকামাকড়, ভাত, খাবারের উচ্ছিষ্টাংশ ইত্যাদি খায়।  

মার্চ থেকে জুন চড়ুই পাখির প্রজননকাল। এসময় তারা খড়, শুকনো ঘাস-লতা, পাটের আঁশ ইত্যাদি দিয়ে মানুষের ঘরবাড়ির ফোকর, ভেন্টিলেটর বা ঘরের চালের নিচে বাসা বানায়।

চড়ুই পাখি ডিম পাড়ে ৩ থেকে ৭টি। ডিমের রং ফিকে সবুজাভ সাদা, তাতে বাদামি ছিট থাকে। ডিম ফোটে ১৪ দিনে। বাচ্চারা ২০ থেকে ২১ দিনে উড়তে শেখে।#

 

পার্সটুডে/আশরাফুর রহমান/২৬

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ