আগস্ট ১৫, ২০১৯ ২১:১৭ Asia/Dhaka

বাংলাদেশে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ডেঙ্গু আসলেই ভীতিকর। ডেঙ্গু পরিস্থিতিকে আমি যুদ্ধকালীন অবস্থা বলব। তবে সবাই মিলে তা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। রেডিও তেহরানকে দেয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে একথা বলেছেন স্থপতি, নগরপরিকল্পনাবিদ এবং শিক্ষাবিদ মোবাশ্বের হোসেন।

সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ ও উপস্থাপনা করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।

রেডিও তেহরান: জনাব মোবাশ্বের হোসেন, বাংলাদেশের প্রায় সব জেলায় ডেঙ্গুজ্বর ছড়িয়ে পড়েছে এবং বেশ কয়েকটি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। বিষয়টি কী স্বাভাবিক পর্যায়ে আছে বলে মনে হয়?

মোবাশ্বের হোসেন: দেখুন, আমি ডেঙ্গু বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নই। তবে আমি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলাম এবং গত কয়েকদিনে ডেঙ্গু বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের সাথে বেশ কয়েকবার বসেছি, আলোচনা করেছি। ফলে তাদের কাছ থেকে যেসব তথ্য পেয়েছি তাতে আসলেই কিছু কিছু ক্ষেত্রে ডেঙ্গু ভীতিকর।

ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত শিশু

২০০০ সালের পর এবারই প্রথম বর্ষকালের বৃষ্টির প্রকোপ অনেক আগে থেকে শুরু হয়। যে কারণে ২০০০ সালে মোটামুটি বড় আকারে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দিয়েছিল। মাঝের বছরগুলোতে ডেঙ্গু বৃদ্ধির সম্ভাবনা একেবারেই ছিল না বলা চলে। তবে এবার অগ্রিম এডিস মশার জন্ম হওয়ার কারণে আমরা ডেঙ্গুর প্রকোপটি দেখতে পাচ্ছি। এডিস মশার মাধ্যমে ডেঙ্গু ব্যাপক আকারে বিভিন্নভাবে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ছে। আর হিসেব মতো যদি এই বৃষ্টি সেপ্টেম্বর/ অক্টোবর পর্যন্ত দীর্ঘ হয় তাহলে আগের যে কোনো বছরের তুলনায় অনেক বেশি পরিমাণে এডিশ মশার আক্রমণ মানুষকে সহ্য করতে হবে। আর নারী এডিস মশার মাধ্যমেই কেবল ডেঙ্গু রোগটি ছড়ায়।

রেডিও তেহরান: এ অবস্থায় সরকার ও জনগণের করণীয় কী? বিশেষ কোনো পরামর্শ যদি থাকে..

মোবাশ্বের হোসেন: দেখুন, যেকথা আগেই বলেছি- আমারও ডেঙ্গু হয়েছিল। চিকুনগুনিয়াতে আমিও আক্রান্ত হয়েছিলাম। যেকারণে এ রোগকে আমি বিশেষভাবে অনুভব করি এবং এ বিষয়ক বিশেষজ্ঞদের সাথে গভীরভাবে বসেছি ও জানার চেষ্টা করেছি। 

করণীয় সম্পর্কে আমি বলব, আমার অনুরোধ ডেঙ্গু হলেই হাসপাতালে যাবেন না।  জ্বর হবার পর যদি আপনি শরীবে খুব বেশি খারাপবোধ করেন তখনই ব্লাড টেস্ট করাবেন। যদি নেগেটিভ হয় আবার তিন/চারদিন পর রক্ত পরীক্ষা করান। যদি দেখেন যে আপনি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন তাহলে বাসায় বিশ্রাম নিন। প্রচুর পরিমানে ফলের রস, ফ্লুয়েড খান। আপনার যদি পাতলা পায়খানা হয় বা অন্যান্য রোগ থাকে সেক্ষেত্রে অবশ্যই ডাক্তারের মাধ্যমে চিকিৎসা শুরু করবেন। সবার জন্য আমার পরামর্শ হচ্ছে আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন যে হাজারে একজনও অসুস্থ ডেঙ্গু জ্বরের রোগী চূড়ান্তভাবে খারাপের দিকে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই।

সরকারের সিটি করপোরেশনের কাছে আমার করজোড়ে নিবেদন যেসব হাসপাতালে ডেঙ্গু জ্বরের রোগী আছে সেসব হাসাপাতলের ডাক্তারদের রক্ষা করার জন্য হাসপাতালের চারপাশে মশা মারার ব্যাপারে ক্রাশ কর্মসূচি গ্রহণ করুন।

এডিস মশা

বিশেষজ্ঞদের মত হচ্ছে এডিস মশা কোনো অবস্থায় ড্রেনের ময়লা পানিতে জন্মায় না। এই মুহূর্তে ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধির কারণে আমরা মশা মারব না কেবল এডিস মশা মারব এমনটি ঠিক নয়। অর্থাৎ আমি বলব বিড়াল কামড়াচ্ছে আর বাঘ কামড়াচ্ছে। আমার এখন বাঘের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া সবথেকে আগে প্রয়োজন। সেজন্য আমরা প্রতিনিয়ত বলছি প্রতিটি বাড়ির মানুষকে এবং প্রতিটি পরিবারের সদস্যকে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে হবে। অর্থাৎ আমরা যদি প্রতিটি এলাকার প্রতিটি বাড়িকে ভাগ ভাগ করে অন্তত প্রতিদিন একবার দেখভাল করার চেষ্টা করি তাহলে নগরায়নের এই এডিসের অভিশাপ থেকে আমরা মুক্ত হতে পারব। ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। ডেঙ্গু খুব কঠিন রোগ না। আমরা খুবই আশাবাদী এইজন্য যে যদি আমরা সবাই সবাইকে নিয়ে ৯ মাসে দেশ স্বাধীন করতে পারি তাহলে ডেঙ্গুর এই ভয়াবহ অবস্থা থেকেও আমরা দেশ ও জাতিকে রক্ষা করতে পারব।

রেডিও তেহরান: আপনি যে জনসচেতনা সৃষ্টির কথা বললেন এবং সবাইকে একসাথে কাজ করার কথা বললেন। তো সেটা কতোটা করা সম্ভব হয়েছে। আর ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকারের পক্ষ থেকে নেয়া পদক্ষেপ কী যথেষ্ট বলে মনে করছেন? এর সঙ্গে সরকার আর কী কী ভূমিকা নিতে পারে?

ঢাকা দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন

মোবাশ্বের হোসেন: দেখুন, ঢাকা সিটি করপোরেশনের দুই মেয়র দুই ধরনের বক্তব্য দিচ্ছে। সরকারের মন্ত্রীরা আরেক ধরনের বক্তব্য দিচ্ছেন। ডেঙ্গু পরিস্থিতিতে আমি যুদ্ধকালীন অবস্থা বলব। যুদ্ধকালীন অবস্থায় সরকারি দল বিরোধীদল একমত হয়। যেমন ধরুন বাংলাদেশের ক্রিকেটের ব্যাপারে যদি আমরা একমত হতে পারি। যদি বাংলাদেশের ক্রিকেট টিম কোনো খেলায় জয়ী হয় তখন সবাই খুশি হই আবার পরাজয়ে সবার দুঃখ হয়। সেক্ষেত্রে আমাদের চোখের সামনে ডেঙ্গুর মতো এতবড় একটা দুর্যোগ থেকে সবাই মিলে কেন দেশকে রক্ষা করতে পারব না এবং একতাবদ্ধ হতে পারব না ? আপনাদের মাধ্যমে আমি একটি কথা বলতে চাই। সেটি হচ্ছে বাংলাদেশের সরকারের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান যেন ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে এডিস মশা নিয়ে একইধরনের বক্তব্য দেয়। ভুল তথ্য দিয়ে মানুষকে উদগ্রীব করার কোনো কারণ নেই। আমরা সবাই মিলে চাইলে আগামী ১/২ মাসের মধ্যে এটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য আমাদের দুটি বিশেষ করণীয় আছে। 

একটি হচ্ছে, উড়ন্ত এডিস মশাকে মারতে হবে।

দ্বিতীয়টি হচ্ছে, পরিস্কার পরিচ্ছন্নতাজনিত ব্যর্থতার কারণে যেখানে এডিস মশার জন্ম হচ্ছে সেটি বন্ধ করা। অর্থাৎ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন জমে থাকা পানিতে এডিসের জন্ম হচ্ছে। সেটি সংরক্ষণ করা থেকে সবাইকে বিরত থাকতে হবে। ড্রেনের ময়লা পানিতে জন্ম নেয়া মশা আপাতত না মারলেও চলবে-কারণ সেটি উদ্বেগের কারণ নয়। এডিস মশার লার্ভাকে সমূলে বিনাশ করতে হবে। আমরা যদি সবাই মিলেমিশে এই কাজটি করতে পারি তাহলে এটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। আর আমি বিশ্বাস করি এটি করা সম্ভব। তবে এডিস মশা নিধনে সমন্বয়হীনতা রয়েছে। আর সমন্বয়হীনতা থাকলে আমরা এ ব্যাপারে সফল হতে পারব না। শুধু এডিস নয় প্রতিটি কাজই সমন্বয়হীনতার কারণে ব্যর্থ হব দিন শেষে। ফলে আমার বলার জায়গাটি হচ্ছে এডিস এবং ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে সরকার এবং সরকারের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান যেন একধরনের বক্তব্য নিয়ে যেন কাজ করেন।

রেডিও তেহরান:  জনাব মোবাশ্বের হোসেন, আপনি সমন্বয়ের কথাটি বললেন, সরকারের প্রতিটি বিভাগ যেন সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করে সে ব্যাপাারটিও বললেন, কিন্তু দেখা গেল যখন সারাদেশে ডেঙ্গু আতঙ্কে তখন স্বাস্থ্যমন্ত্রী স্বপরিবারে মালয়েশিয়া সফর গেলেন বিষয়টি নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠার পর তিনি ফিরেও আসেন। ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের মধ্যে সমন্বয়হীনতা এবং বেশ কিছু কথাবার্তার কারণে সমালোচনা হচ্ছে। তো আসলে তাদের কী কোনো ব্যর্থতা আছে বলে মনে হয় আপনার?

মোবাশ্বের হোসেন: দেখুন আমি প্রায়ই একটি কথা বলে থাকি। সেটি হচ্ছে একজন মানুষকে সব ব্যাপারে জ্ঞানী হতে হবে এমনটি নয়। একটি উদাহরণ দিতে চাই। মাত্র ১১ বছর বয়সে আকবর দ্যা গ্রেট হয়েছিল। তাহলে কি আমরা ধরে নেব পৃথিবীর সমস্ত জ্ঞানভাণ্ডার তার মাথার ভেতরে ছিল? বিষয়টি তেমন নয়। আকবর দ্যা গ্রেট পরিবেষ্টিত ছিলেন নয় জন পণ্ডিত ব্যক্তিদের দ্বারা। অর্থাৎ তাঁর ৯ জন উপদেষ্টা বা পরামর্শক ছিলেন। তাদের মাধ্যমেই তিনি তার সমস্ত কার্যক্রম পরিচালনা করত। আমি আমাদের সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের কাছে অনুরোধ জানিয়েছি যে আপনারা আকবরের ওই পদ্ধতিটি গ্রহণ করুন এবং কাজে লাগান। অথচ দুঃখজনক আপনাদের চারপাশে তাকালে আমরা দেখতে Nine criminals কে। এ জায়গা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। তাহলে এ দেশকে সুন্দরভাবে তৈরি করার ক্ষেত্রে কোনো অসুবিধা থাকবে না। অতিকথন কোনো অবস্থাতেই ভালো নয়। যে ব্যাপারে যিনি অভিজ্ঞ নন সে ব্যাপারে তারতো কথা বলার দরকার নেই। পেশাজীবীদের কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। তাদেরকে দিয়ে এই কঠিন কাজগুলো করাতে হবে।  

রেডিও তেহরান: জনাব মোবাশ্বের হোসেন, বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে অনিয়মের একটা চিত্র দেখা যায়। ডেঙ্গু রোগীর রক্ত পরীক্ষা নিয়েও ডায়াগনস্টিক সেন্টার বা হাসপাতালগুলোতে অনিয়েমের অভিযোগ উঠেছে। জরিমানাসহ গ্রেফগারের ঘটনাও ঘটেছে। এ বিষয়ে কি বলবেন..

মোবাশ্বের হোসেন: দেখুন, শুধুমাত্র স্বাস্থ্যক্ষেত্রে না যখন প্রতিটি ক্ষেত্রে অন্যায় হয় তখন আপনি একটিমাত্র ক্ষেত্রকে দোষারোপ করতে পারবেন না। আইনের শাসন এমন একটি বিষয়-আপনি যখন একটি রাষ্ট্রে আইনের শাসন প্রয়োগ করতে যাবেন তখন আপনার প্রথম কাজ আপনার বাড়ির প্রতিটি মানুষের ওপর কঠোর থেকে কঠোরতরভাবে আইন প্রয়োগ করা।

রেডিও তেহরান: জনাব মোবাশ্বের হোসেন, আপনি বললেন দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের ভালো পরামর্শক থাকবেন। জটিল কোনো পরিস্থিতিতে তারা পরামর্শ দেবেন। কিন্তু যে প্রশ্নটি আমি করব সেটি হচ্ছে- দেশের যেকোনো একটা পরিস্থিতিতে দায়িত্বশীল মন্ত্রী, এমপি, সচিবসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের কাছ থেকে শোনা যায় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে- এটি করা হচ্ছে। এমনটি কেন। সবকাজে কী প্রধানমন্ত্রীকে নির্দেশ দিতে হবে-তাহলে তাঁদের দায়িত্ব কী? 

মোবাশ্বের হোসেন: দেখুন, আপনার এ কথার উত্তর আমি দিতে পারি। আমি প্রায়শ টেলিভিশনে বলেছি যে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একদিন হয়তো আপনাকে বলতে হবে যে মীরপুর রোডের ১৮ নম্বর লাইটপোস্টের বাল্বটি বদলানোর নির্দেশ দেয়া হলো। আর যদি বাল্ব বদলানোর নির্দেশও আপনাকে দিতে হয় তাহলে এই মন্ত্রীদেরকে কেন রেখেছেন? মন্ত্রীদেরকে বাদ দিয়ে দিন! বরং সেক্রেটারি দিয়ে দেশ চালান। তখন অন্তত এই মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের বেতন দেয়ার হাত থেকে দেশ মুক্ত হবে। তাদের তদবিরের হাত থেকে দেশ মুক্ত হবে। আমার মাঝে মাঝে কী মনে হয় জানেন-যখন রাস্তায় মানুষ ক্রিমিনালকে ধাওয়া করে পকেটমার পকেটমার বলে তখন ওই পকেটমার রাস্তার মোড় ঘুরেই চিৎকার দেয়া শুরু করে পকেটমার পকেটমার পকেটমার। আর সেই সুযোগে পকেটমার জনগণের মাঝে ঢুকে পড়ে। আমাদের দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমরা এখন এইধরনের পকেটমার চরিত্রের মানুষগুলোকে দেখতে পাচ্ছি।#

পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/১৫

ট্যাগ