ইরানি পণ্য সামগ্রী: নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও বিশ্ববাজারে মাছ রপ্তানি করছে ইরান
গত আসরে আমরা খামারে মাছ চাষ এবং ইরানে এই শিল্পের ক্রমবিকাশ নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করেছি। বলেছি যে, খামারে মাছ চাষের জন্য পানি কতোটা গরম হওয়া উচিত সে বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
খামারের মাছ সাধারণত বিশ থেকে ত্রিশ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় ভালোভাবেই বেড়ে ওঠে। তাপমাত্রা তেত্রিশ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের বেশি হলে মাছের জন্য সমস্যা হয়ে যায়, শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা পড়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। আবার তাপমাত্রা তের ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের কম হলে মাছ অসুস্থ হয়ে পড়ে। আট ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় মাছেরা শীতকালীন দীর্ঘ নিদ্রায় চলে যায়। কিছু কিছু মাছ আছে পরিষ্কার ও স্বচ্ছ জলে তাদের প্রয়োজনীয় মাইক্রোঅর্গানিজমের অভাবে তাদের বৃদ্ধি ও বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। এই শ্রেণীর মাছ অস্বচ্ছ ও ঘোলা জলেই বেড়ে ওঠে। গরম পানির এই মাছের মধ্যে রয়েছে কার্ফু মাছ। ইরানে চার রকমের কার্ফু মাছের চাষ করা হয়। মাছগুলোর রঙও ভিন্ন ভিন্ন রকমের। এই শ্রেণীর মাছ পুকুরের শ্যাওলা খেয়ে অভ্যস্থ হওয়ায় মৃৎ-পুকুরেও এগুলোর ভালোই চাষ হয়।
পুকুরের কথা তো বললাম। এর বাইরেও বিভিন্ন ধরনের বক্স কিংবা চারির আঙ্গিকে তৈরি পানি ধারণের উপযোগী কৃত্রিম জলাধারেও মাছ প্রতিপালন করা হয়। ইরানে এই পদ্ধতিতে মাছ চাষের ইতিহাস বেশ প্রাচীন। ইরানের মাছ চাষী কিংবা মাছ শিকারিরা আগেকার দিনে শিকার করা মাছ বাজারে নেওয়ার আগে এ ধরনের পাত্রে রক্ষণাবেক্ষণ করতো। আবার নেট বা জালের মতো দেখতে স্টিলের খাঁচার মতো বড় রকমের পাত্রেও মাছ প্রতিপালন করার রেওয়াজ ছিল। বিশেষ করে সমুদ্রের পানিতেই এরকম খাঁচায় মাছ চাষ করলে মাছ তার স্বাভাবিক অবস্থার মধ্যেই বেড়ে উঠতো। জালের খাঁচায় মাছ চাষের রীতি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রচলিত আছে। ইরানের কীশ দ্বীপে এই সিস্টেমটি ব্যবহার করা হয়েছে। কার্ফু জাতীয় মাছগুলো এরকম খাঁচায় বেশি চাষ করা হয়। এখানকার কার্ফু মাছ পাশ্ববর্তী ইরাক, আজারবাইজান, রাশিয়া ও আফগানিস্তানে রপ্তানি করা হয়।

রেইনবো স্যালমন ফিশ এবং লাল আঁশযুক্ত স্যালমন দ্বিতীয় শ্রেণীর মাছ যেগুলো ইরানের মৎস্য খামারে প্রতিপালিত হয়। ঠাণ্ডা পানির মাছ এগুলো। সমগ্র বিশ্বেই মোটামুটি এই মাছগুলো বাজারে বেশ সমাদৃত। ছয় থেকে উনিশ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রার পানিতেই এগুলো বেড়ে উঠতে পারে। অক্সিজেনপূর্ণ ঠাণ্ডা পানিতেই বাস করে রেইনবো স্যালমন। স্যালমনকে ট্রাউটও বলা হয়। সুতরাং রেইনবো ট্রাউটও বলা যায় এই মাছকে। উত্তর আমেরিকার প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূলে এই মাছ বাস করতো। এখন অবশ্য সারা বিশ্বেই এই মাছ ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছে।
রেইনবো ট্রাউটের ওজন কোনো কোনো হ্রদে মোটামুটি নয় কিলোগ্রাম পর্যন্ত হয়। লাল আঁশের স্যালমন ফিশ রঙ এবং আকৃতির দিক থেকে বেশ কয়েক প্রকারের হয়। এটা নির্ভর করে পার্বত্য এলাকার পানির রঙের ওপর। ফার্সি ভাষায় 'অজা'দে দারিয়য়ি' নামে বড়োসড়ো এক ধরনের মাছ পাওয়া যায়। এ মাছের মাংসও স্যালমন ফিশের মতোই লাল রঙের। ইংরেজিতে এই মাছকেও স্যালমনই বলে। তবে বাংলাদেশে যে সিলভার কাপ নামে রূপালি রঙের এক ধরনের মাছ পাওয়া যায়, এই মাছটিও দেখতে সেরকমই। তবে দারিয়য়ি যে মাছটি, তার রঙ একটু ধূসর বর্ণের এবং আকারেও বড়ো হয়। সিলভার কাপের স্বাদের সঙ্গে অজা'দে দারিয়য়ি'র স্বাদের ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে।
ইরান যেহেতু পর্বতের দেশ, তাই এখানে ঝর্নাধারাও রয়েছে প্রচুর। ঝর্নার পানি তুলনামূলকভাবে ঠাণ্ডা হবার কারণে স্যালমন ফিশের বসবাসের উপযোগী। সেজন্যই দেখা যায় ইরানের বহু প্রদেশে এই স্যালমন ফিশ রয়েছে। গিলান, লোরেস্তান, মারকাজি, ইস্ফাহান প্রদেশসহ আরও অনেক প্রান্তরের জলাশয়েও এই মাছ প্রতিপালন করা হয়। ইরানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় আরদেবিল প্রদেশে ঠাণ্ডা পানির মাছ ব্যাপক চাষ হয়। এই প্রদেশটি ইরানের মধ্যে তুলনামূলকভাবে বেশি ঠাণ্ডা। এখানে রয়েছে চার শতাধিক জলাশয়। রেইনবো স্যালমন শ্রেণীর মাছ চাষের জন্য এই এলাকাটি যথেষ্ট উপযোগী।
ইরানের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও মাছ চাষ এবং গুণগত মান রক্ষা করে বিশ্ববাজারে রপ্তানির ক্ষেত্রে ইরান পিছিয়ে নেই। পোনা তৈরি থেকে শুরু করে মাছের খাদ্য প্রস্তুত করা এবং খামারে উপযুক্ত আবহাওয়া ও তাপমাত্রা বজায় রেখে মাছ চাষের সকল নিয়ম ও প্রক্রিয়া মেনে উৎপাদন করা হচ্ছে ইরানে। জ্ঞানভিত্তিক কোম্পানিগুলোও এখন এ ক্ষেত্রে এগিয়ে এসেছে বিশেষ করে স্যালমন ফিশ উৎপাদনে বৈজ্ঞানিক উপায় অবলম্বন করে কোম্পানিগুলো সাফল্য অর্জন করেছে। বিশ্বব্যাপী এখন মাছ বাজারজাত করার বিভিন্ন প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হচ্ছে। যেমন জীবিন্ত মাছ সরবরাহ করা, মাছ কেটে আঁশ এবং কাঁটা ফেলে দিয়ে প্যাকেটে সরবরাহ করা, ফ্রোজেন বা জমাটবদ্ধ করা, শুটকি, গ্যাসের ধোঁয়ায় শুকানোর মাধ্যমে, লবণে রেখে, মাছ দিয়ে সস তৈরি করে, ক্যানজাত করে ইত্যাদি বিভিন্ন পদ্ধতিতে বাজারজাত করা হয়। এইসব পদ্ধতির কল্যাণে বিশ্বের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়ার পথ সুগম হয়েছে।
সেইসঙ্গে মাছ রান্নারও রয়েছে বিভিন্ন প্রক্রিয়া। কেউ রেঁধে খায়, কেউ কাবাব করে খায়, কেউ গ্রিল করে আবার কেউ ভর্তার মতো করে। অনেকেই আবার মাছের সসেস পছন্দ করে। বাঙালি যেহেতু ভাতে মাছে বাঙালি, সুতরাং মাছ খাওয়ার পক্রিয়া নিয়ে তাদের বেশি বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। #
পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/ মো:আবু সাঈদ/ ২৪
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।