নভেম্বর ২৩, ২০১৯ ১৭:৩০ Asia/Dhaka

গত আসরে আমরা বলেছি, ইরানে আগ্রাসন চালানোর ক্ষেত্রে তৎকালীন ইরাকি স্বৈরশাসক সাদ্দাম সীমান্ত সমস্যাকে অজুহাত হিসেবে তুল ধরলেও প্রকৃতপক্ষে তার লক্ষ্য ছিল আরো অনেক বড়।

ইসলামি বিপ্লবের মাধ্যমে ইরানে আমেরিকার তাবেদার শাহ সরকারের পতন হওয়ার পর মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার পদলেহী হিসেবে শাহের স্থলাভিষিক্ত হওয়ার বাসনা জেগেছিল সাদ্দামের মনে। ইরাক-ইরান যুদ্ধ শুরু হওয়ার এক বছর পর তৎকালীন ইরাকি উপ প্রধানমন্ত্রী তাহা ইয়াসিন রমাজান এ সম্পর্কে বলেছিলেন: “এই যুদ্ধ কয়েকশ’ কিলোমিটার ভূমি কিংবা ‘আরভান্দ রুদ’ নদী দখলের জন্য নয় বরং এই যুদ্ধ ইরানের ইসলামি শাসনব্যবস্থার পতন ঘটানোর জন্য শুরু করা হয়েছে।”

ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর থেকেই ইরাকের পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশ এবং তাদের পশ্চিমা মিত্ররা ইরানের ইসলামি সরকারের পতন ঘটানোর অভিন্ন লক্ষ্য পোষণ করত। তারা চেয়েছিল যুদ্ধের মাধ্যমে ইরান সরকারের পতন ঘটানো না যাক অন্তত দেশটির আচরণে পরিবর্তন আনতে হবে। প্রায় ৪০ বছর আগের সেই কথা বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মুখেও উচ্চারিত হয়: ‘ইরানকে তার আচরণ পরিবর্তন করতে হবে।’ যাই হোক, আমেরিকা ও তার আঞ্চলিক মিত্র দেশগুলো চেয়েছিল, ইরানের ইসলামি বিপ্লব থেকে বিশ্বের অন্য কোনো দেশের স্বাধীনতাকামী মানুষ যাতে অনুপ্রেরণা না পায় সেজন্য এই বিপ্লবকে অঙ্কুরেই শেষ করে দিতে হবে।

কাজেই আমেরিকা ও ইউরোপীয় দেশগুলো ইরানের বিরুদ্ধে একের পর এক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে থাকে।  ইরানের ভেতরে বামপন্থি বিভিন্ন গোষ্ঠী, পরাজিত শাহ সরকারের অনুগত বিভিন্ন দল এবং কিছু সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে ইসলামি সরকারের বিরুদ্ধে সহিংসতা সৃষ্টি করতে উসকানি দেয়া হয়। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ইরানের ওপর নানারকম নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয় যার ফলে অনেক দেশ ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে, পশ্চিমা দেশগুলোতে ইরানের সম্পদ আটকে দেয়া হয় এবং তাবাস মরুভূমি দিয়ে ইরানে কমান্ডো অভিযান পরিচালনার চেষ্টা করা হয়। ইরানের বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের হাতে তেহরানস্থ মার্কিন দূতাবাস দখলের ঘটনায় আটক মার্কিন কূটনীতিকদের মুক্ত করার জন্য ওই কমান্ডে অভিযান চালানো হয়। কিন্তু তাবাস মরুভূমিতে ওই অভিযান ভয়ঙ্করভাবে ব্যর্থ হয়।

ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের স্থপতি ইমাম খোমেনী (রহ.)’র অনুসারী বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল ছাত্র অনুভব করেন, তেহরানস্থ মার্কিন দূতাবাস কূটনৈতিক তৎপরতার পরিবর্তে ইরানের ইসলামি সরকারের পতন ঘটানোর লক্ষ্যে গুপ্তচরবৃত্তির কাজ করছে। পরবর্তীতে ‘গুপ্তচরবৃত্তির আখড়া’ হিসেবে খ্যাত মার্কিন দূতাবাস দখলের পর সেখান থেকে উদ্ধার হওয়া দলিলপত্রে ছাত্রদের সে ধারণার সত্যতা প্রমাণিত হয়। আটক মার্কিন কূটনীতিকদের ছাড়িয়ে নিতে আমেরিকার কমান্ডো অভিযান ব্যর্থ হওয়ার পর মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা শক্তি নয়া কর্মসূচি হাতে নয়। মার্কিন দৈনিক নিউ ইয়র্ক টাইমস ইরাকের ইরান আগ্রাসন শুরুর পাঁচ মাস আগে ১৯৮০ সালের এপ্রিলে খবর দেয়, আমেরিকা ইরানের ইসলামি সরকারের পতন ঘটানোর লক্ষ্যে পর্যায়ক্রমিক বিভিন্ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

দৈনিকটি জানায়: তাবাস অভিযান ব্যর্থ হওয়ার পর মার্কিন সরকার তিনটি নয়া গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু করে। এসব পরিকল্পনা হচ্ছে, যেসব শহরে মার্কিন গুপ্তচরদের আটক রাখা হয়েছে সেসব শহরে ছত্রী সেনা নামানো, ইরানের তেল কূপগুলোতে মাইন পেতে রাখা কিংবা ইরানের তেল শোধানাগারে বোমা হামলা চালানো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সম্ভাব্য বিপদের কথা বিবেচনা করে সেসব পরিকল্পনা স্থগিত রাখা হয়। পশ্চিমা দেশগুলোতে এই মতামতও গ্রহণযোগ্যতা পায় যে, একটি শক্তিশালী দেশের সঙ্গে যুদ্ধ করতে বাধ্য করা হলে হয়তো ইরান তার আচরণে পরিবর্তন আনবে। ইরানের ওপর ইরাকি আগ্রাসন শুরু হওয়ার আগে আরেকটি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। কথা ছিল ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে ইরানের ইসলামি সরকারের পতন ঘটবে। আর যদি পরিকল্পনা ব্যর্থ হয় তাহলে দেশটির বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করা হবে।

ওই পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৯৮০ সালের ২৫ জুন ইরানের সেনাবাহিনীর একটি অংশের সহযোগিতায় সামরিক অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা চালায় আমেরিকা। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় আমেরিকার এই ষড়যন্ত্রও ব্যর্থ হয়। সামরিক অভ্যুত্থান সংঘটিত হওয়ার আগেই ষড়যন্ত্রকারীরা ধরা পড়ে যায় এবং অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। ফলে আমেরিকা ইরানের ইসলামি শাসনব্যবস্থার সামনে অসহায় হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেবিগনিউ ব্রেজিনেস্কি বলেন: “এখন আমেরিকার উচিত ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালাতে আগ্রহী দেশগুলোকে সমর্থন ও উসকানি দেয়া।”ব্রেজিনেস্কি নিজের উত্থাপিত ওই পরিকল্পনার জের ধরে ১৯৮০ সালের ৬ জুলাই জর্দান সফরে গিয়ে ইরাকের তৎকালীন শাসক সাদ্দামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

ব্রেজিনেস্কি ওই সাক্ষাতে সাদ্দামকে পরোক্ষভাবে এই ইঙ্গিত দেন যে, ইরাক যদি ইরানে সামরিক আগ্রাসন চালায় তাহলে তাতে ওয়াশিংটনের সমর্থন থাকবে। পরবর্তীতে ইরাক-ইরান যুদ্ধ শুরু হলে প্যারিস থেকে প্রকাশিত ম্যাগাজিন লা ফিগারো এক নিবন্ধে জানায়: “ইরাক-ইরান যুদ্ধের বীজ মূলত বপিত হয়েছিল জর্দান-ইরাক সীমান্তে সাদ্দামের সঙ্গে ব্রেজিনেস্কি’র সাক্ষাতে। মার্কিন নিরাপত্তা উপদেষ্টা সাদ্দামকে জানান, তিনি যদি ইরানে হামলা চালিয়ে আরভান্দ রুদ দখল করেন এবং ওই অঞ্চলে একটি আরব শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন তাহলে তাতে আমেরিকার আপত্তি থাকবে না।” ওই সাক্ষাতের জের ধরে কার্টার সরকার ইরাকের কাছে পাঁচটি যাত্রীবাহী বোয়িং বিমান বিক্রির অনুমতি দেয় এবং ইরানে আগ্রাসন শুরুর কয়েকদিন আগে বাগদাদের কাছে জেনারেল ইলেকট্রিক কোম্পানির ইঞ্জিন বিক্রির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়।

সাদ্দামের নেতৃত্বাধীন ইরাক যখন তৎকালীন সোভিয়েত বলয়ের কাছ থেকে সব ধরনের রাজনৈতিক ও সামরিক সহযোগিতা পেয়ে আসছিল ঠিক সে সময় ইরাকের প্রতি আমেরিকা এই আনুকূল্য দেখায়। কাজেই দেখা যাচ্ছে, ইরাকের ইরান আগ্রাসনের পেছনে তৎকালীন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দুই পরাশক্তি যৌথভাবে মদদ যোগায়। #

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ / ২৩

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।