ইরান-ইরাক যুদ্ধের ইতিহাস (৪ পর্ব): সাদ্দামের আগ্রাসনে দুই পরাশক্তির ঐক্যবদ্ধ অবস্থান
ইরানের ওপর ইরাকের সাবেক বাথ শাসক সাদ্দামের আগ্রাসনের পেছনে কীভাবে তৎকালীন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দুই পরাশক্তি ঐক্যবদ্ধ হয়ে গিয়েছিল- আজকের আসরে আমরা সে বিষয়ে কথা বলার চেষ্টা করব।
শীতল যুদ্ধের ইতিহাসে ইরাকের ইরান আগ্রাসনের মতো আর একটি ঘটনাও পাওয়া যাবে না যেখানে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দুই পরাশক্তি সম্মিলিতভাবে একটি পক্ষ নিয়েছিল। ইসলামি বিপ্লবের আগে ইরানের তাবেদার শাহ সরকার ছিল মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন নীতি বাস্তবায়নের প্রধান হাতিয়ার। বিপ্লবের মাধ্যমে শাহ সরকারের পতনের ফলে আমেরিকা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কারণ, তাৎক্ষণিকভাবে শাহের মতো প্রভাবশালী ক্রীড়নক ভূমিকা আর কারো পক্ষে পালন করা সম্ভব ছিল না। এ কারণে ইরানের ইসলামি বিপ্লবের ক্ষতি করার জন্য আমেরিকা সর্বশক্তি নিয়োগ করে। ওয়াশিংটন ইরানের ইসলামি সরকার উৎখাতের প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে তেহরান-বিদ্বেষী তৎপরতা শুরু করে।
এ অবস্থায় ১৯৮০ সালের ছয় জুলাই তৎকালীন মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেবিগনিউ ব্রেজিনিস্কি জর্দান সীমান্তে ইরাকের সাবেক স্বৈরশাসক সাদ্দামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন; যার ফলে বাগদাদ-ওয়াশিংটন সম্পর্কে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। ওই সাক্ষাতের জের ধরে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার ইরাকের কাছে পাঁচটি যাত্রীবাহী বোয়িং বিমান বিক্রির অনুমতি দেন এবং ইরানে আগ্রাসন শুরু করার কয়েকদিন আগে ইরাকের কাছে জেনারেল ইলেকট্রিক কোম্পানির ইঞ্জিন বিক্রির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন। সে সময় সোভিয়েত বলয়ভুক্ত ইরাকের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্কে চরম টানাপড়েন থাকা সত্ত্বেও ইরানের নবগঠিত ইসলামি সরকারব্যবস্থা উৎখাতের জন্য সাদ্দাম হয়ে দাঁড়ায় আমেরিকার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এদিকে সাদ্দামও এতদিন ইরানের শাহ সরকারের কারণে আমেরিকার কাছে ঘেঁষতে না পেরে যে মনোকষ্টে ভুগছিলেন তারও অবসান হয় আমেরিকার নয়া কৌশলগত সিদ্ধান্তে।
ইরাকের সাবেক এই স্বৈরশাসক সৌদি আরবের সঙ্গেও সম্পর্ক শক্তিশালী করেন। তিনি আমেরিকার আরো বেশি ঘনিষ্ঠ হওয়ার জন্য মুসলিম বিশ্বের জন্য লজ্জাজনক ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির বিরোধিতা করা থেকে সরে আসেন। সাদ্দামে হোসেন আমেরিকার কৌশলগত নীতি সঠিকভাবে উপলব্ধি করেন এবং তেহরানের সঙ্গে ওয়াশিংটন কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার একদিন পর ১৯৮০ সালের ৯ এপ্রিল ঘোষণা করেন, “ইরাক নিজের গৌরব ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করার লক্ষ্যে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত।” শেষ পর্যন্ত ইরানের ইসলামি বিপ্লবকে মোকাবিলা করতে পরস্পরের কাছে এগিয়ে আসা আমেরিকা ও ইরাকের মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমে ইরাকের ইরান আগ্রাসনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়।

সাদ্দাম ইরানে আগ্রাসন চালাতে আগ্রহী বলে খবর পাওয়ার পর মার্কিন সরকার ইরানের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক পরিস্থিতি সম্পর্কিত সব তথ্য সৌদি আরবের মাধ্যমে সাদ্দামকে সরবরাহ করে। এসব তথ্য সাবেক শাহ সরকারের শাসনামলে ওয়াশিংটন সংগ্রহ করেছিল। এর ফলে ইরানে আগ্রাসন চালাতে বদ্ধপরিকর হয়ে যান সাদ্দাম। ১৯৮২ সালের ৯ জুন ফরাসি সাময়িকী ‘জুন আফরিক’ এ সম্পর্কে লিখেছে, “যুদ্ধ শুরুর ঠিক এক মাস আগে সৌদি সরকার সাদ্দামকে এক অভুতপূর্ব উপহার প্রদান করে। আর তা হলো, ইরানের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রতিবেদন। এমনকি ইরানের সেনা সংখ্যা, সমরাস্ত্রের পরিমাণ ও সেগুলোর অবস্থানসহ এ ধরনের পুঙ্খানুপুঙ্খ গোপন সব তথ্য সাদ্দামের হাতে তুলে দেয় সৌদি আরব। ফলে ইরাকের ইরান আগ্রাসনের ক্ষেত্র সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়ে যায়।”
ইরানের সেনাবাহিনী ও সমরাস্ত্র বিপ্লবের আগে শতভাগ আমেরিকার ওপর নির্ভরশীল ছিল। ইরানের সেনা কর্মকর্তারা তাদের পেশাদার প্রশিক্ষণ আমেরিকা থেকে গ্রহণ করতেন। কাজেই, আমেরিকার হাতে ইরানের সামরিক শক্তি সম্পর্কে যে তথ্য ছিল তা শাহ সরকারের হাতেও ছিল না। কাজেই এত গোপনীয় প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পর সাদ্দাম চরম পুলকিত হন এবং তিনি ধারনা করেন, আগ্রাসন শুরু করার তিনদিনের মাথায় ইরাকি বাহিনী ইরানের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় খুজিস্তান প্রদেশ দখল করতে পারবে। ফরাসি পত্রিকা ডার স্পাইগেল সে সময় এ সম্পর্কে এক নিবন্ধ প্রকাশ করে জানায়: “এমন অনেকগুলো কারণ রয়েছে যার ফলে বলা যায়, যেকোনো ক্লাসিক্যাল যুদ্ধে ইরাকের কাছে ইরান পরাজিত হবে। কারণ, ইরাকের রয়েছে সুসজ্জিত ও সুপ্রশিক্ষিত একটি সেনাবাহিনী।” মার্কিন পত্রিকা হেরাল্ড ট্রিবিউন এ সম্পর্কিত এক বিশ্লেষণে জানায়, “মার্কিন সমর বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বর্তমানে ইরানের সেনাবাহিনীর পক্ষে দেশটির সীমান্ত রক্ষা করা সম্ভব নয়। ইরাকের সঙ্গে কঠিন যুদ্ধ শুরু হলে কয়েকদিনের মধ্যে অথবা সর্বোচ্চ এক/দুই সপ্তাহের মধ্যে ইরান পরাজিত হবে।”
ইরানের ওপর ইরাকের আগ্রাসনের সময়ে ইরানি কর্মকর্তাদের মধ্যেও প্রয়োজনীয় সমন্বয় ও ঐক্য ছিল না। বিপ্লবের ঠিক পরপরই তখনো প্রশাসন ঢেলে সাজানোর কাজ চলছিল এবং শাহের শাসনামলের অনেক কর্মকর্তা বাহ্যিকভাবে নিজেকে বিপ্লবী বলে দাবি করলেও শত্রুদের পক্ষে কাজ করত। এমনকি বিপ্লবীদের মধ্যেও শত্রুর পক্ষে কাজ করা লোকের অভাব ছিল না। এ ধরনের দ্বৈত চরিত্রের মানুষদের শীর্ষে ছিলেন ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রথম প্রেসিডেন্ট ও সশস্ত্র বাহিনীর তৎকালীন সর্বাধিনায়ক আবুলহাসান বনিসদর। তিনি ইসলামি ইরানের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম খোমেনী (রহ.)’র বিশ্বাসভাজন হয়ে বিপ্লবের প্রতি চরম বিশ্বাসঘাতকতা করেন। তিনি বিভিন্ন ফ্রন্টে আগ্রাসী ইরাকি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইরত ইরানের সেনাবাহিনী ও গণবাহিনীর কাছে অস্ত্র ও রসদ পাঠানো বন্ধ করে দেন।
এখানে উল্লেখ্য যে, ইরানে কমান্ডো অভিযান চালাতে গিয়ে ব্যর্থ হওয়ার পর মার্কিন সরকার ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক অভ্যুত্থান অথবা যুদ্ধ- এ দু’টোর যেকোনো একটি বাস্তবায়ন করার বিষয়টি পর্যালোচনা করে শেষ পর্যন্ত অভ্যুত্থান ঘটানোর বিষয়টিকে চূড়ান্ত করেছিল। এ সম্পর্কে অভ্যুত্থান প্রচেষ্টাকারীদের একজন পরবর্তীতে স্বীকারোক্তি দেয় যে, “যুদ্ধ ও অভ্যুত্থান এ দু’টোর মধ্যে কোনটা আগে শুরু হবে তা নিয়ে আলোচনা হয়। যদি অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয় তাহলে সেনাবাহিনীর ভগ্ন মনোবলের সুযোগে ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চাপিয়ে দিলে তাতে তেহরানকে সহজে কাবু করা সম্ভব হবে।” ইরানে অভ্যুত্থান ঘটানোর প্রচেষ্টা অঙ্কুরেই ধরা পড়ে যাওয়ার পর তেহরান যাতে অভ্যুত্থানকারীদের বিচারের দিকে মনযোগ না দিতে পারে সেজন্য ইরাকি বাহিনী সীমান্তের ২০টি ফ্রন্টে একযোগে হামলা চালায়। এখান থেকে প্রমাণিত হয়, আমেরিকার পাশাপাশি সাদ্দাম সরকার ও তার সহযোগী কিছু আঞ্চলিক দেশ ওই অভ্যুত্থান প্রচেষ্টায় সরাসরি জড়িত ছিল। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের নিরাপত্তা উপদেষ্টা ব্রেজিনিস্কির পরিকল্পনা অনুযায়ী অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইরাকি বাহিনী ইরানের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।#
পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ / ৩০
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।