ফেব্রুয়ারি ০৯, ২০২০ ১৫:৪৫ Asia/Dhaka

সুরা মা’উন পবিত্র কুরআনের ১০৭তম সুরা। মক্কায় অবতীর্ণ এ সুরায় রয়েছে ৭ আয়াত। এই সুরাকে সুরা দ্বীন বা সুরা তাকজিবও বলা হয়। মাউন শব্দের অর্থ যাকাত অথবা গৃহস্থালী কাজে ব্যবহৃত ছোটখাটো জিনিস।

এই সুরায় কিয়ামতকে অমান্য করার, অনাথের প্রতি কঠোরতার, দরিদ্রদের আহার করাতে রাজী না হওয়ার, লোক দেখানো উপাসনার এবং নামাযে অনীহা ও অমনোযোগী হওয়ার নিন্দার বিষয় উল্লিখিত হয়েছে। এবারে এই সুরার অনুবাদ শোনা যাক: অসীম দয়াময় ও অনন্ত করুণাময় আল্লাহর নামে

১. তুমি কি তাকে প্রত্যক্ষ করেছ যে কর্মফল দিবসকে সবসময় মিথ্যা বলে? (২) সে তো সেই যে অনাথকে রুঢ়ভাবে তাড়িয়ে দেয়, (৩) এবং সে অভাবগ্রস্তকে খাবার দানে অন্যদের উৎসাহ দেয় না। (৪) সুতরাং দুর্ভোগ সে সমস্ত নামায আদায়কারীর (৫) যারা তাদের নামায সম্বন্ধে উদাসীন, (৬) যারা লোক দেখানোর জন্য নামাজ বা অন্য কোনো ভালো কর্ম করে (৭) এবং যাকাত দানে অথবা গৃহস্থালীর প্রয়োজনীয় ছোটখাট ধার বা সাহায্য দানে বিরত থাকে।

ইসলাম ধর্ম প্রচার শুরু হওয়ার পর এক পর্যায়ে যখন মুসলমানদের সংখ্যা বেশ বাড়তে থাকে এবং পরিস্থিতি মুসলমানদের অনুকূল হয়ে উঠতে থাকে তখনই এর পাশাপাশি এমন এক অবস্থা দেখা দেয় যে তা এক ধরনের বড় বিপদ বা আপদ হয়ে ওঠে। এর কারণ একদল এটা মনে করত যে কেবল কলেমায়ে শাহাদাতাইন পাঠ এবং বাহ্যিক কিছু ইসলামী রীতি ও বেশ-ভূষা বজায় রাখলেই তাদের ঈমান রক্ষা পাবে ও এমনকি এরই সুবাদে ইহাকাল ও এমনকি পরকালের সৌভাগ্যও অর্জন করবে! কিন্তু ইসলাম হল এমন এক ধর্ম যাতে রয়েছে কিছু মূলনীতি এবং হালাম-হারাম বা করণীয় ও বর্জনীয় অনেক বিষয়। আর এসব মেনে চলা ছাড়া মুসলমানদের উন্নতি অর্জন সম্ভব নয়। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায় এতিম ও মিসকিনদের সাহায্য করা, আন্তরিক ও পবিত্র চিত্তে ইবাদত করা এবং নানা ধরনের সৎ কাজ না করে কেউ ভাল মুসলান বা বিশ্বাসী মুসলমান হতে পারে না। আর এমনই প্রেক্ষাপটে নাজিল হয় সুরা মাউন।

সুরা মাউনে সত্য অস্বীকারকারীদের কিছু বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হয়েছে। এই বৈশিষ্ট্যগুলো হচ্ছে মানুষের ঈমানহীনতা, নীচতা ও ঘৃণ্য স্বভাবের প্রকাশ। মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে এইসব আচরণ ও বৈশিষ্ট্যকে সত্য ধর্ম ও শেষ বিচারের দিনকে অস্বীকারের কুফল বলে বোঝাতে চেয়েছেন। এই বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে রয়েছে ইয়াতিমদেরকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা, ক্ষুধার্তদের খাদ্য না দেয়া, নামাজের ব্যাপারে উদাসীনতা ও লোক-দেখানো নামাজ আদায় এবং মানুষকে সহযোগিতা না করা ও এমনকি তাদেরকে দৈনন্দিন জীবনের ছোটখাট উপকরণও না দেয়া। এসবই সুরা মাউনের আলোচ্য বিষয়। এ সুরায় এভাবে কৃপণতা, স্বার্থপরতা ও কপটতার কদর্যতা তুলে ধরা হয়েছে। এইসব স্বভাবের সঙ্গে যেমন সৃষ্টিকুলের বন্ধুত্ব নেই তেম্নি নেই স্রস্টার কোনো সম্পর্ক। কৃপণ, স্বার্থপর ও কপট লোকদের মধ্যে নেই ঈমানের কোনো আলো এবং নেই কোনো দায়িত্ববোধ। এরা খোদায়ি পুরস্কারের প্রতি যেমন আগ্রহী নয় তেমনি খোদায়ি শাস্তির ভয়াবহতা সম্পর্কেও উদাসীন।  

অনেকেই মনে করেন সুরা মাউনের প্রথম তিন বাক্য নাজিল হয়েছিল আবু সুফিয়ান কিংবা আস বিন ওয়ায়েল  বা ওয়ালীদ বিন মুগীরা কিংবা আবু জাহল সম্পর্কে। একদিন এক ইয়াতিম এদের কোনো একজনের কাছে এসে সাহায্য চায়। জবাবে সে তার লাঠি দিয়ে ওই ইয়াতিমকে পিটিয়ে তাড়িয়ে দেয়।

সুরা মাউনের চতূর্থ ও পঞ্চম আয়াতে বিশেষ শ্রেণীর নামাজিদের হুঁশিয়ারি দিয়ে বলা হয়েছে, সেইসব নামাজিদের জন্য আক্ষেপ যারা মহান আল্লাহর সঙ্গে যথাযথ সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেনি। এরা নামাজের মূল দিক ও নীতির ব্যাপারে উদাসীন এবং নামাজের প্রতি কোনো গুরুত্ব দেয় না। এরা নামাজের যথাযথ সময় ও মূল দিক তো দূরের কথা নামাজের সাধারণ নিয়ম বা আদব-কায়দার প্রতিও কোনো গুরুত্ব দেয় না।

নামাজ হচ্ছে মহান আল্লাহর সঙ্গে বান্দাহ বা দাসের সবচেয়ে প্রেমময় ও আন্তরিক সম্পর্কের বন্ধন। এ জন্যই নামাজকে বলা হয় সর্বশ্রেষ্ঠ আমল বা ইবাদত। নামাজ হতে হবে প্রাণময় ও সচেতনতাপূর্ণ। আর এর চাবিকাঠি হল হৃদ্যতা ও আন্তরিকতা। কেবল দায়সারা গোছের নামাজ আদায়ে তা দেখা দেয় না। পরিপূর্ণ নামাজ মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সমাজ-জীবনের ওপর রাখে গঠনমূলক এবং শিক্ষণীয় প্রভাব।

সুরা আনকাবুতের ৪৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন, হে রাসুল!

আপনি আপনার প্রতি প্রত্যাদিষ্ট কিতাব পাঠ করুন এবং নামায কায়েম করুন। নিশ্চয়ই নামায অশ্লীল ও গর্হিত কার্য থেকে বিরত রাখে। আল্লাহর স্মরণ সর্বশ্রেষ্ঠ। আল্লাহ জানেন তোমরা যা কর।

প্রকৃত মানুষ গড়ে তোলার কাজে নামাজের ভূমিকা এত বেশি গুরুত্বপূর্ণ যে কিয়ামত বা পুনরুত্থানের দিন তথা বিচারদিবসে অন্য সব ইবাদতের আগে নামাজের খোঁজখবর নেয়া হবে। নামাজ কবুল হলে অন্য সব ইবাদতও কবুল হবে। আর নামাজ কবুল না হলে অন্য কোনো ইবাদতও কবুল হবে না। আর এ জন্যই সুরা মাউনে নামাজে উদাসীনতা ও এর নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছে। যারা নামাজের ক্ষেত্রে উদাসীন ও কেবল মানুষকে দেখানোর জন্য নামাজ পড়ে তারা এই হুঁশিয়ারির আওতাভুক্ত।  

কুরআনের দৃষ্টিতে মানুষের বিশ্বাস তার কাজে প্রভাব ফেলে। বিশ্বাস ও উদ্দেশ্য যদি পবিত্র বা একনিষ্ঠ হয় তাহলে তা তার আমলে ফুটে উঠবেই। যে মহান আল্লাহকে খুশি করার জন্য জিহাদ করে সে আল্লাহর কাছে যথাযথ পুরস্কার পাবে। আর যে দুনিয়ার স্বার্থ বা বস্তুর জন্য যুদ্ধ করে সে কেবল এ দুনিয়াতেই কিছু পেতে পারে।

ব্যক্তি ও সমাজ-জীবন যদি ছলনা ও কপটতায় ভরপুর হয়ে ওঠে তাহলে সেই ব্যক্তি ও সমাজ মহান আল্লাহ থেকে দূরে সরার পাশাপাশি ভালো স্বভাব আর গুণগুলো থেকেও দূরে সরে যাবে এবং সেখানে সব কর্মসূচীই হবে নিস্ফল। আর তাই সুরা মাউনের ৬ নম্বর আয়াতে কপটতাকে সমাজের সবচেয়ে নিকৃষ্ট আচরণ বলে ইঙ্গিত করা হয়েছে।

অন্যদের জন্য কল্যাণকর কিছু না করার বা যাকাত না দেয়ার অথবা গৃহস্থালী কাজে ব্যবহৃত ছোটখাটো জিনিস বা জরুরি প্রয়োজনে সামান্য অর্থ ধার না দেয়ার মত স্বভাবগুলোর নিন্দা করা হয়েছে সুরা মাউনের শেষ তথা সপ্তম আয়াতে। এ বিষয়কে কিয়ামত ও বিচারদিবসের প্রতি বিশ্বাস না থাকার এবং কৃপণতার লক্ষণ বলা যায়। মহানবী (সা) বলেছেন, যে এতই কৃপণ যে অন্যদের ছোটোখাটো কিছু দিতেও রাজি হয় না মহান আল্লাহ কিয়ামতের দিন তাকে দয়া করবেন না এবং তাকে তার নিজ অবস্থার ওপর ছেড়ে দিবেন। আর আল্লাহ যাকে তার নিজ অবস্থার ওপর ছেড়ে দিবেন তার অবস্থা কতইনা মন্দ ও শোচনীয় হবে! #

পার্সটুডে/আমির হুসাইন/আবু সাঈদ/০৯

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ