ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০২০ ১৮:৩৩ Asia/Dhaka

সুরা ইখলাস পবিত্র কুরআনের ১১২তম সুরা। মক্কায় নাজিল হওয়া এ সুরায় রয়েছে ৪টি বাক্য বা আয়াত।

বিন্দুর মাঝে সিন্ধুর পূর্ণতার মত মাত্র চার বাক্যে মহান আল্লাহর একত্ববাদের পরিপূর্ণ বর্ণনা তুলে ধরা হয়েছে এ সুরায়। আর এ কারণেই তাওহিদ এই সুরার আরেকটি নাম। বিধর্মীরাও স্বীকার করেন যে সংক্ষিপ্ত বাক্যে একত্ববাদের এত সুন্দর ও ব্যাপক অর্থবোধক বর্ণনা আর কোনো ঐশীগ্রন্থে নেই।   হযরত ইমাম সাদিক্ব (আ) বলেছেন: ইহুদিরা মহান আল্লাহর পরিচিতি সম্পর্কে মহানবী (সা)’র কাছে জানতে চেয়েছিল। কিন্তু মহানবী তাদেরকে কোনো জবাব না দিয়ে তিন দিন নীরব থাকেন। এ অবস্থায়  ইহুদিদের প্রশ্নের জবাব হিসেবে এ সুরা নাজিল হয়।

অন্য বর্ণনায় এসেছে, মুশরিক ও ইহুদি-খ্রিস্টানরা মহান আল্লাহর পরিচিতি সম্পর্কে মহানবীর (সা)’ কাছে জানতে চাইলে সুরা ইখলাস বা তাওহিদ নাজিল হয়। মহান আল্লাহ যে বাবা-মা ও সন্তানের মুখাপেক্ষিতার উর্ধ্বে এবং সব ধরনের সমতুল্যতা, সমকক্ষতা ও শির্ক বা অংশিবাদিতা থেকে পবিত্র তা এ সুরায় তুলে ধরা হয়েছে। শ্রেষ্ঠ সব বৈশিষ্ট্যের অধিকারী মহান আল্লাহর পূর্ণাঙ্গ বৈশিষ্ট্য তুলে ধরে সুরা ইখলাস। এবারে এই সুরার অর্থ শোনা যাক্:

অসীম দয়াময় ও অনন্ত করুণাময় আল্লাহর নামে

(১)  হে নবী আপনি বলুন, ‘তিনি আল্লাহ, অদ্বৈত, (২) আল্লাহ সদাকাঙ্ক্ষিত ও অনন্যপর তথা স্বাধীন বা অমুখাপেক্ষী; (৩) তিনি জনকও নন এবং জাতকও নন। (৪) এবং তাঁর কোন সমতুল ও সমকক্ষ নেই।’-

সুরা তাওহিদের প্রথম আয়াতের বক্তব্য থেকে বোঝা যায় মহান আল্লাহর পবিত্র সত্তার স্বরূপ উপলব্ধি করা মানুষের সীমিত চিন্তাশক্তির মাধ্যমে সম্ভব নয় যদিও বিশ্ব-জগতে মহান আল্লাহর নানা ধরনের নিদর্শন বা প্রকাশ দেখা যায়। মহান আল্লাহ সুরা ফুসসিলাতের ৫৩ নম্বর আয়াতে বলেছেন,

শিগগিরই আমি তাদেরকে আমার নিদর্শনাবলী প্রদর্শন করাব পৃথিবীর দিগন্তে বা চারদিকে এবং তাদের নিজেদের মধ্যে; ফলে তাদের কাছে ফুটে উঠবে যে, আমি তথা তাদের আল্লাহ সত্য।

আল্লাহ শব্দটি মহান আল্লাহ’র এমন এক বিশেষ নাম যার মধ্যে তাঁর সব সৌন্দর্যবোধক ও মহানত্ববোধক বা ঔজ্জ্বল্যজ্ঞাপক বৈশিষ্ট্যের সমাহার ঘটেছে। তাঁর অন্য নামগুলো সাধারণত কেবল একটি বৈশিষ্ট্যের অর্থজ্ঞাপক। যেমন, আলিম, রাজ্জাক, হাকিম, মান্নান ইত্যাদি।

পবিত্র কুরআনে আল্লাহ শব্দটি বহুবার এসেছে। মহান আল্লাহর পবিত্র নামগুলোর মধ্যে আর কোনো নামই এত বেশি বার কুরআনে উল্লেখ করা হয়নি। আল্লাহ নামটি মানুষের হৃদয়কে করে প্রোজ্জ্বল এবং তাকে দেয় শক্তি ও প্রশান্তি। এ নাম মানুষকে আলো ও প্রাণময়তার এক মহাজগতে নিমগ্ন করে।

একত্ববাদ বা এক আল্লাহর ইবাদত সব খোদায়ি ধর্মের মৌলিক বিশ্বাস। পবিত্র কুরআনে বার বার একত্ববাদের প্রসঙ্গ এসেছে। মহানবীর (সা) দাওয়াতের প্রথম বক্তব্য ও শ্লোগানই ছিল: বল, আল্লাহ ছাড়া কোনো মা'বুদ বা উপাস্য নেই যাতে সৌভাগ্য বা মুক্তি পাও। মহান আল্লাহর অস্তিত্ব নিরেট ও অবিভাজ্য এবং সব দিক থেকেই তা অসীম। সসীমতামুক্ত এই পবিত্র সত্তাই সব অস্তিত্বের উৎস।

বিশ্ব-জগতে বা অস্তিত্বের জগতে দুটি অসীম সত্তা থাকতে পারে না। কারণ একই ধরনের দু'টি অসীম ও নিরেট সত্তার কথা ভাবাই যায় না। একই বিশ্ব-জগতে দুটি সমমানের সত্তা থাকার মানেই হল তাদের কোনোটিই আর নিরেট ও অসীম নয়! (তাই মহান আল্লাহকে এক বলার মানে এও নয় যে তাঁরই মত আরও একটি সত্তার অস্তিত্ব এখন পর্যন্ত গড়ে না উঠলেও গড়ে ওঠা অসম্ভবও নয়! এ ধরনের সত্তার একাধিক অস্তিত্ব একেবারেই অসম্ভব।)

সৃষ্টি জগতের নানা বস্তুর মধ্যে সমন্বয়ও  মহান আল্লাহর একত্বের নিদর্শন। আকাশ, ভূমি, গ্রহ-নক্ষত্র, পর্বত, সাগর, অনু-পরমাণু- এইসব কিছুর মধ্যেই রয়েছে সমন্বয়। মানুষের চাহিদাগুলোর সঙ্গেও রয়েছে এসবের সঙ্গতি। আর এসবই একক ব্যবস্থাপনার নিদর্শন। বিশ্ব জগতের প্রতিটি অংশ পরস্পরের সঙ্গে মিলে এক সুশৃঙ্খল জগত হিসেবে একই ব্যবস্থাপনার কিছু বিধান মেনে চলছে। তাই এসবের মাঝে বিরাজিত ঐকতান বা একতা স্পষ্ট। আর এসবই একই স্রস্টার অস্তিত্বের সাক্ষ্য দিচ্ছে।

সৃষ্টি জগতের প্রকৃতিতে কোনো অনিয়ম নেই। এটাও মহান আল্লাহর একত্বের নিদর্শন। পবিত্র কুরআনে সুরা আম্বিয়ার ২২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে:

যদি নভোমন্ডল ও ভুমন্ডলে আল্লাহ ব্যতীত অন্যান্য উপাস্য থাকত, তবে উভয়েই তথা জমিন ও আসমান- দুই-ই ধ্বংস হয়ে যেত। একটি বইও যদি দু'জনে লিখে থাকেন সেখানে লেখার স্টাইল ও বিষয়বস্তুর বর্ণনায় পার্থক্য দেখা যায়। তাই বিশ্বজগতে যদি দুই প্রভুর ব্যবস্থাপনা থাকত তাহলে নানা প্রকৃতিতে দুই ধরনের শৃঙ্খলা, বিধান ও ব্যবস্থাপনা দেখা যেত। আল্লাহ যদি এক না হয়ে একাধিক হতেন তাহলে নবী-রাসুলরাও তা বলে যেতেন! কিন্তু তাঁরা মানুষকে একত্ববাদেরই দাওয়াত দিয়েছেন, একজন নবীও এর ব্যতিক্রম করেননি। একাধিক খোদা থাকলে তাদের প্রতিনিধি ও ফেরেশতারাও ভিন্ন ধরনের হতেন এবং মানুষের কাছে আলাদা দাওয়াত বা কর্মসূচি নিয়ে আসতেন।

সুরা তাওহিদে মহান আল্লাহ যে সব কিছুরই অমুখাপেক্ষি এবং অন্য সব কিছু যে তাঁরই মুখাপেক্ষী তা বলা হয়েছে। তিনি সব কিছুতেই পরিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ। সুরা ইখলাসের তৃতীয় ও চতুর্থ বাক্যে ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুশরিকদের ধারণা নাকচ করা হয়েছে। মহান আল্লাহর সন্তান ও পিতা-মাতার ধারণাটি পুরোপুরি অযৌক্তিক ও অবাস্তব। ইহুদিরা উজাইরকে এবং খ্রিস্টানরা হযরত ঈসাকে আল্লাহর পুত্র বলে মনে করে। ত্রিত্ববাদী খ্রিস্টানরা মনে করে তিন জন খোদা রয়েছেন। তারা হল: পিতা-প্রভু, পুত্র-প্রভু ও পবিত্র আত্মা। মক্কার মুশরিকরাও মনে করত ফেরেশতারা আল্লাহর কন্যা! মহান আল্লাহ অনস্তিত্ব থেকেই সব কিছু সৃষ্টি করতে সক্ষম! সন্তান বাবা মায়েরই উত্তরসুরি ও তাদেরই অংশ। কিন্তু আল্লাহর এমন কিছুই নেই। বস্তুগত কোনো বিষয় ও সন্তানতো দূরের কথা মহান আল্লাহ থেকে আত্মা, নিদ্রা, কল্পনা, আনন্দ,বেদনা, ভয়ের মত কিছুও বেরিয়ে আসেনি। বস্তুজগতের কোনো কিছুরই বৈশিষ্ট্য মহান আল্লাহর নেই।  

সুরা তাওহিদের শেষ আয়াতে বলা হয়েছে কোনো কিছুই মহান আল্লাহর সমতুল্য, সমকক্ষ ও অনুরূপ নয়। বৈশিষ্ট্যগত ও সত্তাগত সব দিক থেকেই তিনি তুলনাহীন ও অনন্য। তিনি সব ধরনের ত্রুটি-বিচ্যুতি হতে মুক্ত। এভাবে সুরা ইখলাস প্রাকৃতিক বা অপ্রাকৃতিক সব ধরনের কৃত্রিম খোদা ও সব ধরনের শির্ককে নাকচ করেছে। কুরআনের বক্তব্য অনুযায়ী হৃদয়গুলো কেবল আল্লাহর স্মরণেই প্রশান্ত হয়। সব প্রশংসা একমাত্র আল্লাহরই। তিনিই মুক্তিদাতা। তাই তাঁরই কাছে দিল সপে দিতে হবে এবং তারই কাছে সাহায্য চাইতে হবে।#

 

পার্সটুডে/আমির হুসাইন/আবু সাঈদ/১৮

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ