জীবনশৈলী (পর্ব-২৬): ভালো বন্ধু নির্বাচনের গুরুত্ব
জীবনকে সুন্দরভাবে সাজানোর কৌশল সংক্রান্ত ধারাবাহিক আলোচনা জীবনশৈলীতে আপনাদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। আশাকরি ভালো আছেন। গত আসরে আমরা সহনশীলতা সম্পর্কে আলোচনা করেছি। আমরা বলেছি, সব ক্ষেত্রে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য প্রয়োজন সহনশীলতা।
সহনশীলতা না থাকলে পরস্পরের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের অনুভূতি কাজ করে না। কাউকে নিজের চোখে যখন সম্মানিত মনে হয় না এবং নিজের পথটিই সঠিক বলে বিবেচনা করে সব ধরনের কাজ করে যায় মানুষ, তখনই সমাজে বড় ধরণের সমস্যা দেখা দেয়। বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে। সমাজের কিছু কৃষ্টি আছে, প্রচলিত ব্যবস্থা আছে, মানিয়ে চলার জায়গা আছে, একসঙ্গে বসবাসের দায়বদ্ধতা আছে। কিন্তু আমরা যখন একাকী সব সিদ্ধান্ত পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের ওপর চাপিয়ে দিতে চাই তখনই অসন্তোষ দেখা দেয়। আজকের আসরে আমরা ভালো বন্ধু নির্বাচনের গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করব।
কিয়ামতের দিন অনেক মানুষ এজন্য আক্ষেপ করবে যে, তারা পৃথিবীতে বন্ধু নির্বাচনে ভুল করেছিল। এসব মানুষ সেদিন তাদের আমলনামা দেখে বুঝতে পারবে বন্ধু নির্বাচনে ভুলের কারণে কত বড় ক্ষতি হয়েছে তাদের। বাংলায় একটি প্রবাদ রয়েছে সৎসঙ্গে সর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ। বন্ধু ভালো না হলে মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে সৎ পথ থেকে সরে যেতে পারে এবং ইহকাল ও পরকালে ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে। অনেকের এমন অনেক বন্ধু আছেন যারা বাহ্যত খুবই আন্তরিক কিন্তু নিজেই বিভ্রান্ত। নিজে বিভ্রান্ত হওয়ার কারণে সে তার বন্ধুকেও বিভ্রান্ত করে ফেলে এবং পরিণতিতে উভয়ই অপূরণীয় ক্ষতির শিকার হয়। অপরদিকে ভালো বন্ধু হচ্ছে একজন মানুষের অমূল্য সম্পদ যা কোনো পার্থিব সম্পদের সঙ্গে তুলনীয় নয়। ভালো বন্ধু হচ্ছে এমন এক সঙ্গী যাকে সুখে-দুঃখে সব সময় পাশে পাওয়া যায় এবং ভালো বন্ধু মন থেকে তার বন্ধুর জন্য কল্যাণ কামনা করে।
সমাজ বিজ্ঞানীদের মতে, ভালো বন্ধুরা পরস্পরকে গুরুত্ব দেয় ও সম্মান করে। এ কারণে এ ধরণের বন্ধু মানসিক প্রশান্তি, সাফল্য, আনন্দ এনে দিতে পারে। সুন্দর ও সুখী জীবনের জন্য ভালো বন্ধু জরুরি। আমিরুল মুমিনিন হজরত আলী (আ.) বলেছেন, "তারাই হচ্ছে সবচেয়ে অক্ষম মানুষ যারা বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে পারে না। আর যারা নিজের বন্ধুদেরকে হাতছাড়া করে তারা আরও বেশি অক্ষম।" বন্ধুত্ব গড়ে তোলা গুরুত্বপূর্ণ, তবে তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো বন্ধুত্ব গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন। বন্ধুত্ব গড়ার ক্ষেত্রে ব্যক্তি কী ধরণের, তা বিবেচনায় নেয়া জরুরি। অনেকের সামাজিক সম্পর্ক ভালো। তাদের বন্ধুও বেশি। তবে যারা আত্মকেন্দ্রিক তাদের বন্ধুর সংখ্যা খুবই কম। তবে মনে রাখতে হবে বেশি বন্ধু থাকাটা বড় কোনো ইতিবাচক দিক নয় বরং ভালো, সৎ, সত্যবাদী, ধার্মিক বন্ধু থাকাটা জরুরি। এ ধরণের বন্ধু থাকলে সেটা একজন ব্যক্তির জন্য ভালো পয়েন্ট হিসেবে গণ্য হয়।

মানুষের জীবনে বন্ধুদের প্রভাব অনস্বীকার্য। একজন মানুষ সহজেই তার বন্ধুর চিন্তা, চেতনা, আচার-ব্যবহার, বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে প্রভাবিত হয়। ব্যাপক প্রভাবের কারণেই বন্ধু নির্বাচনের ক্ষেত্রে সতর্কতা জরুরি। মহানবী হজরত মুহাম্মাদ (স.) বলেছেন, "মানুষ ধর্মীয় ক্ষেত্রে তার বন্ধুর মতো হয়, এ কারণে বন্ধু নির্বাচনের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে।" পবিত্র কুরআনের সুরা ফুরকানের ২৮ ও ২৯ নম্বর আয়াতে জাহান্নামিদের মধ্যে কথোপকথন তুলে ধরা হয়েছে। জাহান্নামিরা পরস্পরকে বলবে আহারে! আমি যদি ওমুক ব্যক্তিকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ না করতাম, তাহলে আজ এই পরিণতি হতো না। কারণ এই বন্ধুই আমাকে বিপথে নিয়ে গেছে।
হ্যা, কিয়ামতে এ ধরণের নানা দৃশ্য চোখে পড়বে। সেখানে অনেক মানুষকেই অতীতের কর্মকাণ্ডের জন্য আফসোস করতে শোনা যাবে। কিন্তু কিয়ামতের দিন আফসোস ও অনুশোচনা হবে নিরর্থক। সেখানে এসব করে কোনো লাভ হবে না। অসৎ ও খারাপ বন্ধু নির্বাচন করে তারা যে ক্ষতির শিকার হয়েছেন সেখানে তারা তা বুঝতে পারবেন, কিন্তু তখন এই উপলব্ধির কোনো মূল্য থাকবে না। অন্যদিকে ভালো বন্ধুরা হচ্ছেন খারাপ বন্ধুর বিপরীত। তারা ব্যক্তির জীবনে সুশীতল ও সুবাসিত বাতাসের মতো। তারা একাকীত্ব দূর করে মানুষের জন্য ইতিবাচক শক্তি ও উৎসাহ যোগায়। ভালো বন্ধু উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কমায় এবং মনোবল চাঙা করে। এমন বন্ধু পরিবেশ আনন্দময় ও আন্তরিকতাপূর্ণ করে তোলে এবং প্রতিটি মুহূর্তকে সুন্দর করে তুলতে ভূমিকা রাখে।
ভালো বন্ধুর কারণে জীবনকে অনেক সহজ মনে হয় এবং সমস্যাগুলোকে অনেক তুচ্ছ মনে হয়। সবচেয়ে কঠিন সময়ের আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে ভালো বন্ধুরা। তাদের সহমর্মিতা ও সহযোগিতা দুঃখ ও শোক ভুলিয়ে দেয়। পৃথিবীকে আরও সুন্দর মনে হয়। ভালো ও প্রকৃত বন্ধু যেকোনো সমস্যা ও বিপদে এগিয়ে আসে। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সমস্যা থেকে শুরু করে অফিসের সমস্যা সমাধানেও তাকে কাছে পাওয়া যায়। বন্ধুর কারণে অনেকের জীবনে আমূল পরিবর্তন আসে এবং বড় সাফল্য অর্জন সম্ভব হয়।
প্রতিটি মানুষের জীবনেই বন্ধুর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। বন্ধুত্ব গড়ে তোলা মানুষের জন্মগত বৈশিষ্ট্য ও মানবীয় গুণ। ইসলাম ধর্মও বন্ধুত্ব গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। তবে বন্ধু নির্বাচনের ক্ষেত্রে কিছু দিকনির্দেশনা রয়েছে ইসলামে। এই ধর্ম কিছু মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে উৎসাহিত করার পাশাপাশি কিছু মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিয়েছে।
মহানবী হজরত মুহাম্মাদ (স.) প্রশ্ন করা হয়েছিল, সবচেয়ে ভালো বন্ধু কে? রাসূলে খোদা এর জবাবে বলেছেন, সবচেয়ে ভালো বন্ধু হলো সেই ব্যক্তি যার সাক্ষাৎ আপনাকে আল্লাহর কথা মনে করিয়ে দেয়, যার কথা আপনার জ্ঞান বৃদ্ধি করে এবং যার কাজকর্ম আপনাকে কিয়ামতের কথা মনে করিয়ে দেয়। রাসূলে খোদা ও নিষ্পাপ ইমামদের মতে, ভালো বন্ধু হচ্ছে তারাই, যারা আল্লাহর কথা স্মরণ করে এবং তাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে আল্লাহর প্রিয় হওয়া। এছাড়া তারা হচ্ছেন সুবুদ্ধিসম্পন্ন, চিন্তাশীল এবং সাহসী। তারা ভালো বন্ধু নয় যারা বিশ্বাসঘাতক, অত্যাচারী এবং পরচর্চাকারী। তারা ভালো বন্ধু যারা গোপণীয়তা ও সম্মান রক্ষাকারী। ইমাম জাফর সাদিক (আ.) বলেছেন, "তিন শ্রেণীর মানুষের ব্যাপারে সতর্ক থাকুন। বিশ্বাসঘাতক, পরচর্চাকারী ও জালিম। কারণ যে ব্যক্তি আপনার স্বার্থে অন্যের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে সে একদিন আপনার সঙ্গেও বিশ্বাসঘাতকতা করবে! যে ব্যক্তি আপনার পক্ষে অবস্থান নিয়ে অন্যের অধিকার লঙ্ঘন করবে এবং অন্যায়ে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে সে শেষ পর্যন্ত আপনার ওপরও জুলুম করবে! পরচর্চাকারী আপনার কাছে এসে যেমন অন্যের কথা লাগাচ্ছে ঠিক তেমনি আপনার কথাও অন্যের কাছে গিয়ে লাগাবে।"
তাই বন্ধু নির্বাচনে আমাদের বেশ সতর্ক হতে হবে। এ জগতে যারা চরিত্রবান, দয়াবান, দেখা হলেই যারা আমাদের মহান আল্লাহর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, যারা সব সময় আমাদের দোষ না খুঁজে বরং সংশোধন করে দেয়, তাদের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্বের বন্ধন অটুট থাকুক সারাটা জীবন, এ প্রত্যাশায় শেষ করছি জীবনশৈলীর আজকের আসর।#
পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ/মো: আবুসাঈদ/ ০১