জীবনশৈলী (পর্ব-২৭): ভালো বন্ধুর বৈশিষ্ট্য
জীবনকে আরও সুন্দরভাবে সাজানোর উপায় নিয়ে ধারাবাহিক আয়োজন জীবনশৈলীতে আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। গত আসরে আমরা বলেছি প্রতিটি মানুষের জীবনেই বন্ধুর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
ইসলাম ধর্মও বন্ধুত্ব গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। তবে বন্ধু নির্বাচনের ক্ষেত্রে কিছু দিকনির্দেশনা রয়েছে ইসলামে। আজকের আসরেও আমরা বন্ধু নির্বাচন ও ভালো বন্ধুর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা করব।
সবাই ভালো বন্ধু প্রত্যাশা করে। কারণ ভালো বন্ধুর একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো সে নীতিবান হবে। অন্যের সাফল্য ও উন্নতিতে সে খুশি হবে। নিজের জন্য তার যা পছন্দ অন্যের জন্যও সেটাকে পছন্দ করবে এবং নিজের জন্য যেটাকে ক্ষতিকর ভাববে অন্যের জন্যও সেটাকে ক্ষতিকর মনে করবে। ভালো বন্ধুর আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো,সে তার নিজের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখবে এবং আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করবে না। তবে সে ভালো বন্ধু নয় যে কেবল অন্যের দোষত্রুটি খোঁজে বেড়ায়। এ ধরণের মানুষ কেবল মানুষের দুর্বল দিকগুলোর সন্ধানে থাকে। এ ধরনের মানুষ সব সময় অন্যের দোষ-ত্রুটি ধরার চেষ্টা চালায় এবং এভাবে ব্যক্তির মধ্যে আত্মবিশ্বাস ধ্বংসের মাধ্যমে হতাশা ছড়িয়ে দেয়। যারা খারাপ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী এবং অন্যায়কারী তাদের সঙ্গেও বন্ধুত্ব করতে ইসলাম ধর্ম নিষেধ করেছে। আমিরুল মুমিনিন হজরত আলী (আ.) এ প্রসঙ্গে বলেছেন, খারাপ মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্বের রশ্মি তুলনামূলক দ্রুত ছিড়ে যায়।

শয়তানপুজারি এবং আল্লাহর শত্রুর সঙ্গে বন্ধুত্ব করা যাবে না। এ ধরণের মানুষের ওপর আল্লাহ অসন্তুষ্ট। এ কারণে এ ধরনের বন্ধু মানুষকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয় এবং ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণের পথ থেকে মানুষকে দূরে সরিয়ে রাখে। বিভিন্ন ইসলামি বর্ণনায় এসেছে, ভালো বন্ধু হচ্ছে সবচেয়ে ভালো আত্মীয়। আপনি যদি বন্ধুকে যাচাই করতে চান এবং দেখতে চান ওই ব্যক্তি সত্যিই প্রকৃত বন্ধু কিনা, তাহলে খেয়াল রাখুন আপনার সুসময় ও দুঃসময়ে বন্ধুত্বের মাত্রায় পরিবর্তন ঘটে কিনা। খেয়াল করুন রেগে গেলে খারাপ কথা বলে কিনা, অপমানজনক বক্তব্য দেয় কিনা, অন্যের দুঃসময়ে সাহায্য করে কিনা। কেউ কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে সে তাকে ছেড়ে চলে যায় কিনা। হজরত আলী (আ.)-ও বন্ধুকে দুঃসময়ে পরীক্ষা করতে বলেছেন। এছাড়া সফরে গেলেও বন্ধুকে চেনা যায়। সফরে গেলে মানুষকে সুখকর ও কঠিন দুই পরিস্থিতিরই সম্মুখীন হতে হয়। সফরে নিস্বার্থপরতা ও স্বার্থপরতার বিষয়টি স্পষ্ট হয়। মনে রাখতে হবে ভালো বন্ধু কখনোই মিথ্যা বলে না এবং কখনোই প্রতারণা করে না। প্রতারণা ও মিথ্যাচারিতা খুব দ্রুত বন্ধুত্বের বন্ধনকে নষ্ট করে দেয়।
আহলে বাইতের ইমাম জাফর সাদিক (আ.) বন্ধুত্ব করার ক্ষেত্রে কিছু বৈশিষ্ট্যকে গুরুত্বের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করতে বলেছেন। এই বৈশিষ্ট্যগুলো হলো: এক- ব্যক্তির গোপন ও প্রকাশ্য দিকগুলোর মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকা যাবে না। দুই- সে আপনার সম্মান-মর্যাদাকে নিজের সম্মান-মর্যাদা বলে মনে করবে এবং আপনার অপমান ও অপদস্থ হওয়াকে নিজের অপমান বলে মনে করবে। তিন- অর্থ-সম্পদ ও পদমর্যাদা তার আচরণ ও স্পৃহায় পরিবর্তন আনবে না। চার- তার সামর্থ্য মধ্যে থাকলে আপনার উপকার করা থেকে বিরত থাকবে না। পাঁচ- দুঃসময়ে আপনাকে ছেড়ে যাবে না। ইমাম জাফর সাদিক (আ.)'র মতে, কারো মধ্যে যদি এই সবগুলো বৈশিষ্ট্য পাওয়া না যায় তাহলে তাকে 'পরিপূর্ণ বন্ধু' হিসেবে গণ্য করা যাবে না। আর যদি বৈশিষ্ট্যগুলোর কোনোটিই তার মধ্যে না থাকে তাহলে কখনোই তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করা ঠিক হবে না। অবশ্য এই বৈশিষ্ট্যগুলো কিছুটা আপেক্ষিক। হয়তো এমনও হতে পারে সবগুলো গুণ সর্বোত্তম ভাবে একজন বন্ধুর মধ্যে নেই। কিন্তু অনেক গুণই রয়েছে যেগুলো প্রশংসনীয়। এ অবস্থায় ওই বন্ধুকে সর্বোত্তম পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে হবে।
যিনি সর্বোত্তম বৈশিষ্ট্যের বন্ধু খুজছেন তাকেও সর্বোত্তম বন্ধু হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। নিজের গুণের আলোয় তাকে আলোকিত করার চেষ্টা করতে হবে। বন্ধুকে সংশোধন করতে নিজেকে আন্তরিক ও আস্থাপূর্ণ মানুষ হিসেবে প্রমাণ করতে হবে। বন্ধুকে অত্যন্ত সুন্দর ও ভদ্র ভাবে তার ঘাটতিগুলো স্মরণ করিয়ে দিতে হবে এবং তাকে বুঝাতে হবে আপনি তার মঙ্গল চান, আপনি তার ভালোর জন্যই পরামর্শ দিচ্ছেন। ভালো বন্ধুর একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো বন্ধুর দোষ-ত্রুটি অন্যের সামনে ঢেকে রেখে তাকে সংশোধ করার চেষ্টা চালানো। আসলে সুন্দরভাবে জীবনযাপন করতে সত্যিকারের বন্ধুর বিকল্প নেই। সত্যিকারের বন্ধুই মানুষের গোটা জীবনকে উপভোগ্য করে তোলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মানুষের বেঁচে থাকার ইচ্ছেশক্তি বাড়িয়ে দেয় একজন ভালো বন্ধু। ভালো বন্ধু আস্থার জায়গা হিসেবে গণ্য হয়। সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, হতাশা, ভালো লাগা, মন্দ লাগা তার সঙ্গে ভাগাভাগি করা যায়। মন খুলে কথা বলা যায়।
যার ভালো বন্ধুর সংখ্যা বেশি সে তত বেশি সুখী এবং তার জীবন তত বেশি সহজ। তবে সত্যিকারের বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে পারাটাও এক ধরণের যোগ্যতা। তবে তাদের সঙ্গেই বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে হবে যারা সৎ ও ভালো। যাদের কথা,কাজ ও আচার-আচারণ আপনাকে সৎ পথে চলতে সহযোগিতা করবে। ভালো স্বভাব-চরিত্রের মানুষকে বন্ধু হিসেবে পাওয়া এবং তাদের সান্নিধ্য লাভ করতে পারাটা বড় ধরণের সৌভাগ্য। কারণ তারা সুন্দর কথা বলেন,তাদের চারিত্রিক মাধুর্য্য মানুষকে আকৃষ্ট করে,তাদের কাজ অন্যকে জীবন সম্পর্কে আশাবাদী করে তোলে। আপনি যে বন্ধুর সঙ্গে চলছেন সে ভালো না খারাপ তা নির্ণয় করার সুযোগ আপনার কাছেই রয়েছে। অত্যন্ত সহজভাবে বলা যায়, কারো সঙ্গে চলার পর যদি ভালো গুণ আপনার ভেতরে আসতে থাকে,তাহলে মনে করতে হবে সে আপনার ভালো বন্ধু। অন্যদিকে যদি খারাপ কিছু আসতে থাকে,তাহলে যত দ্রুত সম্ভব সেই বন্ধু ত্যাগ করে ভালো বন্ধু খুঁজে বের করাই বুদ্ধিমানের কাজ।
আমরা সবাই ভালো বন্ধু পেতে সক্ষম হব এবং নিজেরাও সে ধরণের বন্ধু হয়ে উঠব-এ প্রত্যাশায় শেষ করছি আজকের আসর।#
পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ/মো: আবুসাঈদ/ ১৬
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।