জীবনশৈলী (পর্ব-৩১): নিস্বার্থভাবে পরোপকার করে খোঁটা না দেয়া ইসলামি নির্দেশনা
গত আসরে আমরা বলেছি পরোপকার নির্দিষ্ট কোনো সীমারেখায় আবদ্ধ নয়। নানা উপায়ে পরোপকার করা যেতে পারে। পরোপকার করা যেতে পারে ধর্মীয়, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যাপারেও। শারীরিক, আর্থিক ও মানসিক কর্মকাণ্ডেও অন্যকে সহযোগিতা করা যেতে পারে। সমাজে নানা রকমের মানুষের বসবাস, তাদের জীবনে রয়েছে নানা সমস্যা। তাদের সেই সমস্যা নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়াও পরোপকার। আজকের আসরে আমরা নিস্বার্থভাবে পরোপকার করা এবং খোঁটা না দেওয়ার ইসলামি নির্দেশনা সম্পর্কে আলোচনা করব।
পরোপকার করা এবং সাহায্য-সহযোগিতা প্রদানের প্রবণতা সব সমাজেই কম-বেশি প্রচলিত। সবার কাছেই তা সমাদৃত। ইসলাম ধর্ম বারবারই এসব বৈশিষ্ট্য ধারণের জন্য সবাইকে উৎসাহ দিয়ে এসেছে। এর পাশাপাশি পরোপকার তথা অন্যকে সাহায্য-সহযোগিতা করে খোঁটা দিতে নিষেধ করা হয়েছে। খোঁটা দেওয়া বলতে আসলে কী বুঝায়? আপনি কাউকে দান করে, ঋণ দিয়ে অথবা কোন উপকার করে যদি তাকে বলেন, তোমার কি মনে নেই আমি তোমাকে দান করেছিলাম, তোমার এই কাজ করে দিয়েছিলাম, তোমার সেই উপকার করেছিলাম? এটাকে খোঁটা দেওয়া বলা হয়। এর মাধ্যমে মানুষের দান-সদকা বা উপকার করার সওয়াব নষ্ট হয়ে যায়। কেউ যদি উপকৃত হওয়ার পর উপকারকারীর সঙ্গে খারাপ আচরণ করে বা তার ক্ষতি করে তাহলে এ জন্য সে গুনাহগার হবে। কিন্তু যিনি উপকার করলেন তার কখনই এ জন্য খোঁটা দেওয়া উচিৎ নয়।
ইসলাম ধর্মের সামাজিক বিষয়ক নির্দেশনার অংশ হচ্ছে পরোপকার। এই পরোপকারের সর্বোত্তম ধরণ হলো খোঁটা না দেওয়া। পবিত্র কুরআনের সুরা বাকারার ২৬৪ আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, 'হে মুমিনগণ! খোঁটা দিয়ে ও কষ্ট দিয়ে নিজেদের দান-সদকাকে নষ্ট করো না।' পরোপকার করে অথবা দান-সদকা দিয়ে তা নিয়ে অহঙ্কার করতে নিষেধ করা হয়েছে বরং ইসলাম ধর্ম উপকার করার পর তা গোপন রাখাকে বেশি পছন্দ করে। যদি উপকার করা সংক্রান্ত কোনো তথ্য প্রকাশ করার পেছনে অন্যকে ভালো কাজে উৎসাহিত করার উদ্দেশ্য থাকে তাহলে তা ভিন্ন কথা। তবে কারো উপকার শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই করা উচিত, পার্থিব স্বার্থে নয়। কখনো এটা ভাবা উচিত নয় যে, যার উপকার করা হচ্ছে সেই ব্যক্তি পরবর্তীতে উপকার করার সক্ষমতা রাখে কিনা অথবা যার উপকার করা হলো তার পক্ষ থেকে কী ধরনের আচরণ আসতে পারে। এ ক্ষেত্রে খোঁটা দেওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না। কারণ কেবল তারাই খোঁটা দিতে পারে, যারা পার্থিব প্রাপ্তির আশায় উপকার করে। এ ধরণের ব্যক্তিরা যখন তার আশানুরূপ ফল পায় না, তখন হতাশায় ভেঙে পড়ে। উপকার করে ভুল করেছি-এ ধরণের কথা বলতে থাকে। কিন্তু একজন মুমিন ব্যক্তি উপকারের প্রতিদান পাওয়ার বিষয়ে নিশ্চিত।
এক ঐতিহাসিক বর্ণনায় এসেছে, মুসলমানদের একটি কাফেলা একবার মক্কার দিকে যাচ্ছিল। মদিনা ও মক্কার মাঝামাঝি একটি স্থানে কাফেলা কয়েক দিনের জন্য থামে। সেখানে তারা বিশ্রাম নেয়। এ সময় ওই কাফেলায় যোগ দেয় আরেক ব্যক্তি। তিনিও মক্কায় যাবেন। ওই লোক কাফেলায় যোগ দেওয়ার পর এক ধার্মিক ব্যক্তিকে দেখে বিস্মিত হলেন। প্রথমে তিনি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না, ওই ধার্মিক ব্যক্তি সবার সেবা করছেন, স্বতস্ফুর্তভাবে নানা কাজ সম্পন্ন করে দিচ্ছেন। এরপর তিনি একটু দূর থেকে ধার্মিক ওই ব্যক্তিকে দেখিয়ে কাফেলার অন্য এক লোককে জিজ্ঞেস করলেন, ওই যে লোকটি আপনাদের সেবা করছেন তাকে কি আপনারা চেনেন? কাফেলার লোকটি বলল, না, তাকেতো আমরা চিনি না। তিনি মদিনায় আমাদের কাফেলার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। তিনি খুবই ধার্মিক ও মুক্তাকি। আমরা তাকে কাজ করতে বলিনি, তিনি নিজে থেকেই আমাদের জন্য কাজ করার এবং আমাদেরকে সহযোগিতার প্রস্তাব দেন। নতুনকরে কাফেলায় যোগ দেওয়া ব্যক্তি এসব কথা শুনে বলেন, বুঝাই যাচ্ছে আপনারা উনাকে চেনেন না। উনাকে চিনলে আপনারা কখনোই উনাকে আপনাদের কাজ করতে দিতেন না। তিনি হলেন ইমাম জয়নুল আবেদিন (আ.)।
অন্যরাও এ কথা জানতে পারলেন। সবার মধ্যে এক ধরণের অপরাধবোধ জন্ম নিল। তারা দ্রুত ইমাম হোসেন (আ.)'র সন্তান ইমাম জয়নুল আবেদিন (আ.)'র কাছে গেলেন ক্ষমা চাইতে। কাফেলার সব লোক ইমামের কাছে গিয়ে বললেন, আপনি যদি আমাদেরকে নিজের পরিচয় দিতেন তাহলে কতই না ভালো হতো। আমরাতো আপনার সঙ্গে বেয়াদবি করে বড় ধরণের পাপও করে ফেলতে পারতাম!
ইমাম জয়নুল আবেদিন এসব কথা শুনে বলেন, আমি ইচ্ছাকৃতভাবে আপনাদের কাফেলায় যোগ দিয়েছি কারণ আপনারা আমাকে চিনতেন না। কারণ আমি মাঝে মধ্যেই এমন সব ব্যক্তির সঙ্গে সফর করি যারা আমাকে চেনেন। মহানবী (স.)'র আত্মীয় হওয়ার কারণে তারা আমার সঙ্গে সদাচরণ করেন এবং আদর-আপ্যায়ন করেন। তারা আমাকে কোনো কাজ বা সেবাই করতে দেন না। এ কারণে আমি এমন সফরসঙ্গী বেছে নিয়েছিলাম যারা আমাকে চেনেন না। আমি সফরসঙ্গীদের সেবা করে কল্যাণের অংশীদার হতে চেয়েছিলাম।
ইসলামের ইতিহাসে এমন অনেক ঘটনাই রয়েছে যেখানে এটা স্পষ্ট যে, প্রকৃত ধার্মিক ব্যক্তিরা অন্যের উপকার করার জন্য সব সময় সচেষ্ট ছিলেন এবং তারা উপকার করার পর খোঁটা দেওয়াতো দূরের কথা বরং তা গোপন করার চেষ্টা করতেন। আসুন আমরা সবাই পরোপকারী হই ও পরের বিপদে পাশে দাঁড়াই এবং পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে সুন্দর ও উন্নত সমাজ তথা পৃথিবী গড়ে তুলি। সবার জন্য রইলো শুভকামনা।#
পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ/মো: আবুসাঈদ/ ১৮
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।