লাদাখ ইস্যু: ‘ওয়ান মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন- বাংলাদেশের অবস্থান কি হবে?’
লাদাখে’র গালওয়ান উপত্যকায় ভারত-চীনের মধ্যে সংঘর্ষে সেনা হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। তার জেরে উত্তপ্ত পরিস্থিতি বিরাজ করছে। মুখোমুখি চীন-ভারত। তবে সম্প্রতি ১১ ঘন্টা ম্যারাথন বৈঠক হয়েছে। তো গালওয়ানে’র আগামী পরিস্থিতি আরও বড় যুদ্ধের দিকে যাবে কি না?
এ বিষয়ে রেডিও তেহরানকে দেওয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে সিনিয়র সাংবাদিক- দৈনিক মানবজমিন পত্রিকার প্রধান সম্পাদক এবং রাজনৈতিক ভাষ্যকার মতিউর রহমান চৌধুরী বলেছেন, উত্তেজনা থাকবে। যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব থাকবে। তবে ভারত-চীন কেউই এখন যুদ্ধের দিকে যাবে না। কেউই প্রস্তুত নয়।
বিশিষ্ট এ সাংবাদিক বলেন, বিশ্ব ঐ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত না। আমেরিকা চাপের মধ্যে আছে। তাছাড়া চীনও বিশ্বে চাপের মধ্যে আছে। ভারতের সাথে প্রতিবেশী দেশগুলোর সম্পর্ক সুখকর নয়। দেশ দুটির পরস্পরকে প্রয়োজন আছে। ফলে যুদ্ধ হবে বলে আমার মনে হয় না। তবে এ অবস্থায় বাংলাদেশের অবস্থান কি হবে সেটি ‘ওয়ান মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন!’ বাংলাদেশ চরম অবস্থার মধ্যে আছে। বাংলাদেশ নিরপেক্ষ থাকবে। সেটিও কি সম্ভব? সময় বলে দেবে; এখন বলা খুবই মুশকিল।
সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো। এটি গ্রহণ ও উপস্থাপনা করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।
রেডিও তেহরান: জনাব মতিউর রহমান চৌধুরী, লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় সম্প্রতি ভারত ও চীনের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। ঐ সংঘর্ষে দেশ দুটির বেশ কিছু সংখ্যাক সেনা হতাহত হয়েছে। সেখানকার পরিস্থিতি উত্তপ্ত যদিও আলোচনা চলছে। তো পরিস্থিতি কি বড় কোনো যুদ্ধের দিকে যাবে; আপনার কি মনে হয়?
মতিউর রহমান চৌধুরী: আমার তা মনে হয় না যে ভারত-চীন উত্তেজনা এবং বর্তমান সংঘর্ষের পর তা বড় কোনো যুদ্ধের দিকে যাবে। কারণ দুটো দেশের কেউই এখনই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত না। দীর্ঘদিন থেকেই লাদাখ সীমান্তে একটা উত্তেজনা ছিল। তারই একটা বহিঃপ্রকাশ আমরা সম্প্রতি দেখলাম। তবে আপনি যে বড় কোনো যুদ্ধের দিকে যাবে কিনা জানতে চাইলেন- আমার কেন জানি মনে হয় সেই যুদ্ধ করার মত অবস্থা নেই। আর পৃথিবী এই মুহূর্তে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত না। দুটো দেশই জানে যুদ্ধে গেলে পরিণতি কি হবে! আর ভারত বর্তমানে যে পরিস্থিতিতে আছে তাতে এই মুহূর্তে যুদ্ধে যাবে বলে আমার মনে হয় না। এর কারণ হিসেবে আমি বলব, ভারতের নিকটতম প্রতিবেশী কোনো দেশের সাথে তাদের সম্পর্ক সুখকর নয়। অন্যদিকে চীনও বর্তমানে বিশ্বব্যাপী চাপের মধ্যে আছে। ফলে এই মুহূর্তে একটা যুদ্ধের ঝুঁকি চীন নেবে না। এইরকম যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব থাকবে তবে যুদ্ধ হবে না। ভারতকে বাদ দিয়ে চীন এগোতে পারবে না। কারণ ভারতে চীনের বিশাল মার্কেট। অন্যদিকে ভারতও –চীনকে হাতছাড়া করবে না যুদ্ধে গিয়ে। কারণ ভারতের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় চীনের সহযোগিতা জরুরি।
রেডিও তেহরান: জনাব মতিউর রহমান চৌধুরী, সংঘর্ষের পর গালওয়ানে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি বিরাজ করছে। ভারতও অনমনীয় অবস্থানে রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি চীনকে কড়া বার্তায় বলেছেন, সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে কোনো ছাড় নয়। তার দেশের সেনাদের বলিদান ব্যর্থ হবে না। আরও অনেক কথা বলেছেন। তো এসব বক্তব্যকে আপনি কিভাবে দেখছেন, এসব কথা কি শুধু রাজনৈতিক..?
মতিউর রহমান চৌধুরী: দেখুন, এটা খুবই স্বাভাবিক। তার দেশের জনগণকে তো একথা বলতে হবে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তো আর আত্মসমর্পন করে বসে থাকতে পারবেন না। তাঁকে এসব কথা বলতেই হবে। তাঁর সামনে একটা যুদ্ধ পরিস্থিতি। উনি যদি এখন সাধারণ কথাবার্তা বলেন বা এধরণের কথা না বলেন তাহলে আত্মসমর্পনই হয়ে যাবে। তবে হ্যাঁ প্রস্তুতি থাকবে। দুদেশেরই প্রস্তুতি আছে। কিন্তু আমার মনে হয় বিশ্ব পরিস্থিতিতে যুদ্ধ হওয়ার মতো অবস্থা নেই। আর এই মুহূর্তে যুদ্ধ হলে কে লাভবান হবে? প্রতিটি যুদ্ধের একটা 'কি' থাকে। কোনো দেশই এখন যুদ্ধের জন্য ঝাপিয়ে পড়বে না। আমেরিকাও এখন খুব চাপের মধ্যে আছে। মার্কিন প্রশাসন এই মুহূর্তে কোনো যুদ্ধের ঝুঁকিতে যাবে বলে আমার অন্তত মনে হয় না। আমি জানি না; আমি ভুল হতে পারি। কারণ অনেক সময় অঙ্কের হিসেবে মেলে না। এরইমধ্যে গালওয়ানে যে ঘটনা ঘটে গেল; করোনাকালীন সময়ে আমরা তো এমনটি ভাবতে পরিনি। তারপরও যেসব তথ্য ও রিপোর্ট আসছে তাতে আমার মনে হয় আলোচনার একটা পরিবেশ আছে এবং আলোচনা হতে পারে।
রেডিও তেহরান: জ্বি, আপনি প্রতিবেশী দেশগুলোর কথা বলছিলেন। তো নেপাল-ভারত সীমান্তের মানচিত্র নিয়েও কিন্তু ভারতের সাথে একটা টানাপোড়েন চলছে। নেপালের সংসদের ভারতের তিনটি অঞ্চলকে নিয়ে সর্বসম্মতিক্রমে মানচিত্র সংশোধনী বিল পাস হয়েছে। এ বিষয়ে কী বলবেন?
মতিউর রহমান চৌধুরী: আপনি জানেন যে, নেপালের সাথে চীনের একটা সীমান্ত আছে এবং চীনের সঙ্গে নেপালের সম্পর্কও অনেক ভালো। চীন-নেপালের ভালো সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে ভারতের সঙ্গে নেপালের সম্পর্কের নানা বিষয়ে অবনতি হয়েছে। নেপালের মানচিত্রে ভারতীয় ভূখণ্ড দেখিয়েছে। সর্বশেষ নেপালি পার্লামেন্টে মানচিত্র সংশোধনী বিলও পাস হয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে ভারতের সামনে নতুন একটা মানচিত্র তৈরি হয়েছে। ভারত তার সামনে দেখছে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক নেই। শ্রীলঙ্কার সাথেও ভালো সম্পর্ক হবে না। নেপালের সঙ্গে একটা ক্ষুব্ধ পরিস্থিতি। পাকিস্তানের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক নেই দীর্ঘকাল থেকে। ফলে সাউথ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখাটাও ভারতের জন্য খুবই জরুরি। যদি আমাকে প্রশ্ন করেন বাংলাদেশের বিষয়টি কি হবে?
রেডিও তেহরান: জ্বি, জনাব মতিউর রহমান চৌধুরী, বাংলাদেশ সম্পর্কেই জানতে চাইব। বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতীম ও নিকটতম প্রতিবেশী ভারত। অন্যদিকে চীনের সঙ্গেও বহুবিধ সম্পর্ক রয়েছে। তো যদি যুদ্ধ বাধে তাহলে বাংলাদেশের অবস্থানটা কি হবে?
মতিউর রহমান চৌধুরী: দেখুন, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যেটা বলেছেন, যে আমরা নিরপেক্ষ থাকব। তবে নিরপেক্ষ থাকার সুযোগ খুবই কম এক্ষেত্রে। এটি মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন যে বাংলাদেশ কি করবে? তবে এই মুহূর্তে অঙ্ক মেলানো যাবে না। কারণ চীনকে ছাড়া বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়া থেমে যাবে। অন্যদিকে ভারতের সাথে সম্পর্কের অবনতি ঘটার ঝুঁকিটাও বাংলাদেশ নিতে পারবে না। ফলে আমরা একটা চরম অবস্থার মধ্যে আছি। তবে যাতে এরইরকম পরিস্থিতি না হয় সে চেষ্টা চলবে। যদি হয় তাহলে আমরা বিপদে পড়ে যাব। কারণ আমাদের অর্থনীতি সচল রাখতে হলে চীনকে এই মুহূর্তে আমাদের পাশে থাকাটা অত্যন্ত জরুরি।
আবার ভারতকে ছাড়াও বাংলাদেশের নানাবিধ সংকট হবে। সবমিলিয়ে এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ কি সিদ্ধান্ত নেবে সেটা আমার পক্ষে বলা খুব কঠিন। আমি মনে করি পরিস্থিতি বুঝে সময়মতো বাংলাদেশ সিদ্ধান্ত নেবে। এই মুহূর্তে কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না। কারণ এরইমধ্য বাংলাদেশ সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, আমরা দুই দেশের মধ্যে আলোচনা চাই। জাতিসংঘের যে ভূমিকা সেই ভূমিকায় বাংলাদেশ থাকবে বলে আমি মনে করি।#
পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/২৩