স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতি নিয়ে সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা যেমনটি বললেন
সাহেদ কিংবা সাবরিনা কাণ্ড প্রমাণ করে আমাদের সিস্টেম ঘুণপোকায় খেয়ে ফেলেছে।বাংলাদেশে করোনাকালে স্বাস্থ্যখাতে অনিয়ম দুর্নীতি নিয়ে রেডিও তেহরানকে দেয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে বিশিষ্ট সাংবাদিক, জিটিভির এডিটর ইন চীফ সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা একথা বলেছেন।
তিনি বলেন, স্বাস্থ্যখাতের অন্যান্য বেহাল দশার সাথে সাথে এর প্রশাসনিক দুর্বলতার বিষয়টিও স্পষ্ট হলো। লাইসেন্সবিহীন রিজেন্ট হাসপাতালের সাথে করোনা টেস্টের চুক্তির বিষয়টি বড় অবক্ষয়।
বিশিষ্ট এ সাংবাদিক বলেন,স্বাস্থ্য খাতে অপরাধ ও দুর্নীতি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয় পরস্পরকে দূষছেন। এটি দুঃখজনক। আসলে এটা সামগ্রিকভাবে আমাদের সকলের ব্যর্থতা। আর সেটা স্বীকার করে নেয়াটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় কাজ। কিন্তু সেটি হয় নি। ইশতিয়াক রেজা বলেন, স্বাস্থ্যখাতের দুর্নীতি এবং অনিয়মের দায় কোনোভাবেই সরকার এড়াতে পারে না।
পুরো সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো। এটি গ্রহণ ও উপস্থাপনা করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।
রেডিও তেহরান: জনাব ইশতিয়াক রেজা, সম্প্রতি বাংলাদেশে রিজেন্ট হাসপাতালের নানা অনিয়ম এবং দুর্নীতির চিত্র বেরিয়ে এসেছে। এই অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে হাসপাতালের মালিক সাহেদ করিম বা সাহেদকে শেষ পর্যন্ত গ্রেফতার করা হয়েছে। তাকে ১০ দিনের রিমাণ্ডে নেয়া হয়েছে। সরকার দাবি করছে এটি তাদের দুর্নীতি বিরোধী অভিযানের বড় সফলতা। আর সমালোচকরা বলছেন সরকারই পুষেছে শাহেদ আলমদেরকে। আপনি কি বলবেন?
ইশতিয়াক রেজা: দেখুন, প্রথমে আমি সাহেদকে গ্রেফতারে বাংলাদেশের এলিট ফোর্স র্যাবকে অভিনন্দন জানাই। একইসাথে আমাদের মনে বেশ কিছু প্রশ্নের উদ্রেক করে। প্রথম প্রশ্ন যেটি আসে সেটি হচ্ছে রিজেন্ট হাসপাতাল করোনা নিয়ে এতবড় একটা দুর্নীতি করতে পারল! ২০১৪ সাল থেকে এই হাসপাতালটি চলছে লাইসেন্সবিহীন অবস্থায় অথচ এটা দেখার কেউ ছিল না! সুতরাং আমাদের স্বাস্থ্যখাতের অন্যান্য যে বেহাল দশা আছে তার সাথে সেখানে যে প্রশাসনিক দুর্বলতা আছে সেটাও এখন প্রমাণ হলো। স্বাস্থ্য প্রশাসন থেকে রিজেন্ট হাসপাতালের দুর্নীতির ব্যাপারে দেখার কেউ ছিল না সেটা স্পষ্ট হয়ে গেল। অথবা অন্যভাবে বলা যায় দেখেও বিষয়টি অবজ্ঞা করা হয়েছে।
দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে, করোনাভাইরাসের মতো এমন একটা অত্যন্ত স্পর্শকাতর এবং ঝুকিপূর্ণ বিষয়ে রিজেন্টের মতো হাসপাতালের সাথে চুক্তি করাটা আরেকটা বড় ধরণের অবক্ষয় বলতে পারি। এই ধরণের একটি প্রতিষ্ঠানকে বাছাই করার আগে তো অনেক ধরণের চিন্তা-ভাবনা করা উচিত ছিল। অনেক ধরণের তথ্য ও খোঁজ-খবর নেয়া উচিত ছিল। সাহেদ নামের ঐ ব্যক্তির ট্র্যাক রেকর্ড খোঁজার প্রয়োজন ছিল। দেশে এত ভালো ভালো ব্যক্তি খাতের হাসপাতাল থাকতে কেন রিজেন্টকে বাছাই করা হলো এই প্রশ্নের উত্তর আমরা আজও পাচ্ছি না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একটি হাসপাতাল শাখা আছে যাদের কাজই হচ্ছে পরিদর্শন করা, নজরদারি করা এবং রিপোর্ট দেয়া।
তারা যে এই কাজটি করেছে তা আমরা বিশ্বাস করতে পারি না। এখন আবার দুঃখজনকভাবে যেটা চলছে সেটি হচ্ছে- মন্ত্রণালয় বলছে অধিদপ্তর দায়ী আর অধিদপ্তর দোষ চাপাচ্ছে মন্ত্রণালয়ের উপর। আসলে এটা সামগ্রিকভাবে আমাদের সকলের ব্যর্থতা। আর সেটা স্বীকার করে নেয়াটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় কাজ। অথচ সেটি হয় নি। জেকেজির ক্ষেত্রেও কিন্তু একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে। অর্থাৎ এখানে দুর্নীতি হয়েছে, দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয়া হয়েছে এবং দুর্নীতিকে দেখেও না দেখার একটা প্রচেষ্টা হয়েছে। আর তারই ফলাফল হচ্ছে- ভুয়া করোনা রিপোর্ট, সাহেদ কাণ্ড, জেকেজি কাণ্ড ইত্যাদি। এখানে আমাদের একটি বিষয় মনে রাখতে হবে সেটি হচ্ছে- আমরা শুধুমাত্র সাহেদকে যদি মনে করি সে বড় ধরনের দুর্নীতি করেছে সেটা ভুল হবে। সাহেদ অবশ্যই দুর্নীতিবাজ এবং প্রতারক। কিন্তু আমাদের যে সিস্টেম সেটি যে ঘুণপোকায় খেয়ে ফেলেছে সেটাকে মানতেই হবে।
রেডিও তেহরান: জনাব ইশতিয়াক রেজা, আপনি চমৎকারে আমাদের সিস্টেমের দুর্বলতার কথা বললেন। তো নিশ্চয়ই আপনার চোখেও পড়েছে। সম্প্রতি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অফ বাংলাদেশ বা টিআইবি বলেছে, রিজেন্ট হাসপাতালের অনিয়ম এবং দুর্নীতি বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির সামান্য একটি অংশ। যেকথাটি আপনিও বলতে চাইলেন। তো টিআইবির ঐ বক্তব্য কতটা বাস্তবসম্মত?
ইশতিয়াক রেজা: টিআইবির যে রিপোর্টের কথা বললেন সেটি বাস্তবসম্মত। সমাজ পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা হিসেবে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল যেটি বলেছে সেটিকে গুরুত্ব দিয়ে দ্রুত আমলে নেয়া সরকারের উচিত বলে আমি মনে করি। স্বাস্থ্য খাতের সুশাসনের দিকে নজর দেয়ার খুবই জরুরি।
রেডিও তেহরান: জনাব ইশতিয়াক রেজা, দেশের স্বাস্থ্যখাত হচ্ছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং মৌলিক বিষয়। এ বিষয়টি আমরা সবাই জানি এবং আপনারা প্রায়ই বিষয়টি নিয়ে কথা বলে থাকেন। তো গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্যখাতে যদি দুর্নীতি দানা বাঁধে তাহলে বৃহত্তর অর্থে দেশ এবং সমাজ ভয়াবহ ঝুঁকির মুখে পড়ে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতকে কিভাবে দুর্নীতিমুক্ত করা সম্ভব বলে আপনার মনে হয়?-বা আপনার পরামর্শ..
ইশতিয়াক রেজা: স্বাস্থ্যখাতকে দুর্নীতিমুক্ত করার ক্ষেত্রে আমার প্রথম পরামর্শ হচ্ছে- এ খাতকে মানুষের প্রেক্ষাপট থেকে বিবেচনা করতে হবে। মানুষ কি চায় সেটা দেখতে হবে। আমরা কিন্তু কাঠামো তৈরি করেছি। আমরা অনেক ভবন তৈরি করেছি কিন্তু আমরা স্বাস্থ্য সেবা দিতে পরি নি। সেবার মনোবৃত্তি ফিরিয়ে আনতে হবে। এখানে চিকিৎসকদের বড় ভূমিকা আছে। ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে এবং ডায়গনস্টিক সেন্টার থেকে কমিশন খাওয়া তাদের বন্ধ করতে হবে। এই খাতে যে দুর্নীতি হচ্ছে স্বজনপ্রীতি হচ্ছে এবং বড় বড় প্রকল্পে বড় ধরনের অনিয়ম হচ্ছে সেদিকে সরকারের নজরদারি বাড়াতে হবে। কঠোর নজরদারিতে আনতে হবে।
রেডিও তেহরান: জনাব রেজা, বাংলাদেশের অনেক মানুষের মনেই এই প্রশ্ন আছে যে, দুর্নীতি যারা করে তারা মূলত সমাজের ক্ষমতাধর ব্যক্তি এবং অর্থবিত্তের মালিক। এরপরও কেন তারা দুর্নীতির মাধ্যমে সমাজের ক্ষতি করে? এর মনস্তাত্ত্বিক দিকটা কি আসলে?
ইশতিয়াক রেজা: আপনি ঠিকই বলেছেন, আমাদের এখানে যারা দুর্নীতি করে তারা ক্ষমতাকে ব্যবহার করে। ক্ষমতার কাঠামোর মধ্যে তাদের একটা নিজস্ব বিচরণ থাকে। অথবা ক্ষমতার কাঠামোতে বিচরণকারীদের সাথে সখ্যতা থাকে। এটি একটি দিক। আরেকটি বিষয় হচ্ছে আইনের শাসন। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এখানে যেহেতু বিচার হয় খুব কম। দুর্নীতি করলে বড় ধরনের সাজা হয় না। ফলে দুর্নীতিবাজদের ভয়টা কেটে গেছে। আর ভয় না থাকার কারণেও কিন্তু দুর্নীতি অনেক ক্ষেত্রে উৎসাহিত হচ্ছে।
রেডিও তেহরান: জনাব ইশতিয়ারক রেজা, সবশেষে আপনার কাছে আমরা জানতে চাইব, শুধু স্বাস্থ্যখাত নয় -আপনি এর আগেও বাংলাদেশের গোটা সিস্টেমের দুর্বলতার কথা বলছিলেন। তো গোটা সিস্টেমের দুর্বলতার দায় বা যেসব ঘটনা ঘটছে তার দায় সরকার এড়াতে পারে কি না?
ইশতিয়াক রেজা: না, যেসব দুর্নীতির ঘটনা ঘটছে তার দায় সরকার কোনোভাবেই এড়াতে পারে না। কারণ মানুষ যেকোনো কিছুর জন্য সরকারের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে। আর আমার কাছে মনে হয় যে, প্রতিষ্ঠানগুলো আমরা নষ্ট করে ফেলেছি। এখানে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার এবং তাদের দায়িত্ব ফিরিয়ে আনা দরকার। যেমন ধরেন যে, ব্যুরোক্রেসি একটা প্রতিষ্ঠান, জুডিসিয়ারি একটা প্রতিষ্ঠান, সংসদ একটি প্রতিষ্ঠান আবার রাজনীতি নিজেও একটি প্রতিষ্ঠান। আমাদের দুর্ভাগ্য হলো আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিষ্ঠান চালায় অথচ তারা নিজেরা কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক হতে পারে নি। সুতরাং রাজনৈতিক দলগুলোর নিজেদের ভেতরে ভালো চর্চা, গণতন্ত্রের চর্চা, সুস্থতার চর্চা, দুর্নীতিবিরোধী চর্চাটাই থাকতে হবে। তাহলে অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিক হয়ে যাবে।
রেডিও তেহরান: জনাব সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা। বাংলাদেশের বর্তমান সময়ের একটি বার্নিং ইস্যু করোনা টেস্ট বিষয়ে দুর্নীতি এবং প্রতারণা নিয়ে রেডিও তেহরানের সাথে বিশেষ সাক্ষাৎকার দেয়ার জন্য আবারও আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
ইশতিয়াক রেজা: ধন্যবাদ।#
পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/২৩