সেপ্টেম্বর ১২, ২০২০ ১৮:৩০ Asia/Dhaka

বিশাল একটি দেশ ইরান। এ দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ইতিহাস-ঐতিহ্য,পুরাতত্ত্ব আর সংস্কৃতির বিচিত্র সমৃদ্ধ উপাদান। গত আসরে আমরা ইরানের নামকরা প্রদেশ ইস্ফাহানে গিয়েছিলাম। ইস্ফাহান প্রদেশের কেন্দ্রিয় শহরের নাম ইস্ফাহান।

ইস্ফাহানকে বলা হয় 'নেসফে জাহান' মানে অর্ধ বিশ্ব। আবার ইস্ফাহান শহরকে বলা হয় ‘মোজে হামিশে জেন্দেয়ে ইরান’। এর অর্থ হলো অমর যাদুঘর। সুতরাং বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয় যে এই শহরে রয়েছে ঐতিহাসিক বহু নিদর্শন এবং প্রাণবন্ত ও মনোরম দৃশ্যাবলি। গত আসরে আমরা নাকশে জাহান নিয়ে কথা বলেছিলাম।

বলেছিলাম যে এই স্কোয়ারের অনেকগুলো প্রবেশপথ আছে। স্কোয়ারের চারপাশেই চারটি বাজার আছে। এসব মার্কেট এমনভাবে বানানো হয়েছে যে যে কেউ চাইলে এইসব দোকানের ভেতর দিয়ে স্কোয়ারে প্রবেশ করতে পারবে। সাফাভি শাসনামলে এই বাজারগুলো একেকটি একেক পেশার জিনিসের জন্য নির্দিষ্ট ছিল। বর্তমানে স্কোয়ারের পশ্চিম পাশের বাজারটিতে তামা শিল্পের জিনিসপত্র বিক্রি হয় আর উত্তর পাশের বাজারে বিক্রি হয় কার্পেট বা কার্পেট জাতীয় অন্যান্য সামগ্রী। অন্যান্য দোকানে রয়েছে বিচিত্র হস্তশিল্প। মিনিয়েচার শিল্প, কাষ্ঠখোদাই শিল্প থেকে শুরু করে সূক্ষাতিসূক্ষ্ম কারুকাজের বিচিত্র শিল্প আপনার সামনে বসেই শিল্পীরা তৈরি করবে। আপনার যত কৌতূহল সব কৌতূহলের জবাব দেবে তারা হাসিমুখে।

ইস্ফাহানের নাকশে জাহান বা ইমাম স্কোয়ারকে যদি প্যারিসের কনকর্ড স্কোয়ারের সঙ্গে তুলনা করা যায় তাহলে দেখা যাবে ইমাম স্কোয়ার বহুদিক থেকে বিশেষ করে ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং সমৃদ্ধ। চীনের তিয়ানানমেন স্কোয়ারের সঙ্গেও যদি তুলনা করা হয় তাহলে দেখা যাবে আয়তনের দিক থেকে তিয়ানানমেনের পরপরই ইমাম স্কোয়ার পৃথিবীর বৃহত্তম স্কোয়ার। এই স্কোয়ারটি আয়তনের দিক থেকে যেমন তেমনি নির্মাণশৈলীর দিক থেকেও বিস্ময়কর। এ কারণেই কয়েক শতাব্দিতে এতো বেশি দর্শনার্থী এই স্কোয়ার পরিদর্শন করতে এসেছেন যে ইতিহাসে বিরল।

স্কোয়ারের পশ্চিম পাশে রয়েছে আলি কাপু প্রাসাদ। প্রাসাদটি ছয় তলা বিশিষ্ট। আঠারো শ বর্গমিটার ফাউন্ডেশনের ওপর নির্মাণ করা হয়েছে প্রাসাদটি। এই প্রাসাদের উচ্চতা নাকশে জাহান স্কোয়ারের সমতল থেকে চৌত্রিশ মিটার এবং প্রত্যেক তলাতেই বিশেষ বিশেষ শিল্পের অসাধারণ কারুকাজ দর্শকের নজর কাড়বে। এই স্থাপনাটির বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যেমন ভবনের প্রবেশস্থলে শব্দের প্রতিধ্বনির আলাদা একটা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। রয়েছে অসম্ভব সুন্দর একটি অভ্যর্থনাগার। মিউজিকের মূল অডিটোরিয়ামের বাইরেও রয়েছে তেপ্পান্নটি কক্ষ। এগুলোও অভ্যর্থনা কক্ষ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। যে-কোনো অতিথি এলে এসব কক্ষে অভ্যর্থনা জানানো হতো, তাদেরকে বসতে দেওয়া হতো, সভাকক্ষও  ছিল এসবের মধ্যে। সরকারি কার্যালয়, রাষ্ট্রদূতদের থাকার স্থান এবং অতিথিদের বিশ্রামাগারও ছিল এসবের মধ্যে। কাঠের পিলারের তৈরি এইসব কক্ষের সৌন্দর্য এযুগের স্থাপত্যশৈলির জন্য খুবই বিস্ময়ের।

আলি কাপু প্রাসাদের পর এবার যাওয়া যাক ইমাম মসজিদের দিকে। ইমাম মসজিদের স্থাপত্যশৈলিও এই স্কোয়ারের জাকজমকপূর্ণ এবং আলোচিত একটি বিষয়ে পরিনত হয়েছে। ইমাম স্কোয়ারের দক্ষিণ অংশে অবস্থিত এই মসজিদটি। এই মসজিদের আরও কয়েকটি নাম রয়েছে। মসজিদের সুলতানি, জামে মসজিদ এবং শাহ মসজিদ ইত্যাদি নামেও বিখ্যাত এই মসজিদটি। শাহ আব্বাস সাফাভিদের শাসনকালের চব্বিশতম বছরে এই মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছে। এই মসজিদের যেসব কারুকাজ করা হয়েছে বিশেষ করে টাইলসের নয়নাভিরাম কারুকাজগুলো চোখে পড়ার মতো। এর বাইরেও ওজু করার জন্য নির্মিত পানির চৌবাচ্চা, অসাধারণ গম্বুজ, সাতরঙের টাইলস ইত্যাদির কথাও উল্লেখ করার মতো।

ইমাম স্কোয়ারের দর্শনীয় স্থাপনাগুলোর মধ্যে আরো একটি স্থাপনা হলো শেখ লুৎফুল্লাহ মসজিদ। স্কোয়ারের পূর্ব অংশে আলি কাপু প্রাসাদের মুখোমুখি অবস্থিত এই মসজিদটি। শেখ লুৎফুল্লাহ আল-মিসির সম্মানে শাহ আব্বাস সাফাভির আদেশে এই ধর্মীয় স্থাপনাটি নির্মাণ করা হয়েছে। দীর্ঘ সতেরো বছর ধরে নির্মাণ করা হয়েছে এই মসজিদটি। এই ঐতিহাসিক স্থাপনাটিতে একাদশ শতকের স্থাপত্য ও টাইলসের কারুকাজের চমৎকার নিদর্শন দেখতে পাওয়া যাবে। শেখ লুৎফুল্লা মসজিদের স্থাপত্যকর্মে আলো এবং রঙের চমৎকার সংমিশ্রণকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করা হয়েছে। এই মসজিদের একটি বৈশিষ্ট্য হলো অপরাপর মসজিদের মতো এর কোনো মিনার নেই। এমনকি মসজিদটির কোনো আঙিনাও নেই। তবে এই মসজিদের একটি বড় গম্বুজ রয়েছে। গম্বুজটি যে কোনো দর্শকেরই দৃষ্টি আকৃষ্ট করে।

শেখ লুৎফুল্লাহ মসজিদের কথা বলছিলাম আমরা। বলছিলাম মসজিদের বত্রিশ মিটার উঁচু গম্বুজের দৃষ্টি আকর্ষণীয় ঐশ্বর্যের কথা। চমৎকার এই স্থাপনাটির স্থপতি এবং ডিজাইনার ছিলেন ওস্তাদ মোহাম্মাদ রেজা ইস্ফাহানি। মসজিদের প্রধান প্রবেশদ্বারে রয়েছে চমৎকার ক্যালিগ্রাফি। ওস্তাদ আলি রেজা আব্বাসির সোলস লিপিকর্মের কারুকাজে সুসজ্জিত হয়েছে ক্যালিগ্রাফিগুলো। সাফাভি শাসনামলে এই শিল্পী ব্যাপক খ্যাতিমান ছিলেন। নাকশে জাহান বা ইমাম স্কোয়ারের অপর একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন হলো কায়সারিয়া ফটক বা প্রধান দ্বার। ইস্ফাহানে বাজারে প্রবেশ করার প্রধান দরোজা এটি। এই স্থাপনাটি অনেক আগে থেকেই তিন তলা বিশিষ্ট ছিল। এর একটি তলা ছিল নাকাড়াখানা। নাকাড়া এক ধরনের বাদ্যযন্ত্র। এই নাকাড়াখানাটি কাজার শাসনামলে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। একেবারেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল।

এই সদর দরোজায় এক তলাতেই ছিল বহু দোকানপাট। লোকজন এইসব দোকানে আসতো এবং প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনাকাটা করতো। দ্বিতীয় তলায় ছিল অফিসিয়াল কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বিভিন্ন কার্যালয়। নাকারাখানায় দিনের বিভিন্ন কর্মসূচি লোকজনের উদ্দেশে ঘোষণা করা হতো। কায়সারিয়া প্রধান ফটকের উপরের অংশে শিল্পী রেজা আব্বাসির হাতের ছোঁয়া সমৃদ্ধ ক্যালিগ্রাফি এখনও নজরে পড়বে।#

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবুসাঈদ/ ১২

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ