মাওলানা রুমির বাবা বাহাউদ্দিন ওয়ালাদের জীবন ও অবদান
আজ আমরা হিজরি ষষ্ঠ ও সপ্তম শতকের প্রখ্যাত ইরানি মনীষী মাওলানা রুমির বাবা বাহাউদ্দিন ওয়ালাদের জীবন ও অবদান নিয়ে কথা বলব।
প্রখ্যাত ইরানি কবি মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমির বাবা বাহাউদ্দিন ওয়ালাদের নাম মুহাম্মাদ বিন হুসাইন খাত্বিবি বাক্রি। তিনি সুলতানুল ওলামা বাহা ওয়ালাদ নামেও খ্যাত ছিলেন। তার জন্ম হয়েছিল ৫৪৬ হিজরি সনে তথা খ্রিস্টিয় ১১৫১ সনে তৎকালীন বৃহত্তর খোরাসানে। বাহা ওয়ালাদ ছিলেন একাধারে আলেম, আরেফ বা আধ্যাত্মিক সুফি-সাধক, কবি ও বক্তা এবং ধর্ম প্রচারক। তার বাবার নাম ছিল হুসাইন বিন আহমাদ খাত্বিবি। এই খাত্বিবিও ছিলেন একজন বড় আলেম এবং তার মা ছিলেন খাওয়ারিজমের সুলতানদের বংশধর। বাহা-ওয়ালাদের পরিবার ও জ্ঞাতি-গোষ্ঠী বাল্খে বসবাস করতেন। কারো কারো মতে বাহা-ওয়ালাদ ছিলেন প্রখ্যাত সুফি-সাধক শেইখ নাজমুদ্দিন কোবরার শিষ্য ও অন্যতম খলিফা। আবার অনেকে মনে করেন তিনি ছিলেন আহমাদ গাজ্জালির শিষ্য বা খলিফা। তবে বাহা-ওয়ালাদের নিজের বই থেকে এ ধরনের কোনো ধারণার সমার্থক কোনো ইঙ্গিত দেখা যায়নি।
মাওলানা রুমির বড় ছেলে সুলতান ওয়ালাদের বক্তব্য অনুযায়ী বাহা ওয়ালাদ তার বিখ্যাত উপাধি সুলতানুল ওলামা তথা আলেমদের সুলতান পেয়েছেন স্বয়ং মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা)'র কাছ থেকে। সুলতান ওয়ালাদ তার দাদা সম্পর্কে ওয়ালাদনামেহ শীর্ষক বইয়ে লিখেছেন, এক রাতে বালখের আলেম সমাজের সবাই স্বপ্নে দেখেন যে মহানবী (সা) বাহাউদ্দিন বা বাহা ওয়ালাদকে সুলতানুল ওলামা উপাধি দিয়েছেন। তারা ঘুম থেকে উঠেই বাহা ওয়ালাদের কাছে ছুটে এসে তাকে সম্মান জানান। অবশ্য আধুনিক যুগে রুমি-বিষয়ক গবেষক অধ্যাপক ফুরুজানফার বাহা ওয়ালাদের বইয়ের বক্তব্যের ভিত্তিতে মনে করেন বাহা ওয়ালাদকে স্বপ্নযোগে সুলতানুল ওলামা উপাধি দিয়েছিলেন নুরানি চেহারার এক বৃদ্ধ এবং এরপর থেকে তিনি যখন নিজের ফতোয়াতে স্বাক্ষর করতেন তখন এই উপাধি ব্যবহারের ওপর জোর দিতেন।
যাই হোক্ প্রখ্যাত ধর্মীয় সাধকের বংশে জন্ম নিয়েছিলেন বাহা ওয়ালাদ। পূর্বপুরুষদের পেশার প্রতি বিশ্বস্ত থেকে তিনি বালখে ধর্ম প্রচার ও মুফতি হিসেবে সক্রিয় ছিলেন। বাহা ওয়ালাদ নিজের জন্য আলেমের পরিচয়কেই বেশি পছন্দ করতেন এবং সফরের সময় খানক্বায় থাকার চেয়ে মাদ্রাসায় থাকাকেই গুরুত্ব দিতেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তার বক্তৃতাগুলো থেকে বোঝা যায় আলেম হওয়ার পাশাপাশি তিনি একজন সুফি আরেফও ছিলেন।
জাররিনকুবের লেখা বই ''পেল্লেহ পেল্লেহ তা' মোলা'ক্বা'তে খোদা'' বা পর্যায়ক্রমে আল্লাহর সান্নিধ্য শীর্ষক বই থেকে জানা যায় বাহা ওয়ালাদ সে যুগের ধর্ম-প্রচারকদের প্রথা অনুযায়ী খোরাসান, ট্রান্স অক্সিয়ানা ও তুর্কিস্তানের নানা অঞ্চল সফর করেছেন। ওয়াখ্শ, সোগদ্ ও খাওয়ারেজম্ অঞ্চলেও তিনি সফর করেন। তিনি যেখানেই সফর করতেন সেখানকার মসজিদগুলোতে ওয়াজ-নসিহত করতেন ও মাদ্রাসাগুলোতে ক্লাস নিতেন। এমনকি খানক্বাহগুলোতেও যাতায়াত করতেন বাহা ওয়ালাদ। এইসব সফরের কারণে কখনও মাসের পর মাস ও এমনকি কখনও বছরের পর বছর জন্মভূমি থেকে দূরে ছিলেন বাহা ওয়ালাদ। কখনও কখনও তিনি এইসব সফরে পরিবারকেও সঙ্গে নিতেন ও কখনও একলাই সফরে যেতেন। এইসব সফরে বাহা ওয়ালাদ তার বক্তৃতার যেমন বিপুল অনুরাগী পেতেন তেমনি অনেক বিরোধীও পেতেন। বাহা ওয়ালাদের ওয়াজ নসিহতের বক্তৃতাগুলো ছিল বেশ প্রাণবন্ত ও ক্লাসগুলোও হত অন্য অনেক ফকিহ ও আলেমের ক্লাসের তুলনায় বেশি আকর্ষণীয়।
বাহা ওয়ালাদ বক্তব্য রাখতেন নির্ভিকচিত্তে। তিনি তার বক্তৃতায় মন্দ স্বভাবের আলেম ও কাজীদের পরিহাস করতেন এবং যেসব বক্তা খ্যাতি ও পদের লোভে ক্ষমতাসীন জালেম কর্তৃপক্ষকে সমর্থন দিত তাদেরও নিন্দা করতেন কঠোর ভাষায়। ফলে স্বৈরশাসক ও ক্ষমতালোভী বিচারক বা কাজিরা বাহা ওয়ালাদ ও তার শিষ্যদের জন্য নানা হয়রানি ও যন্ত্রণার ব্যবস্থা করত। বাহা ওয়ালাদের সফরকে তারা অস্বস্তিকর মনে করত। সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ এবং দুষ্টের দমন ও শিষ্টের লালনে বাহা ওয়ালাদের বক্তৃতাগুলো বহু মানুষকে তার প্রতি আকৃষ্ট করেছিল। তিনি ব্ক্তৃতার মজলিসগুলোতে মানুষকে ইসলামী বিধি-বিধান মেনে চলতে উৎসাহ দিতেন এবং জুলম বাদ দিয়ে ন্যায়বিচার ও সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে খাওয়ারেজমশাহের প্রতি আহ্বান জানাতেন। বাহা ওয়ালাদ ওয়াজ-নসিহতের জন্য যে শহরেই যেতেন সেখানকার সর্বস্তরে তার বহু অনুসারী ও অনুরাগী গড়ে উঠত। বালখের জনগণ তার প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল ছিল। মানাক্বিবুল আরেফিনসহ নানা জীবনী-গ্রন্থে দেখা যায় সুলতানুল ওলামা বাহা ওয়ালাদ তার বক্তৃতা আর ওয়াজে সেইসব দার্শনিকদের তিরস্কার করতেন যারা বলতেন একমাত্র বুদ্ধিবৃত্তি দিয়েই সত্য ও বাস্তবতাকে উপলব্দি করতে হবে।
সুলতানুল ওলামা বাহা ওয়ালাদ অন্য অনেক সুফি সাধকের মতই বুদ্ধিবৃত্তিকে সীমিত এবং যুক্তিবাদীদের পা কাঠের তৈরি বলে মনে করতেন। তার মতে অন্তরের পরিশুদ্ধি, সাধনা ও আল্লাহর নৈকট্য ছাড়া বাস্তবতাকে বোঝা বা অন্তরের চোখ দিয়ে দেখা সম্ভব নয়। তিনি ও অন্য সুফিরা বিশ্বাস করতেন দার্শনিকরা সঠিক পথ হতে বিচ্যুত হয়েছেন।
ইমাম ফখরুদ্দিন রাজি ছিলেন বাহা ওয়ালাদের সমসাময়িক ও খাওয়ারেজমশাহের শিক্ষক। সেখানকার তৎকালীন সম্রাট ফখরে রাজিকে খুবই শ্রদ্ধা করতেন। কিন্তু বাহা ওয়ালাদ বহুবার ওয়াজের মজলিশে ও নিজের কিতাবে ফখরে রাজি এবং তার চিন্তাধারার নিন্দা জানিয়েছেন। বলা হয় ফখরে রাজি বাহা ওয়ালাদের প্রতি ইর্ষান্বিত হয়েছিলেন এবং খাওয়ারেজমশাহকে প্রভাবিত করে তিনি তাকে বাহা ওয়ালাদের শত্রুতে পরিণত করেন। কিন্তু নানা সাক্ষ্য প্রমাণ থেকে মনে হয় এ দুই বড় আলেম নিজ নিজ বিশ্বাসে একনিষ্ঠ ও অবিচল ছিলেন এবং তাদের মধ্যে মতভেদ ও দ্বন্দ্ব ছিল স্বাভাবিক। বড় মাপের শিক্ষকদের মতবিরোধকে কেন্দ্র করে ফেতনার আগুন প্রজ্জ্বলিত হত তাদের অনুসারী আর অনুরাগীদের মধ্যে।
কোনো কোনো লেখকের মতে বাহা ওয়ালাদ খাওয়ারেজমশাহের নির্যাতন ও অবিচারের কারণে এবং ইরানে তাতার বা মোঙ্গলদের হামলার খবর শুনে বালখ থেকে হিজরত করার সিদ্ধান্ত নেন। ফুরুজানফারের মতে তৎকালীন ইরানে মোঙ্গলদের হামলার কারণেই বাহা ওয়ালাদ সপরিবারে ইরান থেকে হিজরতের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। একই কারণে বহু ইরানি নাগরিক সে সময় ইরান থেকে হিজরত করেছিলেন। সামরিক পরিস্থিতির কারণে বাহা ওয়ালাদ ছাড়াও অনেক জ্ঞানী-গুণীও সে সময় দেশ ত্যাগ করেছিলেন। যেমন, শেইখ নাজিমুদ্দিন রাজির মত প্রখ্যাত ব্যক্তিত্বও ট্রান্স-অক্সিয়ানা ছেড়ে রেই শহরে আসেন এবং তিনি পরে কৌনিয়াতে আশ্রয় নেন।#
পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/ ৩০
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।