ইরানি কবি আলীকুলি খান ওয়াজিরির জীবন ও অবদান
আজ আমরা হিজরি দ্বাদশ শতকের তথা খ্রিস্টিয় অষ্টাদশ শতকের প্রখ্যাত ইরানি জীবনীকার ও কবি আলীকুলি খান ওয়াজিরির জীবন ও অবদান নিয়ে কথা বলব।
আলীকুলি খান ওয়াজিরির ছদ্মনাম ওয়ালেহ দাগেস্তানি। হিজরি ১১২৪ সনের সফর মাসে ইস্ফাহানে তাঁর জন্ম হয়েছিল। সুলতান হুসাইন সাফাভির রাজত্বকালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা মোহাম্মাদ আলী খান ১১২৬ হিজরিতে ইয়ারাভান অঞ্চলের সেনাপ্রধান পদে নিয়োগ পান। এ সময় দুই বছর বয়স্ক আলীকুলি খানও বাবার সঙ্গে সেখানে যান। এরপর তার বাবা আলীকুলি খান ইয়ারাভান ও আযারবাইজানের প্রধান সেনাপতি এবং প্রশাসক হন। এ অবস্থায় তাকে কান্দাহারে পাঠানো হয় যাতে তিনি সেখানে আফগানদের বিদ্রোহ দমন করে ওই অঞ্চলকে পুনরায় ইরানের কেন্দ্রীয় সরকারের কর্তৃত্বাধীনে আনতে সক্ষম হন। কিন্তু তিনি কান্দাহারের দিকে রওনা হওয়ার পর নখচেভান বা নখজাওয়ান অঞ্চলে মারা যান। তাঁর জানাজা নাজাফে আনা হয় এবং হযরত আলী (আ)'র পবিত্র মাজার প্রাঙ্গনের কাছে তাঁকে দাফন করা হয়। এ অবস্থায় শিশু আলীকুলি খান পরিবারের সঙ্গে ইস্ফাহানে ফিরে আসেন। আলীকুলি খান ইস্ফাহানে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ শুরু করেন। চাচা হাসান আলী খান ছিলেন এ সময় আলীকুলি খানের অভিভাবক ও তত্ত্বাবধায়ক।
খাদিজে সুলতান নামে আলীকুলি খানের চাচার একটি কন্যা ছিল। সে ছিল আলীকুলির সমবয়স্ক ও খেলার সঙ্গী। চাচার মনোনীত শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে খাদিজেহ সুলতান কুরআন শেখার পর আরবি, ফার্সি, ইতিহাস ও সাহিত্য শেখার ক্ষেত্রে বেশ অগ্রগতি অর্জন করেন, কিন্তু তিনি প্রতিভাধর হওয়া সত্ত্বেও এইসব শাস্ত্রে উচ্চ পর্যায়ের জ্ঞান অর্জনের সুযোগ পাননি। আলীকুলির বাবার চাচা ফাত্হ আলী খান ছিলেন সাফাভি সম্রাটের মন্ত্রী। তিনি ১১৩৩ হিজরিতে সম্রাট হওয়ার ষড়যন্ত্র করেছেন বলে অভিযুক্ত হন। সম্রাট হোসাইন সাফাভি এই অজুহাতে ফাত্হ আলী খানের পরিবারের সব পুরুষ সদস্যকে রাজকীয় সব পদ থেকে সরিয়ে কারাবন্দি করেন। এ অবস্থায় ১১৩৩ হিজরির শেষের দিকেই আফগানরা ইস্ফাহানে হামলা চালিয়ে শহরটি দখল করে নেয়।
হিজরি ১১৩৩ সালেই আফগানরা ইস্ফাহানে হামলা চালায়। তারা শহরটি দখল করে নেয়। ফলে এ অঞ্চলে যুদ্ধের আগুন জ্বলে ওঠে। ১১৩৫ হিজরিতে মাহমুদ আফগান ইস্ফাহান জয় করে সুলতান হোসাইন সাফাভিকে বন্দি করেন। মাহমুদ আফগান নিজে ক্ষমতার মসনদ দখল করেন। তিনি হিজরি ১১৪২ সন পর্যন্ত তথা সাত বছর ইস্ফাহানের ওপর কর্তৃত্ব করেছিলেন।
ইস্ফাহানের ওপর মাহমুদ আফগানির কর্তৃত্বের এই দিনগুলোতেই আলীকুলি খান ও তার চাচাতো বোন খাদিজেহ’র জীবনে ঘটে যায় বিষাদময় এক করুণ ঘটনা। এটা তাদের জন্য ছিল এক মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি। খাদিজেহর মা আলীকুলি খানের মায়ের কাছে তাদের এ দুই সন্তানকে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ করার প্রস্তাব দেন। কিন্তু আলীকুলি খানের সঙ্গে খাদিজেহ’র বিয়ে খুব সাদামাটা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হবে তা আলীকুলির মা মেনে নিতে পারেননি। তাই তিনি এ ধরনের বিয়ের বিরোধিতা করেন। এভাবে তাদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতার সূচনা হয়। এই বিচ্ছিন্নতার বিরহ ওয়ালেহর গজলে ব্যাপক মাত্রায় হয়েছে প্রতিফলিত।
আলীকুলি খানের সঙ্গে খাদিজেহর বিয়ে স্থগিত হওয়ার ওই ঘটনার কিছু দিন পরই মাহমুদ আফগানের হুমকি ও চাপের মুখে খাদিজেহ’র পরিবার তাদের আদরের এই কন্যাকে মাহমুদ আফগানের এক ঘনিষ্ঠ ব্যক্তির কাছে বিয়ে দিতে বাধ্য হন। এ ঘটনায় শোকাভিভূত হয়ে আলীকুলি খান শহর, বাজার ও নানা জনপদে পাগলের মত ঘুরে বেড়াতেন। এই সময়টাতেই দ্বিতীয় তাহমাসভ সাফাভি ইস্ফাহানে প্রবেশ করেন এবং তিনি আফগানদেরকে ইস্ফাহান অঞ্চল থেকে ফার্স ও কেরমান অঞ্চলের দিকে তাড়িতে দিতে সক্ষম হন। আফগান নেতা 'আশরাফ আফগান' বালুচিস্তান অঞ্চলের কাছে নিহত হন।
১১৪৪ হিজরিতে নাদের শাহ আফশার ইরানের ক্ষমতা হাতে নেন। এ সময় আলীকুলি খানের বয়স ছিল বিশ বছর। এ সময় আলীকুলি ইরান ছেড়ে ভারতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং বহু কষ্টে ভারতে পৌঁছেন। খাদিজেহকে হারানোর গভীর শোক ভোলার জন্যই তিনি এ পদক্ষেপ নিয়েছিলেন।
আলীকুলি খান ১১৪৬ হিজরিতে ভারতে প্রবেশ করেন। ভারতের মোঘল সম্রাট মোহাম্মাদ শাহ ও তার সভাষদরা তাকে সম্রাটের দরবারের কর্মকর্তা হওয়ার আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু যোগ্যতা নেই এই অজুহাত দেখিয়ে আলীকুলি ওই আমন্ত্রণ গ্রহণ করেননি। কিন্তু কিছুকাল পর সম্রাটের বার বার নির্দেশের প্রেক্ষাপটে তিনি দরবারে যোগ দেন। আলীকুলি সম্রাটের খুব প্রিয়ভাজন হন এবং উচ্চতর পদে নিয়োগ পান। দরবারে নানা কাজে ব্যস্ততা ও বন্ধুদের ব্যাপক সাহচর্য সত্ত্বেও প্রিয়তমা খাদিজেহ সুলতানকে ভুলতে পারেননি আলীকুলি। সব সময় তিনি তাকে স্মরণ করতেন ও তার জন্য কবিতা লিখতেন। চিঠি ও দূতের মাধ্যমে তার সঙ্গে যোগাযোগও রাখতেন। আলীকুলির বাসায় মাঝে মধ্যে কবিতার আসর বসত।
আলীকুলির সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ও আন্তরিক বন্ধু ছিলেন শামসউদ্দিন ফকির দেহলাভী। তার কাছে মনের সব কথা খুলে বলতেন আলীকুলি। ফকির দেহলাভীর কাছে তার প্রেমের ঘটনাও তুলে ধরেন আলীকুলি। দেহলাভীও তার বন্ধুর অনুমতি নিয়ে এই ঘটনার ভিত্তিতে একটি কাব্য লিখেছেন। এই কাব্যের নাম ছিল ওয়ালেহ ও সুলতান। চাচাতো বোন খাদিজেহ সুলতানের প্রতি আলীকুলি খান ওরফে 'ওয়ালেহ দাগেস্তানি'র হৃদয় দেয়ার ও তাদের মধ্যে মর্মান্তিক বিচ্ছিন্নতার সেই কাহিনী-ভিত্তিক এই কাব্যটি লেখা হয় হিজরি ১১৬০ সনে। কবি নিজামির লাইলি ও মাজনুন কাব্যের স্টাইলে লেখা এ কাব্যের চরণ সংখ্যা তিন হাজার ২৩০। ওই কাহিনীর পরিণতি বা শেষাংশ উল্লেখ করা হয়নি কাব্যে। কারণ তখনও তারা জীবিত ছিলেন এবং তারা পুনর্মিলনের ব্যাপারে আশাবাদী ছিলেন। খাদিজেহ সুলতানের প্রতি ওয়ালের ভালবাসার তীব্রতার কখনও বিরাম ঘটেনি। তিনি ভারত থেকে ইরানের ইস্ফাহানেও ফিরে যেতে আগ্রহী ছিলেন। এ বিষয়টি ওয়ালেহ তার কবিতায়ও উল্লেখ করেছেন: 'ভারতে ঝরিয়েছি অনেক অশ্রু ইসফাহানের স্মরণে, আমার জায়ান্দেহ নদী লজ্জায় রূপ নিল গঙ্গায় সে কারণে!'
কোনো ইরানি যখন ভারত থেকে ইরানে ফিরে আসত তখন ওয়ালেহ তথা আলীকুলি খুবই ব্যাকুল হয়ে পড়তেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তার মনে এ দুঃখ জেগেছিল। ওয়ালেহ কখনও আনুষ্ঠানিক শিক্ষা শেষ করতে পারেননি। কিন্তু তিনি অনেক কবির কাব্য পড়েছিলেন এবং এ অভিজ্ঞতার কারণেই কবিদের জীবনী সংক্রান্ত বই' রিয়াদ আশ শোয়ারা' লিখতে সক্ষম হয়েছিলেন। কোনো কোনো জীবনীকারের বর্ণনায় জানা যায় খাদিজেহ সুলতান আলীকুলিকে দেখার জন্য ভারতের দিকে রওনা হয়েছিলেন এবং কারবালা ও বসরা হয়ে পানিপথে সেদিকে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু খাদিজেহ পথিমধ্যে পশ্চিম ইরানের কেরমানশাহ অঞ্চলে মারা যান। কয়েক মাস পর এ সংবাদ যখন দিল্লিতে আলীকুলির কানে পৌঁছায় তখন তিনি প্রবল শোকে কাতর হয়ে মারা যান। ১১৭০ হিজরিতে এ ঘটনা ঘটে। এ সময় আলীকুলির বয়স হয়েছিল ৪৬। তাকে দিল্লীতেই দাফন করা হয়। কিন্তু তার কবরের কোনো চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়নি।
পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/ ১১
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।