অক্টোবর ১১, ২০২০ ২০:৩০ Asia/Dhaka

বলেছিলাম যে, বিশাল একটি দেশ ইরান। এ দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ইতিহাস-ঐতিহ্য,পুরাতত্ত্ব আর সংস্কৃতির বিচিত্র সমৃদ্ধ উপাদান।

গত আসরে আমরা কাশানের ঐতিহ্যবাহী গোলাবজল গ্রহণ, কামসারের ফুলের বাগান ইত্যাদি নিয়ে কথা বলেছিলাম। কাশানের ফুলের বাগান, স্বচ্ছ পানির ঝর্ণাপ্রবাহ, বিশেষ করে এখানকার গোলাপ জলের উৎসব সত্যিই স্মরণীয় একটি ঘটনা। কাব্যশিল্প ও সাহিত্যেরও সূতিকাগার এই কাশান। এখানকার ফুল বাগান এবং গোলাবজল গ্রহণ ঐতিহাসিক এবং ঐতিহ্যবাহী একটি বিষয়।

বলছিলাম গোলাবজলের এই কামসারের বাইরেও কাশানে রয়েছে ঐতিহ্যবাহী একটি স্থাপনা ও বাগিচা। এর নাম হলো বগে ফিন। আমরা আজও এই কাশানেই ঘুরে বেড়াবো এবং এই ফিন বাগিচায় যাবো। ফিন বাগিচার ভেতরে রয়েছে দেহ মন জুড়ানো শীতল একটি চমৎকার ঝর্ণা। এই ঝর্ণাটির নামও বাগিচার সঙ্গে মিল রেখেই রাখা হয়েছে ফীন। ফীন ঝর্ণাটি প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে প্রবাহিত হয়ে বর্তমানেও তার প্রবহমান ধারা অব্যাহত রেখেছে। চমৎকার এই ফিন বাগিচা এবং ফিন ঝর্না নিয়ে আমরা আজকের আসরে কথা বলার চেষ্টা করবো।

 

সাত হাজার বছর আগে প্রাচীন সিয়াল্ক পার্বত্য শহরটি প্রকৃতির ভাঙ্গা-গড়ায় এবং সামাজিক পরিবর্তনের ফলে যে ক'বার নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল,এই ফীন ঝর্ণার কল্যাণেই পুণরায় তা গড়ে ওঠে।কিন্তু সর্বশেষ পর্যায়ে অর্থাৎ খৃস্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দের শুরুতে আগ্রাসীরা এই শহরে ব্যাপক অগ্নিকাণ্ড ঘটায়। আগুন লাগানোর পর এই পার্বত্য অঞ্চলের অধিবাসীরা এলাকা থেকে দিকবিদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে। সিয়াল্ক পার্বত্য শহরে তখন কেবল মাটির টীলাগুলো ছাড়া আর কোনো স্থাপত্য বা বাড়িঘর অবশিষ্ট ছিলোনা। এই যে ফীন ঝর্ণার কথা বলছি আমরা, এখানেই ছিলো হাজার বছরের পুরোণো ফীন বাগান। এটি ছিলো কাশানে দেখার মতো একটা ঐতিহাসিক নিদর্শন। কাশান থেকে ছয় কিলোমিটার পশ্চিমে ফীন ঝর্ণাধারাটি অবস্থিত। পার্বত্য শিলা ও প্রস্তরময় এই ঝর্ণাধারাটি এতো বিস্ময়কর সুন্দর যে দেখলে মনটা একেবারে জুড়িয়ে যায়। ফীন কিংবা কাশান শহরের উৎপাদিত কৃষিজাত পণ্যের উৎসই হলো এই ঝর্ণাধারাটি।

অর্থাৎ এই ঝর্ণাটি থাকাতেই কৃষিকাজ করা সম্ভব হয়েছে। ঝর্ণার পানি পাম্পের মাধ্যমে সেঁচে কৃষিকাজ করা হতো। ফীন ঝর্ণার পানি এখনো সোলায়মানীয়া ঝর্ণা নামে পরিচিত পুকুর বা হাউজে সরবরাহ করা হয় । ঐ হাউজের পানি বিশেষ ধরণের ফোয়ারার মাধ্যমে কেয়ারী করে সাজানো ফীন বাগানের সারিবদ্ধ গাছে গাছে ছিটানো হয়। রাস্তার গাছগুলোও ঐ পানি পেয়ে সবুজ-শ্যামল আর সতেজ হয়ে ওঠে। ডালিম আর ডুমুরের বাগানগুলোও ঐ ফোয়ারার পানি দিয়ে নিজেদের তৃষ্ণা মেটায়। ফীনের অবশিষ্ট পানি শহরের শস্যক্ষেতের দিকে সরবরাহ করা হয়। ঐতিহাসিক তথ্যপঞ্জী থেকে জানা যায় যে, যুগ যুগ ধরে এই স্বচছ পানির ঝর্ণাধারাটির দুই প্রান্ত জুড়ে নয়নাভিরাম বাগ-বাগিচা যেমন গড়ে উঠেছে, তেমনি গড়ে উঠেছে সুন্দর সুন্দর অট্টালিকা। কিন্তু কালের পরিক্রমায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর সামাজিক পরিবর্তনের ফলে এইসব ঘরবাড়ী আর অট্টালিকা বিলীন হয়ে যায়।

বলছিলাম কালের গর্ভে হারিয়ে যায়, বিলীন হয়ে যায় অট্টালিকা। কিন্তু জীবন যাপনের প্রয়োজনে মানুষ আবারো ঐ পুরোণো ভিত্তিমূলে গড়ে তোলে নিত্য-নতুন আবাসন। খ্রিষ্টিয় ১৮৩৩ সাল থেকে ১৮৭১ সাল অর্থাৎ ফতেহ আলী শাহ কাজারের শাসনামলে অধুনালুপ্ত ফীন বাগান-প্রান্তীয় ভবন-অট্টালিকাগুলোকে পুণরায় সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়। এ সময়কালেই স্বচছ মর্মর পাথর , ফিরোজা পাথর আর উন্নতমানের সাতরঙ টাইলস ব্যবহার করে বিশাল হাম্মাম তৈরী করা হয় । ফলে ইতোপূর্বে ফীন বাগানের যে ঐশ্বর্য হারিয়ে গিয়েছিল,তা পুণরায় ফিরে এলো। শুধু ফিরেই আসেনি , সাথে সাথে সমগ্র ইরানের জন্যে এই ফীন বাগান একটি অভিজাত অবকাশ যাপন কেন্দ্র বা চমৎকার একটি বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে বিখ্যাত হয়ে উঠলো। ফীন বাগিচা,তার স্থাপত্য,নবীন প্রাচীন ছোট-বড় গাছ-গাছালী পরিবেষ্টিত প্রবাহমান ঝর্ণাধারা, পুকুর-নহর-হাউজ আর অসংখ্য ফোয়ারায় সমৃদ্ধ এই চমৎকার উদ্যান ইরানের প্রাচীন বাগিচাগুলোর মধ্যে অন্যতম বলে স্বীকৃত।

ফীন বাগিচার এতো ঐশ্বর্যের পরও এই বাগানের সাথে জড়িয়ে আছে ইরানী জনগণের জন্যে এক বেদনাবিধূর ও কষ্টের স্মৃতিময় ইতিহাস। আর তা হলো আমীর কাবিরের হত্যাকাণ্ড। আমীর কাবিরের পুরো নাম হলো মীর্যা তাকি খান আমীর কাবির।ক্বাজারী শাসনামলে তিনি ছিলেন ইরানের একজন উধর্বতন পর্যায়ের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব।ক্বাজার রাজবংশের অন্যতম শাসক নাসের উদ্দীনের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তিনি। তিনি একদিকে যেমন স্বাধীন চিন্তা-চেতনা তথা প্রগতিশীল সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী এক সংস্কারকামী ব্যক্তিত্ব ছিলেন,অন্যদিকে ছিলেন ইরানী সংস্কৃতি আর শিক্ষা-প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে উন্নত চিন্তার প্রবক্তা। তিনি পারস্পরিক বন্ধুত্বের ভিত্তিতে বিভিন্ন দেশের সাথে সম্পর্ক স্থাপনে বিশ্বাসী ছিলেন। ইরানের সার্বিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে আমীর কাবিরের ব্যাপক ভূমিকা অবশ্যস্বীকার্য। কিন্তু তাঁর এই উন্নয়নকামী চিন্তাই পরাশক্তিগুলোর গা-জ্বালার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবশেষে বহির্শক্তি ও অভ্যন্তরীণ অপশক্তিগুলোর চাপের মুখে নাসের উদ্দীন শাহ আমীর কাবিরকে দায়িত্ব থেকে অপসারণ ক'রে কাশানে নির্বাসনে পাঠায় এবং পরে তাঁকে হত্যা করা হয়।   

কাশান ভ্রমণে গিয়ে যে গ্রামটি না দেখলে সফর অসম্পূর্ণ থেকে যাবে তা হলো অবিয়নে। তেহরান থেকে অবিয়নের দূরত্ব তিন শ দশ কিলোমিটারের মতো। ইস্ফাহান প্রদেশের কাশান শহর থেকে আশি কিলোমিটার দূরে অবস্থিত অবিয়নে গ্রামটির উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে দুই হাজার দুই শ বাইশ মিটার। কারাকাস পর্বতের পাদদেশে অবস্থিত আবিয়ানে গ্রামের মাটির রঙ লাল। সে কারণে এই গ্রামকে রেড ভিলেজও বলে। লাল মাটির কাদার সঙ্গে খড় মিশিয়ে দেয়াল বানানো হয়েছে। আবার গুহা স্টাইলেরও বাড়ি আছে এখানে। সেই দুই হাজার বছর আগে পাহাড়ের এতো উচ্চতায় কীভাবে যে মানব বসতি গড়ে উঠেছে ভাবতেই অবাক লাগে।

প্রতিটি ঘরের দরোজাই প্রায় কাঠের। ওই দরোজায় দুই রকমের কড়া লাগানো। একটি কড়া পুরুষদের জন্য অপরটি নারীদের জন্য নির্দিষ্ট। কড়া নাড়ার শব্দ শুনেই ঘরের ভেতরের মানুষেরা বুঝতে পারবে নারী নাকি পুরুষ কড়া নেড়েছে। জরথ্রুস্টদের একটি মন্দিরও আছে এখানে। আছে স্থানীয় পোশাক আর আইসক্রিম। অবিয়নে ইরানের জাতীয় ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত হয়েছে উনিশ শ পঁচাত্তর খ্রিষ্টাব্দে।#

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবুসাঈদ/ ১১

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ