প্রখ্যাত ইরানি দার্শনিক মোল্লা সাদরার জীবন ও অবদান (তিন)
গত পর্বের ধারাবাহিকতায় আজও আমরা হিজরি দশম ও একাদশ শতকের তথা খ্রিস্টিয় ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকের প্রখ্যাত ইরানি দার্শনিক মুহাম্মদ ইবনে ইবরাহীম কাওয়ামী শিরাজী ওরফে মোল্লা সাদরার জীবন ও অবদান নিয়ে কথা বলব।
অনেকেই মনে করেন জগৎ ও জীবনে সত্যে পৌঁছার রয়েছে তিনটি ধারা। এ তিন ধারা হল ওহী, বুদ্ধিবৃত্তি ও আত্মিক পরিশুদ্ধি। ইরানি দার্শনিক মোল্লা সাদরা বিরল প্রতিভার স্বাক্ষর দেখান সত্যে পৌঁছার এই তিন ধারার মধ্যে সমন্বয় করে। তিনি ওহী, বুদ্ধিবৃত্তি ও আত্মিক পরিশুদ্ধির মাধ্যমে মহাসত্যে পৌঁছার তিন ধারার মধ্যে বিভেদের অবসান ঘটান। এ কারণেই তাঁর লেখায় যুক্তিবিদ্যা, আত্মিকভাবে অর্জিত জ্ঞান ও পবিত্র কুরআনের আয়াতের সমন্বয় লক্ষ্য করা যায়। শহীদ মুতাহ্হারীর মতে মোল্লা সাদরার দর্শন চারটি নদীর মিলনস্থলের ন্যায় চারটি মতকে সমন্বিত করেছে অর্থাৎ তিনি অ্যারিস্টটল ও ইবনে সীনার মাশ্শায়ী দর্শন, সোহরাওয়ার্দীর ইশরাকী দর্শন, মুহিউদ্দীন আরাবীর ইরফানী দর্শন ও কালামশাস্ত্রীয় চিন্তাধারার মধ্যে সমন্বয় ঘটিয়েছেন। অন্যভাবে বলা যায় যে, মোল্লা সাদরা চারটি মৌলের মধ্যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ঘটিয়ে নতুন মৌলের সৃষ্টি করেছেন যা পূর্ববর্তী উপাদান হতে স্বতন্ত্র। অর্থাৎ মোল্লা সাদরা চারটি আদর্শিক ধারার মিলন ঘটিয়ে নতুন এক ধারার জন্ম দিয়েছেন।
মুহাম্মদ ইবনে ইবরাহীম কাওয়ামী শিরাজী ওরফে মোল্লা সাদরার উপস্থাপিত দর্শন-পদ্ধতি ‘উচ্চতর বুদ্ধিবৃত্তিক প্রজ্ঞা’ বা ‘হিকমাতে মুতাআলীয়া’ নামে প্রসিদ্ধ। মোল্লা সাদরা ইসলামী দর্শনে অভূতপূর্ব অবদান রেখেছেন। তিনি দর্শনে নতুন কিছু বিষয়ের অবতারণা করে এর বহু জটিলতা দূর করেছেন। এ বিষয়টিই দর্শনশাস্ত্রে তাঁকে অমরত্ব দান করেছে। তাঁর ‘অস্তিত্বই মূল’ তত্ত্বটি স্রষ্টার সত্তা ও গুণাবলী সম্পর্কিত অসংখ্য জটিল প্রশ্নের উত্তর দানে সক্ষম হয়েছে। যেমন, মোল্লা সাদরা বলেছেন অবশ্যম্ভাবী অস্তিত্ব কারণের অমুখাপেক্ষি। বার্ট্রান্ড রাসেল ও স্টিফেন হকিন্সের মতো ব্যক্তিরা এ বিষয়টি বুঝতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়ে স্রষ্টাকে অস্বীকার করেছেন। কোনো কিছু বা ঘটনার অস্তিত্ব লাভের আগেই সে সম্পর্কে আল্লাহর অবহিত হওয়ার স্বরূপও এ তত্ত্ব থেকে উদ্ঘাটন সম্ভব হয়েছে। তিনি বস্তুর সত্তাগত গতি, কল্পনা ও ধারণা শক্তির অবস্তুক হওয়ার এবং দেহেই আত্মার উৎপত্তি ও আত্মার মাধ্যম অবিনশ্বর হওয়ার তত্ত্ব উদ্ঘাটনের মাধ্যমে দৈহিক পুনরুত্থানকে প্রমাণ করেন যা অতীতের দার্শনিকরা করতে পারেননি।

অস্তিত্বই মূল, নাকি বস্তুসত্তা মূল- এ বিষয়ে প্রথমবারের মতো বিতর্কের অবতারণা করেন সাইয়্যেদ বাকের মীর দমাদ। অবশ্য এর আগেও দার্শনিকদের মধ্যে কেউ কেউ প্রচ্ছন্নভাবে অস্তিত্বই মূল- এ তত্ত্বে বিশ্বাস করতেন। আবার কেউ কেউ বস্তুসত্তাই মূল বলে মনে করতেন। যদিও মোল্লা সাদরা প্রথম জীবনে তাঁর শিক্ষক মীর দমাদের মতো বস্তু সত্তাকেই মূল বলে মনে করতেন, কিন্তু পরবর্তীতে তিনি অকাট্য কিছু যুক্তির মাধ্যমে 'অস্তিত্বই মূল' বলে প্রমাণ করতে সক্ষম হন। তাঁর পরবর্তী সময়ে যত মুসলিম দার্শনিক এসেছেন, তাঁদের প্রায় সবাই তাঁর মত অনুসরণ করেছেন। ইবনে সিনা ও তাঁর অনুসারী দার্শনিকরা 'অস্তিত্বই মূল'- এ তত্ত্বে প্রচ্ছন্নভাবে বিশ্বাসী হলেও এ তত্ত্বের গূঢ় অর্থ বুঝতে ব্যর্থ হওয়ায় তাঁদের দার্শনিক মতামতের সঙ্গে 'বস্তুসত্তাই মূল' তত্ত্বে বিশ্বাসীদের কোনো পার্থক্য ছিল না। সোহরাওয়ার্দীর মত দার্শনিকও বস্তুসত্তাকেই মূল বলে মনে করতেন। ফলে ইবনে সিনা ও তার অনুসারী দার্শনিকরা বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তি উপস্থাপনে অনেক ক্ষেত্রেই মারাত্মক ভুল করেছেন।
মোল্লা সাদরা শিরাজি চল্লিশটিরও বেশি বই লিখেছেন। এসবই একেকটি অসাধারণ বই। নৈতিক বিষয়ে লেখা 'তিন মূল নীতি', দিওয়ানে শের বা কাব্য-সংকলন ও চিঠি-পত্রের সংকলনটি ছাড়া মোল্লা সাদরার সব বইই আরবিতে লিখিত। আসলে সে যুগের প্রধান শিক্ষাকেন্দ্রগুলোর মূল ভাষাই ছিল আরবি এবং মুসলিম চিন্তাবিদ ও পণ্ডিতরা আরবি ভাষায় লিখতেই বেশি অভ্যস্ত ছিলেন। মোল্লা সাদরার বইয়ের ভাষা ছিল সহজ-সরল। খোদাপ্রেমতত্ত বা ইরফান ও দর্শন শেখার জন্য এমন ভাষা খুবই উপযোগী যদিও সাদরার বইগুলোর ভাষাতে কখনও দর্শনের যুক্তি বা দলিল-প্রমাণের গুরু-গাম্ভীর্যতা ও কখনওবা ইরফানি ভাষার সুর প্রধান হয়ে উঠতে দেখা যায়। অবশ্য তার সব লেখাতেই ইরফানি সুবাস অনুভব করা যায়।
দর্শন বিষয়ে প্রাথমিক ও উচ্চ পর্যায়ের নানা বই লেখা ছাড়াও মোল্লা সাদরা পবিত্র কুরআনের অসাধারণ তাফসিরও লিখেছেন দার্শনিক ও ইরফানি ব্যাখ্যার ভিত্তিতে। অবশ্য পুরো কুরআনের তাফসির তিনি লিখে যেতে পারেননি।
হাদিস শাস্ত্রেও মোল্লা সাদরার ব্যাপক পাণ্ডিত্য ছিল। তিনি শেখ কুলাইনির আলকাফির উসুল বা নীতিমালা অংশের ব্যাখ্যা লেখা শুরু করেছিলেন, কিন্তু তার মৃত্যুর কারণে তা অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে।
মোল্লা সাদরার গুরুত্বপূর্ণ বইগুলোর মধ্যে আল আসফার আল আরবাহ, আত তাফসির আল কুরআন, শার্হ্ আলহিদায়া, আল ওয়ারাদাতাল ক্বালবিয়া, আল্মাবদা ওয়াল মায়া'দ, আল মাজাহির, আত্তাসাওউর ওয়াল তাসদিইক্ব ও আত্তানক্বিহ আল মানত্বিক নামের বইগুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।#
পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/ ১৫
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।