ঐতিহাসিকের ধারণা:
আলেকজান্ডারই ইয়াযদ শহরের নির্মাতা
বলেছিলাম যে, বিশাল একটি দেশ ইরান। এ দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ইতিহাস-ঐতিহ্য,পুরাতত্ত্ব আর সংস্কৃতির বিচিত্র সমৃদ্ধ উপাদান।
গত আসরে আমরা ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা ও বাগিচার শহর খনসরে গিয়েছিলাম। সেখানকার বেশ কিছু স্থাপনার সঙ্গে আমরা পরিচিত হবার চেষ্টা করেছি। বিশেষ করে বাবা পীর অথবা শেখ আবা আদনানের সমাধি দেখেছি আমরা। সাফাভি শাসনামলের বিখ্যাত পার্ক খনসর ফোয়ারা পার্কের সঙ্গে এই সমাধি স্থাপনাটির ঐতিহ্য জড়িয়ে আছে।
ফার্সিতে এই পার্কের নাম ছারচেশমে পার্ক। এই পার্কের উত্তর পূর্বে ওই সমাধিটি অবস্থিত। শেখ আদনান ছিলেন হিজরি ষষ্ঠ শতকের বিখ্যাত একজন আরেফ বা আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব। তবে এখন যে স্থাপনাটি দেখতে পাওয়া যায় সেটি সাফাভি শাসনামলের স্থাপত্যশৈলির নিদর্শন। যাই হোক আজকের আসরে আমরা যাবো ইরানের ঐতিহাসিক আরেকটি প্রদেশ ইয়াযদের দিকে। ইয়াযদের মূল শহরের নামও ইয়াযদ। এই শহরেই আজ আমরা ঘুরে বেড়াবো। ইয়াযদকে বলা হয় ইরানের মরুরত্ন বা মরুমণি। আপনাদের ভালোই লাগবে আশা করি। চলুন আমরা তাহলে সরাসরি ইয়াযদের দিকে যাত্রা শুরু করি।
ইরানের প্রতিটি প্রদেশই প্রাকৃতিকভাবে বৈচিত্র্যময়। এই সত্য আরো বেশী স্পষ্ট হয়ে উঠবে ইয়াযদ প্রদেশে গেলে।ইরানের বহু প্রদেশ তো আমরা ঘুরেছি। সমুদ্রের কথা বলেছি আমরা। পাহাড় পর্বতমালার কথা বলেছি, ঝর্ণার কথা বলেছি। বন-বনানীও ঘুরে ফিরে দেখেছি। আজ যে শহরে যাবো সে শহরের অবস্থা আমাদের এতোদিনের দেখা শহরের ঠিক বিপরীতধর্মী। এই ভূখণ্ডটি মরুময়। ইরানের মরু প্রান্তে অবস্থিত ইয়াযদ শহর। কয়েকটি মরু অঞ্চল আছে ইরানে। ইয়াযদ শহরটি কেন্দ্রীয় মরুভূমির উপকণ্ঠে অবস্থিত।
ইয়াযদ প্রদেশটির আয়তন ৭০ হাজার বর্গ কিলোমিটার। ইতিহাস-ঐতিহ্য, শিল্প-সংস্কৃতি আর সভ্যতার লালনভূমী এই ইয়াযদ। আল্লাহ প্রদত্ত যে সব বিরল নেয়ামত বা সম্পদে পরিপূর্ণ সমগ্র ইরান, তার অধিকাংশই ইয়াযদে বয়েছে।ফলে স্বাভাবিকভাবেই এই প্রদেশটি উন্নত ও বিচিত্র সম্পদে সমৃদ্ধ। ইয়াযদ প্রদেশে রয়েছে ইরানের অনেক ঐতিহাসিক ও শিল্প নিদর্শন এবং আদি বা পুরানো ইরানী রিতি-নীতি এখনও এই প্রদেশে বেশী চোখ পড়ে। তাই শিল্প-সাংস্কৃতিক রুচির বৈচিত্র্যের দিক থেকেও ইয়াযদ ইরানের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। ইয়াযদের জনগণ খুবই সংগ্রামী এবং পরিশ্রমী। বিরুপ প্রাকৃতিক পরিস্থিতি মোকাবেলা করে এ এলাকার মানুষ জীবন যাপন করে। যেহেতু মরু অঞ্চল, সেহেতু খাবার পানি সহজ লভ্য নয় সেখানে। শত শত মিটার মাটি খননের পর সামান্য পানির নাগাল মেলে।
ইয়াযদের কেন্দ্রীয় শহরটিকে একদিকে যেমন ইরানের প্রাচীন শহর বলে মনে করা হয়, অন্যদিকে তা মরু শহরের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন বলেও পরিচিত। ইয়াযদ শহরটি দুটি পাহাড়ের মাঝখানে শুকনো ও প্রশস্ত উপত্যকায় গড়ে উঠেছে। উপকূল থেকে শহরটির উচচতা ১২০০ মিটার। ইয়াযদের আবহাওয়া কখনো মরুময়, কখনও অর্ধ মরুময়। গ্রীষ্মে আবহাওয়া থাকে শুষ্ক এবং উষ্ণ। আর শীতে শুষ্ক এবং ঠাণ্ডা। শীতের সময় যতোই পাহাড়ের কাছাকাছি যেতে থাকবেন ততোই ঠাণ্ডা বেশী অনুভূত হতে থাকবে। আর বৃষ্টিও মনে হবে যেন ধীরে ধীরে বাড়ছে। তবে গরমের সময় অর্থাৎ গ্রীষ্মে যতোই পাহাড়ের নিকটবর্তী হতে থাকবেন, ততোই মনে হবে যেন আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ হয়ে উঠছে।
এখানে একটা কথা মনে হয় আপনাদের জানিয়ে রাখা প্রয়োজন। সেটা হলো বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে শীতকালে সাধারণত বৃষ্টিপাত হয় না। কিন্তু ইরানে তার বিপরীত। শীতকালেই ইরানে বৃষ্টিপাত বেশী হয়। অতিরিক্ত ঠাণ্ডা অর্থাৎ তাপমাত্রা শূন্যের দিকে গেলেই ঐ বৃষ্টি বরফ বা তুষারে পরিণত হয়। ইয়াযদ শহরের নির্মাতা সম্পর্কে ইতিহাসবিদদের মাঝে মতবিরোধ রয়েছে। কোনো কোনো ঐতিহাসিকের ধারণা ম্যাসিডোনিয়ার আলেকজান্ডারই এই শহরের গোড়াপত্তন করেন। আলেকজান্ডার ইয়াযদ শহরটিকে শাস্তিপ্রাপ্তদের জন্যে বন্দীশালা ও নির্বাসনস্থল হিসাবে নির্বাচন করেছিলেন, সেজন্যে 'ইয়াযদ' আলেকজান্ডারের বন্দীশালা হিসাবেও প্রসিদ্ধ।
বিরতির আগে বলছিলাম যে, ইয়াযদকে আলেকজান্ডারের বন্দীশালাও বলা হয়ে থাকে। কোনো কোনো বর্ণনায় পাওয়া যায় আলেকজান্ডারের শাসনামলের মাঝামাঝি পর্যায়ে তেহরানের দক্ষিণে অবস্থিত রেই শহরের ক'জন বিখ্যাত ইরানী ব্যক্তি তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করে। আলেকজান্ডার তাদেরকে গ্রেফতার করে এবং ইয়াযদের উপকণ্ঠে পৌঁছে তাদেরকে বন্দী করে রাখে। এই জায়গাটি 'কেসা' বা কারাগার নামে পরিচিত। গ্রীক ভাষায় কেসা শব্দটির অর্থ কারাগার। আলেকজান্ডার ইয়াযদ ত্যাগের পর কারারক্ষীদের সহযোগিতায় বন্দীরা মুক্ত হয়ে ইয়াযদের সার্বিক উন্নয়নের প্রচেষ্টা চালায়। কয়েকজন ইতিহাস বিশেষজ্ঞের মতে ইরানের সাসানী আমলের প্রথম সম্রাট ইয়াযদিগার্দ এই শহরের স্থপতি। এ কারণেই অর্থাৎ ঐ ইয়াযদের নামেই শহরের নামকরণ করা হয়েছে 'ইয়াযদ'। ইয়াযদের ভৌগোলিক অবস্থান, প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং এই প্রদেশের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস নিয়ে আমরা কথা বললাম। কিন্তু ইয়াযদের দর্শনীয় স্থানগুলো সম্পর্কে কিছু বলা হলো না।
পরবর্তী পর্বে আমরা ইয়াযদের দর্শনীয় স্থানগুলো নিয়ে আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ। তবে আজ দূর থেকে পুরো শহরটিতে একবার নজর বুলানো যাক। দূর থেকে তাকালে দেখতে পাবেন, শহর জুড়ে বিশেষ ধরণের ঘর-বাড়ীতে সুসজ্জিত ইয়াযদ। যেহেতু মরুর আবহাওয়া উষ্ণ, সেহেতু গরম বাতাসের উষ্ণতা হ্রাসের স্থানীয় ব্যবস্থায় এবং প্রক্রিয়ায় ঘরগুলো নির্মিত। ঘরের ছাদে বাতাসের বিপরীতে মুখ করে বায়ু সঞ্চালনের চমৎকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মাটির তৈরী এ ঘরগুলো দেখতে খুবই সুন্দর। নব নির্মিত প্রশস্ত সড়কগুলোর পাশে বর্তমানেও ছোট এবং সঙ্কীর্ণ গলি দেখা যায়। গলির ধারে ঘরগুলো পরস্পর লাগোয়া। দেখেই মনে হবে সেই পুরানো কবিতার লাইনটি-মিলে মিশে থাকে ওরা আত্মীয় হেন।"#
পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবুসাঈদ/ ১8
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।