প্রখ্যাত ইরানি মুহাদ্দিস শেখ কুলাইনির (র) জীবন ও অবদান
গত পর্বের ধারাবাহিকতায় আজও আমরা হিজরি তৃতীয় ও চতূর্থ শতকের তথা খ্রিস্টিয় নবম ও দশম শতকের প্রখ্যাত ইরানি মুহাদ্দিস শেখ কুলাইনির (র) জীবন ও অবদান নিয়ে কথা বলব।
গত পর্বের আলোচনায় আমরা জেনেছি 'কিতাব আলকাফি' নামক বিখ্যাত হাদিস গ্রন্থের লেখক হিসেবে খ্যাত ইরানি মনীষী শেখ কুলাইনি ছিলেন একজন বড় মুহাদ্দিস বা হাদিস বিশেষজ্ঞ, ফক্বিহ বা ইসলামী আইনবিদ ও চিন্তাবিদ এবং বহু বইয়ের লেখক।
তিনি ছিলেন ইমাম হাসান আসকারি (আ)'র যুগ ও ইমাম মাহদি (আ)'র অদৃশ্য থাকার প্রাথমিক পর্বের সমসাময়িক যুগের মনীষী। সততা ও নির্ভরযোগ্যতার জন্য খ্যাত কুলাইনি শিয়া ও সুন্নি নির্বিশেষে সবার কাছে শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে অনেক উপাধি পেয়েছিলেন। বিভিন্ন মতাদর্শের লোকদের সংস্পর্শে থেকে তিনি নানা মত ও পথ সম্পর্কে ব্যাপক ধারণা অর্জন করেছিলেন। ফলে ভ্রান্ত মতবাদগুলো খণ্ডনের মত জ্ঞানগত যোগ্যতা তিনি অর্জন করেছিলেন। তার এই বিষয়ক বইয়ের নাম 'আররাদ আলাল কারামিতাহ'। কুলাইনির সমসাময়িক যুগে কারামাতিয়া নামের একটি গোষ্ঠী জরাথ্রুস্ত, ম'নি নামক ধর্ম ও ইসলাম ধর্মের চিন্তাধারার মিশ্রণ ঘটিয়ে একটি সম্প্রদায়ের রূপ নিয়ে ইসলামের পবিত্র বিশ্বাস ও চিন্তাধারার সঙ্গে সংগ্রাম করত।
'আররাদ আলাল কারামিতাহ' শীর্ষক শেখ কুলাইনির বইটিতে কারামাতিয়াদের ভ্রান্ত চিন্তাধারা ও বিশ্বাস তুলে ধরা হয়েছে। ফলে মুসলমানরা এ বইটির মাধ্যমে আসল সত্য তথা প্রকৃত ইসলামকে বোঝার ও বিভ্রান্তি থেকে আত্মরক্ষার সুযোগ পায়।
শেখ কুলাইনির যুগে মুসলমানদের বেশিরভাগই মহানবীর (সা) পবিত্র আহলে বাইতের বক্তব্য ও উপদেশ থেকে বহু দূরে সরে গিয়েছিল। কুলাইনি যখন জন্মগ্রহণ করেন তখন চলছিল ইমাম হাসান আসকারি (আ)'র ইমামতের যুগ। আর তিনি যখন ছাত্র জীবন শুরু করেন তখন ইমাম মাহদি (আ)'র স্বল্পকালীন অদৃশ্য হওয়ার যুগ শুরু হয়। এ যুগে কেউ কেউ হাদিস বিকৃত করে ও মিথ্যা হাদিস বানিয়ে ইমাম মাহদি (আ)'র অনুপস্থিতির অপব্যবহারের চেষ্টা করত। ফলে জাল বা মিথ্যা হাদিসের স্রোতে আসল হাদিস তথা মহানবীর (সা) ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের এই অমূল্য উত্তরাধিকার হারিয়ে যাওয়ার মত বিপজ্জনক পরিস্থিতি দেখা দেয়। হাদিসের ধারক ও বাহকরা মৃত্যু বরণ করায় ও ইমাম মাহদি (আ) অদৃশ্য থাকায় আহলে বাইতের অনুরাগীরা হাদিসের অমূল্য বাণী শোনার সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছিল।
হাদিসের এমন দূর্যোগের দিনে মহানবীর (সা) আহলে বাইতের অনুরাগী আলেমরাসহ নানা মুসলিম মাজহাবের পক্ষ থেকে হাদিস ও ইসলামী বর্ণনা রক্ষার জোরালো আন্দোলন শুরু হয়। এই আন্দোলন এতই জোরদার হয়ে ওঠে যে এই যুগ গবেষকদের কাছে 'হাদিসের যুগ' নামে খ্যাতি অর্জন করে। হাদিসের জন্য তৃষ্ণার্ত ব্যক্তিরা হাদিস বর্ণনাকারীকে খুঁজে বের করার জন্য এক শহর থেকে আরেক শহরে ও নানা মাহফিলে যোগ দিতেন। সুন্নি আলেমরাও হাদিস সংগ্রহের জন্য এই যুগে ব্যাপক প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। তাঁদের প্রচেষ্টা এতই ব্যাপক ছিল যে বলা যায় এ যুগেই তারা বেশিরভাগ হাদিস সংগ্রহ করতে সক্ষম হন। অনেকেই বলেন যে তাদের প্রায় সব কিছুই তারা এ যুগে অর্জন করেছিলেন। হাদিস সংগ্রহের এই যুগটি ছিল প্রায় ১০০ বছরের। এ যুগেই লেখা হয়েছিল সিয়াহ্ সিত্তাহ নামে খ্যাত হাদিস গ্রন্থগুলো। যাই হোক্, এসব হাদিস গ্রন্থ যখন লেখা হয় তখন হাদিসের মূল উৎস বা বক্তা থেকে তিন 'শ বছরের ব্যবধান ঘটে গেছে। অন্যদিকে শিয়া মুসলমানরা দুনিয়া থেকে মহানবীর (সা) বিদায়ের পরও ২৫০ বছর ধরে নিষ্পাপ ইমামদের মুখ থেকে হাদিস ও ইসলামী বর্ণনা শুনেছেন। এই ইমামরা ছিলেন মহানবীরই (সা) বংশধর।
শেখ কুলাইনি এমন সময় হাদিস সংগ্রহের কাজ শুরু করেন যখন ইমাম মাহদির (আ) অদৃশ্য হওয়ার সংক্ষিপ্ত যুগ চলছিল এবং তখনও ইমাম মাহদির কয়েকজন বিশেষ প্রতিনিধির মাধ্যমে এই মহান ইমামের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হত। এমন অনেক মুহাদ্দিস ছিলেন যারা কোনো মাধ্যম বা তৃতীয় ব্যক্তির উদ্ধৃতি ছাড়াই সরাসরি ইমাম হাদি (আ) ও ইমাম হাসান আসকারি (আ)'র কাছ থেকে হাদিস বর্ণনা করতেন। এই যুগে ইমাম (আ) ও জনগণের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে চার জন নায়েব বা প্রতিনিধি সক্রিয় ছিলেন। আর এই চার বিশেষ বা খাস নায়েবের মাধ্যমে মাসুম ইমামদের সঙ্গে শেখ কুলাইনির যোগাযোগ করা অসম্ভব ছিল না।
গবেষকরা মনে করেন শেখ কুলাইনি (র) যুগের চাহিদা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। তিনি যখন বুঝলেন ইসলাম ধর্মকে বিকৃত করা হতে পারে তখন তিনি হাদিস ও মহানবীর (সা) আহলে বাইতের রেখে-যাওয়া জ্ঞান এবং তথ্য সংগ্রহের উদ্যোগ নেন যাতে এই মহান ইমামদের বক্তব্য আঁকড়ে ধরে জনগণ মুক্তির পথ পেতে পারে। এ জন্য তিনি বহু দেশ ও অঞ্চল সফর করে বিপুল হাদিস সংগ্রহ করেন। ফলে বিশ্বের অনেক মানুষের জন্য কিয়ামত পর্যন্ত আহলে বাইতের বক্তব্যের মাধ্যমে সত্যকে জেনে নিরাপদ থাকার সুযোগ খোলা থাকল।
শেখ কুলাইনির যুগে যে কেবল সাধারণ জনগণেরই বিভ্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা ছিল তা নয় আলেম ও পণ্ডিতদেরও ধোঁকার শিকার হওয়ার আশঙ্কা ছিল। কারণ তখন মাসুম ইমামদের সঙ্গে বেশিরভাগ আলেমেরই যোগাযোগ করার সুযোগ ছিল না। অন্যদিকে নির্ভরযোগ্য যেসব উৎস বা সনদ ব্যবহার করে নানা সমস্যা ও বিষয় সংক্রান্ত ইসলামী বিধি-বিধান দেয়া সম্ভব হতে পারত তাও তাদের হাতে ছিল না।
যাই হোক্, এমন এক পরিস্থিতিতে বিশ বছর ধরে বহু কষ্ট স্বীকার করে শেখ কুলাইনি 'আলকাফি' নামক বইটি উপহার দেন সাধারণ মুসলমান ও আলেম সমাজের কাছে যা এক হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে আলো ছড়াচ্ছে। যে কোনো মাজহাবের এমন কোনো গবেষক ও আলেম খুঁজে পাওয়া যাবে না যিনি এ বইয়ের মুখাপেক্ষী নন। শিয়া মুসলমানদের সবচেয়ে পুরনো চার প্রধান বইয়ের অন্যতম এ বই নির্ভরযোগ্য হাদিস ও ইসলামী আইনের সবচেয়ে বড় উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়। এইসব বিষয়ে এরচেয়ে নির্ভরযোগ্য আর কোনো বই লেখা হয়নি।
শিয়া মুহাদ্দিস ও মুজতাহিদ আলেমরা প্রায় ১১০০ বছর ধরে শেখ কুলাইনির আলকাফি বইটিকে ইসলামী বিধি-বিধান খুঁজে বের করার উৎস হিসেবে ব্যবহার করছেন। আমরা সম্ভব হলে আগামী পর্বেও এ বিষয়ে আরও কথা বলব।#
পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/ ২২
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।