প্রখ্যাত ইরানি মুহাদ্দিস শেখ কুলাইনির (র) অবদান
গত পর্বের ধারাবাহিকতায় আজও আমরা হিজরি তৃতীয় ও চতূর্থ শতকের তথা খ্রিস্টিয় নবম ও দশম শতকের প্রখ্যাত ইরানি মুহাদ্দিস শেখ কুলাইনির (র) জীবন ও অবদান নিয়ে কথা বলব।
প্রখ্যাত ইরানি মুহাদ্দিস শেখ কুলাইনি (র) ছিলেন যুগ ও স্থানের চাহিদা সম্পর্কে সচেতন বহুমুখী প্রতিভাধর আলেম। জনগণের ধর্মীয় বিশ্বাসের সুরক্ষার জন্য তিনি হাদিস সংগ্রহের মাধ্যমে বড় ধরনের অবদান রেখেছিলেন। আর এ জন্য তিনি কুফা, কোম ও বাগদাদে হিজরত করেছিলেন। শেখ কুলাইনি এমন অনেক ব্যক্তির কাছ থেকে হাদিস সংগ্রহ করেছিলেন যারা সরাসরি মাসুম বা নিষ্পাপ ইমামদের মুখ থেকে হাদিস শুনেছেন। কুলাইনি কোমে 'আবুল হাসান আলী বিন ইব্রাহিম বিন হাশিম কুমি'র মত প্রখ্যাত হাদিস-বিশেষজ্ঞ ও বর্ণনাকারী সান্নিধ্য পেয়েছিলেন। ইনি হাদিসের একজন বিশ্বস্ত বর্ণনাকারী হিসেবে ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। শেখ কুলাইনি'র আল-কাফি বইয়ে হাদিসের সনদগুলোর এক তৃতীয়াংশ ক্ষেত্রে তথা সাত হাজার ১৪০টিরও বেশি হাদিসের সনদের ধারাবাহিকতায় আবুল হাসান আলী বিন ইব্রাহিম বিন হাশিম কুমি'র নাম দেখা যায়। তাই কুলাইনি'র আল কাফি বইটির পাশাপাশি হাশিম কুমি'র নামও অমর হয়ে আছে।
হাদিস সংগ্রহ করতে গিয়ে কুফায় গিয়ে প্রখ্যাত হাদিস-বিশেষজ্ঞ ও বর্ণনাকারী আহমাদ বিন মুহাম্মাদ বিন সায়িদ হামেদানির সান্নিধ্য পেয়েছিলেন শেখ কুলাইনি। এই সায়িদ হামেদানি ছিলেন প্রখর স্মৃতিশক্তির অধিকারী ও হাদিসের এক অসাধারণ হাফেজ। তিনি ছিলেন যাইদি জারুদি মাজহাবের অনুসারী অত্যন্ত ধার্মিক ও সৎ-সাধক প্রকৃতির ব্যক্তিত্ব। নির্ভরযোগ্যতার কারণে সব মাজহাবের ব্যক্তিরা তাঁর হাদিস গ্রহণ করতেন। এ ধরনের বড় বড় অনেক মুহাদ্দিসের সান্নিধ্যে থেকে শেখ কুলাইনি যখন বাগদাদে আসেন তখন তিনি সব মহলে বড় আলেম ও পরহিজগার হিসেবে শ্রদ্ধা অর্জন করেন। বাগদাদেই তিনি তার সবচেয় বড় কিতাব 'আলকাফি' রচনা করেন।

শেখ কুলাইনি অনেক বই লিখেছিলেন। তার বইগুলোর মধ্যে 'আররিজাল',
'আররাদ আলাল কারামিতাহ', রাসায়েল আল আয়েম্মা, তাবির আররুইয়া এবং মহানবীর (সা) আহলেবাইতের প্রশংসা ও গুণ বর্ণনা শীর্ষক একটি কবিতার বইয়ের কথা উল্লেখ করা যায়। দুঃখজনকভাবে তার এসব বইয়ের কোনো কপিই টিকে থাকেনি।
শেখ কুলাইনির সবচেয়ে বড় ও বিখ্যাত বই 'আলকাফি'। ২০ বছরের অক্লান্ত সাধনার ফসল ছিল এ বই। এ বই আহলে বাইতের অনুরাগী শিয়া মাজহাবের চারটি প্রধান বা বিখ্যাত বইয়ের অন্যতম এবং হাদিস ও ইসলামী আইন বা ফিকাহ্'র অন্যতম প্রধান উৎস। হাদিসের ক্ষেত্রে এরচেয়ে নির্ভরযোগ্য দ্বিতীয় কোনো বই নেই বলে অনেকেই মনে করেন। চার বিখ্যাত বইয়ের মধ্যে এ বইটি সবচেয়ে আগে লেখা হয়েছে। ইমাম মাহদি (আ)'র স্বল্প সময়ের অদৃশ্য থাকার কালে লেখা এ বইয়ের হাদিসের সনদগুলোর ফিরিস্তি সংক্ষিপ্ত হওয়ায় বইটির বিশ্বাসযোগ্যতা বেড়েছে।
প্রায় ১১০০ বছর ধরে আলকাফি নামের বইটি শিয়া মুজতাহিদ বা নিজস্ব গবেষণার ভিত্তিতে ফতোয়া দেয়ার যোগ্য ইসলামী আইনবিদ বা ফকিহ্ ও মুহাদ্দিসদের জন্য উৎস বা আকর-গ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃত। বিভ্রান্ত, অজ্ঞ ও অচেতন মুসলমানদের কাছে মহানবীর (সা) আহলে বাইতের দৃষ্টিতে ইসলামী বিধি-বিধান ও সঠিক ইসলামী আকিদা বা বিশ্বাস তথা পরিপূর্ণ ইসলামের সব বিষয়গুলো তুলে ধরার জন্য একজন ধার্মিক ব্যক্তির অনুরোধের প্রেক্ষাপটে শেখ কুলাইনি (র) এ বই লেখা শুরু করেন।
শেখ কুলাইনি'র আলকাফি বইয়ে রয়েছে মহানবীর (সা) ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের ১৬ হাজার হাদিস। এ বইয়ের রয়েছে তিনটি মূল অংশ: উসুল বা মৌলিক নীতিমালা অধ্যায়, ফুরু বা দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রধান ইসলামী বিষয়াদি এবং তৃতীয় অধ্যায় বা অংশে রয়েছে বিবিধ বিষয়।
এ বইয়ের মৌলিক নীতিমালার অংশে রয়েছে মুসলমানদের মূল বিশ্বাস ও নীতি-নৈতিকতা সংক্রান্ত আলোচনা যা আটটি পর্বে বিন্যস্ত। শেখ কুলাইনি প্রথমেই স্রস্টাকে জানার ক্ষেত্রসহ নানা ক্ষেত্রে আকল্ বা বিবেক-বুদ্ধির গুরুত্ব সম্পর্কিত হাদিস ও ইসলামী বর্ণনাগুলো তুলে ধরেছেন। এরপর তিনি জ্ঞান অর্জন ও এর আদব সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। বিশ্বাস বা আকিদার ভিত্তিগুলো যে সঠিক তা প্রমাণ করতেই শেখ কুলাইনি এই পন্থার আশ্রয় নিয়েছেন। জ্ঞান সংক্রান্ত আলোচনার পর তিনি ইসলামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রধান বিশ্বাস তথা একত্ববাদ ও স্রস্টার পরিচিতি সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। এরপর কুলাইনি নবুওত ও ইমামত সম্পর্কিত হাদিস বর্ণনা করেছেন।
শেখ কুলাইনি'র আলকাফি বইয়ের মৌলিক নীতিমালা অংশে নবুওত ও ইমামত সংক্রান্ত হাদিস বর্ণনার পর নৈতিক ও প্রশিক্ষণমূলক কিছু বিষয়ের আলোচনা রয়েছে। এসবের মধ্যে রয়েছে: নম্রতা, ধৈর্য, অল্পে তুষ্টি, গিবত বা পরনিন্দার কুফল , দোয়া ও কুরআনের ফজিলত এবং মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক, যোগাযোগ আর লেনদেনের আদব-কায়দা ইত্যাদি। নৈতিক বিষয়ের আলোচনাকে কুলাইনি যেভাবে সাজিয়েছেন তাতে বোঝা যায় তিনি আলকাফি বইটি রচনার ক্ষেত্রে কেবল বিশ্বাস সংক্রান্ত বা আইন সংক্রান্ত হাদিসেই সন্তুষ্ট থাকেননি। বইটির নৈতিক অধ্যায়ের আলোচনা খুবই আকর্ষণীয়, বিচিত্রময় ও সবার জন্যই ব্যবহার-উপযোগী ও উপকারি।
শেখ কুলাইনির আলকাফি বইয়ের দ্বিতীয় মূল অংশে তথা ফুরু বা দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রধান ইসলামী বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে নামাজ, রোজা, হজ, যাকাত প্রভৃতির ব্যাপারে আলোচনা ও গভীর বিশ্লেষণ। এই অংশটি সাধারণত ইসলামী আইনবিদ বা ফক্বিহরা বেশি ব্যবহার করেন। শেখ কুলাইনির আলকাফি বইয়ের তৃতীয় মূল অংশ বা অধ্যায়ে রয়েছে বিবিধ বিষয়। তাই এ অংশের নাম হল রওজা বা বাগান। এতে রয়েছে ৫৯৭টি হাদিস যার মধ্যে নানা ভাষণ, মাসুম ইমামদের উপদেশ-সম্বলিত নানা চিঠি, বিভিন্ন কাহিনী ও ঐতিহাসিক বিষয়ের বর্ণনার মত বিচিত্রময় আলোচনা। এ বইটির অন্য দুই মূল অধ্যায় বা অংশের সঙ্গে রওজা অংশের পার্থক্য খুবই কম। রওজা অংশের আলোচনাগুলোকে শিরোনাম ও উপশিরোনামের আওতায় সাজানো হয়নি। আলকাফি বইটিতে হাদিস ছাড়াও দর্শন বা কালাম-শাস্ত্রীয় আলোচনা, নৈতিক, আইনি, সামাজিক ও ঐতিহাসিক বিষয়সহ আরও অনেক বিষয়ের আলোচনা থাকায় তা ইসলামের এক অসাধারণ পরিপূর্ণ বইয়ে পরিণত হয়েছে।#
পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/ ২৪
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।