অক্টোবর ২৪, ২০২০ ১৬:৩০ Asia/Dhaka

বলেছিলাম যে, বিশাল একটি দেশ ইরান। এ দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ইতিহাস-ঐতিহ্য,পুরাতত্ত্ব আর সংস্কৃতির বিচিত্র সমৃদ্ধ উপাদান।

গত আসরে আমরা ইরানের ঐতিহাসিক প্রদেশ ইয়াযদের দিকে গিয়েছিলাম। ইয়াযদ বাজার এবং জামে মসজিদের সঙ্গে পরিচিত হবার চেষ্টা করেছি। আসরের সমাপ্তি টেনেছিলাম ফরাসি পর্যটক সাহরানূরদির সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া বক্তব্যের মধ্য দিয়ে। তিনি বলেছিলেন:

পণেরো দিনের ইরান সফরে আমরা যে গ্রামেই গেছি বা যে শহরেই গেছি, সেখানকার মানুষেরা আমাদেরকে ভীষণ ভালবেসেছেন,আমাদেরকে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করেছেন। বিশেষ করে তাঁদের চমৎকার আতিথেয়তার কথা জীবনে কখনও ভুলবো না। এই আতিথেয়তার কথা স্মরণে রেখে আজ আমরা ইয়াযদের ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যের সাথে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেব। স্থাপত্য একটা দেশের ঐতিহ্য ও সভ্যতাকে তুলে ধরে। ইতিহাসের সাক্ষ্য দেয় প্রাচীন স্থাপত্যগুলো। তাই এবারে ইয়াযদের প্রাচীন স্থাপত্যগুলোর বর্ণনা তুলে ধরব। ইয়াযদ শহরটি যে কত প্রাচীন তা বোঝা যায় এ শহরের বাড়ী-ঘরগুলোর দিকে তাকালে।

ইয়াযদ শহরের প্রাচীন এলাকার দিকে তাকালে নজরে পড়বে আধুনিক স্থাপত্যের সাথে প্রাচীন স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্য। প্রাচীন বাড়ীগুলোর দেয়াল বেশ উঁচু উঁচু, উঠোনের মত খোলা জায়গার চারপাশে কক্ষগুলো স্থাপিত, উঠোনের ঠিক মাঝখানে বড়োসড়ো হাউজ আর প্রশস্ত বেইসম্যান্ট বা মাটির নীচের কক্ষগুলো গ্রীষ্মের গরমে বিশ্রামের জন্য বিশেষভাবে বানানো। তাছাড়া গ্রীলের দরজা-জানালা, আয়নার কারুকাজ করা সুসজ্জিত কক্ষ, সিলিং কিংবা দেয়ালে কারুকাজময় প্লাষ্টার ইত্যাদি ইয়াযদের প্রাচীন ঘরবাড়ীর অনন্য বৈশিষ্ট্য। এইসব ঐতিহ্যবাহী নিদর্শন আজো লক্ষ্য করা যায় । তবে বর্তমানে ইয়াযদে প্রাচীন যে নিদর্শনগুলো দেখতে পাওয়া যায়, সেগুলোর প্রাচীনত্ব খুব বেশী নয়, দুই শতাব্দীর মতো।

ইয়াযদের প্রাচীন বাড়ীগুলোর সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয়টি হলো বায়ু সঞ্চালন ব্যবস্থা বা ভেন্টিলেশান সিস্টেম। এই সিস্টেমটি যেমন চমৎকার, তেমনি মেধারও পরিচয়বাহী। ভেন্টিলেশান সিস্টেমটি লবণাক্ত মরু অঞ্চলের শুষ্ক আবহাওয়ার উপযোগী করে বানানো। বাসার ভেতরে ঠাণ্ডা বাতাস প্রবেশ করানো এবং গরম বাতাস বাসা থেকে বের করানোর চমৎকার এই ভেন্টিলেশান সিস্টেমের ফলে স্থাপত্যকলার ওপর এর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। কারণ এই ভেন্টিলেশান বা বায়ুসঞ্চালন প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ আলাদা প্রক্রিয়ায় তৈরি। ছাদের উপর থেকে যে নলের মাধ্যমে বাসার ভেতরে বাতাস প্রবেশ করে, সেই নলটি বাসা বানানোর সময়ই দেয়ালের ভেতর দিয়ে প্রত্যেক রুমে রুমে সংযুক্ত করা হয়। ‌এটাকে ক্যানেল বলা হয়।

বাসার ভেতরের উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণের সিস্টেম নিয়ে কথা বলছিলাম বিরতির আগে। ঠাণ্ডা বাতাস ঘরে ঢোকানোর পাশাপাশি আবার গরম বাতাস রুম থেকে বের করার জন্যও বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে। এসব সিস্টেমের কারণে বাসার ডিজাইন একটু ভিন্ন রকমের হয়। ঠাণ্ডা বাতাস আসা এবং গরম বাতাস বের হবার কারণে বাসার ভেতরের পরিবেশ সবসময় তাপ-অনুকূলে রাখা যায়। বাতাসকে ঠাণ্ডা করে উপভোগ্য করে তোলার প্রক্রিয়াটি বেশ সহজ। ছাদের উপরে সরু এবং চার কোণাকৃতির একটি টাওয়ার চিমনীর মতো করে বানানো হয়। এর উপরে থাকে চারদিক খোলা রেখে তৈরী করা একটি ঢাকনা।

মজার ব্যাপার ব্যাপার হলো টাওয়ারের ভেতর দিয়ে বাইরে থেকে আসা বাতাস তার উষ্ণতা পরিবর্তন করে ঘরের ভেতর প্রবেশ করে। বাসার ভেতরে কাঠের তৈরী বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে টাওয়ারের ভেতর দিয়ে বয়ে আসা বাতাসের একাংশ বেইসমেন্ট বা মাটির নীচে প্রবেশ করে। মাটির নীচে ঠাণ্ডা পানির হাউজ বানানো আছে। টাওয়ারের ভেতর দিয়ে আসা বাতাস সরাসরি ঐ হাউজে চলে যায়। হাউজে পানির সংস্পর্শে বাতাস ঠাণ্ডা হয়ে যায়। ঐ ঠাণ্ডা বাতাসই ঘরের ভেতর প্রবেশ করে। বাতাসের উষ্ণতা পরিবর্তনের এই কৌশল স্থানীয় হলেও যারা এই প্রক্রিয়াটির উদ্ভাবন করেছেন তারা নিঃসন্দেহে যথেষ্ট মেধাবী এবং সৃষ্টিশীল প্রতিভার অধিকারী।

স্থানীয় কুলার সিস্টেম নিয়ে কথা বলছিলাম বিরতির আগে। এখানে আরেকটি বিষয় জানিয়ে রাখা ভালো, তাহলো: ইরানে কিন্তু বিজ্ঞানের আবিষ্কৃত এয়ার কন্ডিশনারের বাইরেও স্থানীয় পদ্ধতির এয়ার কুলার ব্যবহৃত হয়। শুষ্ক আবহাওয়ার ফলে এই পদ্ধতিটি ইরানের জন্য উপযুক্ত। পদ্ধতিটি হলো ছাদের উপরে স্টিলের তৈরি একটি বক্সের মতো বস্তু থাকে। বক্সের ছাদ পুরোপুরি ঢাকা আর তিন দিকের পাল্লাগুলো গ্রিলের মতো কাটা। ওই কাটা গ্রিলে বিশেষ পদ্ধতিতে খড়কুটো লাগানো থাকে। ফার্সিতে এগুলোকে বলে পুশল। পুশলের ওপর পাহাড়গলা ঠাণ্ডা পানি অনবরত পড়ে ভিজে যায়। ভেতরে ছোট্ট মটর চালিত এক ধরণের পাখা বিদ্যুতের সাহায্যে ঘুরতে থাকে। পুশলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ওই পাখার বাতাস ক্যানেলের মাধ্যমে বাসায় পৌঁছে যায়। পানি ছুঁয়ে আসা ঐ বাতাস ঘরের ভেতরটা ঠান্ডা রাখে।

কিন্তু ইয়াযদের প্রাচীন পদ্ধতি কুলারের আধুনিক প্রক্রিয়া থেকে সম্পূর্ন ভিন্ন। ইয়াযদে খাবার পানির ব্যবস্থাও একটু ভিন্ন ধরণের। যেহেতু মরুভূমি অঞ্চল, সেহেতু খাবার পনির সঙ্কট থাকাটাই স্বাভাবিক। এই সঙ্কট নিরসনের জন্য মাটির নীচের প্রাকৃতিক পানিই একমাত্র উপায় হিসাবে গৃহীত হয়েছে। বাংলাদেশেও অতীতে পানির জন্য যে ইন্দ্রা তৈরী করা হতো, ঐ পদ্ধতিতেই ইয়াযদের অধিবাসীরা গভীর কূপ বা ইন্দ্রা খনন করেছে। ভাবতেও অবাক লাগে যে, ইয়াযদে তিন হাজার একশ' একত্রিশটি কূপ বা ইন্দ্রা ছিল। অবশ্য এগুলোর মধ্যে ৫১৬টি কূপ নষ্ট হয়ে গেছে। এইসব ইন্দ্রা বর্তমান ইয়াযদবাসীদের পূর্বসূরী অর্থাৎ তাদের পূর্বপুরুষদের মূল্যবান স্মৃতির নিদর্শন। পানির সন্ধানে তারা কী ধরণের হাঁড় ভাঙ্গা খাটুনি খেটেছেন, কতো অক্লান্ত পরিশ্রম করে তারা ঐসব কূপ খনন করে গেছেন, তা নিমিষেই ভেসে ওঠে কল্পনায়। যাই হোক, ইন্দ্রার পানি সাধারণত ঠাণ্ডা। ফলে ঐ পানি ছুঁয়ে আসা বাতাস যে ঠাণ্ডা হবে তাতে আর সন্দেহ কি। #

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবুসাঈদ/ ২৪

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ