ইরানের আরেফ ও মরমি কবি হোসাইন বিন মনসুর হাল্লাজ
গত কয়েক পর্বের ধারাবাহিকতায় আজও আমরা ইরানের আরেফ ও মরমি কবি হোসাইন বিন মনসুর হাল্লাজ-এর জীবন নিয়ে কথা বলব।
মনসুর হাল্লাজ মক্কা থেকে বাগদাদে ফেরার পর তথা ২৯৪ হিজরিতে বক্তব্য ও বক্তৃতা দেয়াসহ নানা ধরনের তৎপরতা শুরু করেন। তিনি বাগদাদেই প্রথমবারের মত জনগণকে উপদেশ দিয়ে বক্তব্য রাখেন এবং নিজ যুগের কপট সুফিদের স্বরূপ তুলে ধরেন। সরব হওয়ার জন্য মনসুর হাল্লাজ সুফির পোশাক পরা ছেড়ে দেন। সাধারণত সে সময়ের সুফিরা নীরব থাকতেন। তিনি বেশ উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে মহান আল্লাহকে স্মরণ করতেন এবং নামাজ, রোজা ও ইবাদতের কথা বলতেন। কোনো ভয় ও দুঃশ্চিন্তা ছাড়াই মৃত্যু সম্পর্কেও কথা বলতেন হাল্লাজ। তিনি স্বাধীনভাবে জনগণের সঙ্গে কথা বলতেন এবং বেশি কথা বলতেন ব্যবসায়ী ও মুদ্রা ব্যবসায়ীসহ শিক্ষিত লোকদের সঙ্গেই। খুব অল্প সময়েই তারা এই ব্যতিক্রমী আরেফের অনুরাগী হয়ে যেত। বিশেষ করে ইরানিদের মধ্যে মনসুর হাল্লাজ-এর অনুরাগীর সংখ্যা ছিল ব্যাপক। গবেষকরা মনে করেন এই বিপুল সংখ্যক অনুরাগীর সবাই যে তাদের প্রিয় ব্যক্তিত্ত্বের রহস্যময় বক্তব্যের অর্থ বুঝত তা নয়, কিন্তু তবুও তারা ওইসব বক্তব্য শুনে আকৃষ্ট হত।
আসলে জনগণ সব সময় একজন সংস্কারক ও ত্রাণকর্তার প্রতীক্ষায় ছিল। তারা মনসুর হাল্লাজকে সে দৃষ্টিতেই দেখত। তারা চিঠি লিখত কথিত এই সংস্কারকের কাছে ও তাদের নানা অভাবের কথা উল্লেখ করত। মনসুর হাল্লাজ-এর দিকে জনগণের এমন ভিড় ও আগ্রহ দেখে বাগদাদের আলেম ও ফকিহ্ সমাজ ভীত-সন্ত্রস্ত হলেন এবং সেখানকার শাসকগোষ্ঠীর মধ্যেও জেগে ওঠে নানা সন্দেহ।
মনসুর হাল্লাজ-এর অনুরাগী যেমন ছিল অনেক তেমনি তার অনেক শত্রুও ছিল। এই শত্রুদের অনেকেই ছিল ব্যাপক ক্ষমতাধর ও প্রভাবশালী। বাগদাদের আলেম ও ফকিহ্ বা ইসলামী আইনবিদরা মনসুর হাল্লাজ-এর বক্তব্য ও চিন্তাধারাকে সঠিক বলে মনে করতেন না এবং তারা এসবের বিরোধিতা শুরু করেন। বাগদাদের কোনো কোনো সুফি যারা ছিলেন সাধারণত সুন্নি মাজহাবের অনুসারী তারা দাবি করলেন যে মনসুর হাল্লাজ যাদু ও প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছে এবং কোনো কোনো ফকিহ বললেন যে- এই ব্যক্তি নিজেকে প্রভু বলে দাবি করছে! ফলে মনসুর হাল্লাজ-এর প্রকৃত অবস্থা বোঝা বেশিরভাগ জনগণের জন্য আরও অস্পষ্ট হয়ে পড়ে।
২৯৭ হিজরিতে যখন ফকিহদের মধ্য থেকে মুহাম্মাদ বিন দাউদ মনসুর হাল্লাজকে কাফের বলে ঘোষণা দেন ও তাকে হত্যার হুকুম দেন তখনও বাগদাদের জনগণের কাছে এই রহস্যবাদী ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো ধারণা ছিল না। কেউ কেউ মনসুর হাল্লাজকে পাগল ও কেউ কেউ তাকে জাদুকর আবার কেউ কেউ তাকে তাঁকে বড় মাপের দরবেশ মনে করতেন। কেউ কেউ বলতেন তাঁর দোয়া কবুল হয় ও অলৌকিক ঘটনা দেখানোর ক্ষমতা আছে। এ অবস্থায় ইবনে দাউদের ওই ঘোষণার পরও কেউ মনসুর হাল্লাজকে গ্রেফতার করতে যায়নি এবং ইবনে দাউদের মৃত্যুর বহু বছর পরও আহওয়াজ, বাগদাদ ও শুষ অঞ্চলে নিজস্ব চিন্তাধারা প্রচার করে বেড়াতেন মনসুর হাল্লাজ।
অনেকেই ইরানি এই আধ্যাত্মিক সাধককে সম্মান করতেন এবং সাধারণ নীতিমালায় তার হস্তক্ষেপকেও তারা সমর্থন করতেন। আর এ কারণেই মনসুর হাল্লাজ মন্ত্রী ও আলেমদের কর্তব্য সম্পর্কে একটি পুস্তিকা লেখেন এবং তা হুসাইন বিন হামেদ'ন নাসর্ ও ইবনে ঈসাকে উপহার দেন।
২৯৮ হিজরিতে একদল সুন্নী সংস্কারকামীর নেতৃত্বে আব্বাসীয় খেলাফতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ দেখা দেয়। কিন্তু এই বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়। ক্ষমতা ফিরে পায় শিশু খলিফা আল মুক্তাদার আব্বাসি! এ সময় অর্থ বিভাগের মন্ত্রী হন এক্ষেত্রে দক্ষ বিশেষজ্ঞ ইবনে ফোরাত। তিনি আত্মগোপনে থাকা আমির হুসাইন বিন হামেদ'নকে খুঁজতে থাকেন। এই নেতারই উপদেষ্টা ও ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব ছিলেন মনসুর হাল্লাজ। এই ইবনে হামেদ'নকে ধরার অভিযানেই আটক করা হয় মনসুর হাল্লাজকে। ইবনে ফোরাত প্রথম দিকে মনসুর হাল্লাজকে নিরাপদ হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন এবং তার সব সঙ্গীকে খুঁজে বের করে তাদেরকেও আটক করার নির্দেশ দেন। মনসুর হাল্লাজ এ সময় শুষ অঞ্চলে লুকিয়ে ছিলেন। পুলিশ বা নিরাপত্তা বাহিনী তাকে তিন বছর ধরে খুঁজছিল। এক পর্যায়ে ওই গোপন আস্তানাটির সন্ধান পায় তারা। এ সময় মনসুর হাল্লাজ নিজের পরিচয় গোপনের চেষ্টা করেন। অবশেষে তারই এক বিশ্বাসঘাতক সমর্থকের সহায়তায় মনসুর হাল্লাজকে সনাক্ত করা সম্ভব হয় ও তাকে বাগদাদে নিয়ে যাওয়া হয়।
বিশিষ্ট ইরানি গবেষক জাররিনকুবের মতে ৩০১ হিজরির রবিউল আউয়াল মাসে মনসুর হাল্লাজকে বিচারের জন্য বাগদাদে আনা হয়। শত্রুরা তার বিরুদ্ধে নানা ধরনের মারাত্মক অভিযোগ আনে। বলা হয় যে মনসুর হাল্লাজ আহওয়াজ ও বাগদাদে নিজেকে প্রভু বলে দাবি করেছেন এবং তিনি যেসব চিঠি বন্ধু ও অনুসারীদের কাছে পাঠিয়েছেন সেসবে হুলুল বা একাত্ম হয়ে যাবার কথা বলেছেন! কিন্তু মনসুর হাল্লাজ দাবি করেন যে তার আসল অপরাধ হল একত্ববাদের প্রতি তাঁর বিশ্বাস যা তাঁর শত্রুরা বুঝতে ও মেনে নিতে পারেনি। অধ্যাপক জাররিনকুবের মতে, মনসুর হাল্লাজের পরবর্তী আরেফরা মনে করতেন যে, তাঁর অপরাধ ছিল এটা যে তিনি আধ্যাত্মিক রহস্যময় বিষয় খোলামেলাভাবে তুলে ধরতেন!
মনসুর হাল্লাজের বিচার অনুষ্ঠানে তাকে কপট মুসলমান ও কারামাতিয়া সম্প্রদায়ের লোক বলে প্রমাণ করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু মন্ত্রী আলী বিন ঈসার নির্দেশে হাল্লাজের দাড়ি কামিয়ে দেয়া হয় এবং তাকে সেতুর ওপর দুইদিন ক্রুশ-বিদ্ধ করে রাখা হয়। দুই দিন পর তার সম্পর্কে তদন্ত অব্যাহত রাখতে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। এ পর্যায়ে বিভিন্ন কারাগারে ৮ বছর থাকেন মনসুর হাল্লাজ। এ সময় কারাবন্দিদের মধ্যে উপদেশ দেয়া ও প্রচার কাজ চালানোর অনুমতি পান তিনি। কারাগারে থাকা অবস্থায় হাল্লাজ খলিফার সুদৃষ্টিতে আসেন। বলা হয় খলিফার একবার জ্বর হলে হাল্লাজ তাকে রোগমুক্ত করেন। ৩০৫ হিজরিতে হাল্লাজ ওমানি যুবরাজের মৃত তোতা পাখিকে জীবিত করেন। ফলে তার শত্রুর সংখ্যা আরও বেড়ে যায়। ৩০৪ থেকে ৩০৬ হিজরিতে ইবনে ফোরাত পুনরায় মন্ত্রী হন। কিন্তু খলিফার মা হাল্লাজের অনুরাগী হওয়ায় আবারও হাল্লাজের বিচার করার সাহস তার ছিল না। #
পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/ ০৭
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।