নভেম্বর ১১, ২০২০ ১৯:৩০ Asia/Dhaka

গত কয়েক পর্বের ধারাবাহিকতায় আজও আমরা ইরানের আরেফ ও মরমি কবি হোসাইন বিন মনসুর হাল্লাজ-এর জীবন নিয়ে কথা বলব।

মনসুর হাল্লাজের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা সম্পর্কে বর্ণনায় এসেছে: প্রাণদণ্ড কার্যকর করার দিনের ভোর বেলায় মনসুর হাল্লাজের হাত বেঁধে রাখা হয়েছিল এবং তার পা দুটিও ছিল খুব ভারী শেকলে বাঁধা। কতলের মঞ্চের কাছে যখন তাকে নিয়ে আনা হয় তখনও তার মধ্যে কোনো ভয় দেখা যায়নি। নিজের কাজ ও আচরণের জন্য কোনো অনুশোচনাও তার মধ্যে দেখা যায়নি। তিনি বরং হাসছিলেন ও কৌতুকময় ভঙ্গীতে হাঁটছিলেন। যারা তার মৃত্যুদণ্ড দেখার জন্য জড় হয়েছিল তাদের সঙ্গে বন্ধুসুলভ সংলাপ চালিয়ে গেছেন মনসুর হাল্লাজ।

মনসুর হাল্লাজকে শেষবারের মত দেখতে তার চলার পথে তার পেছনে পেছনে বহু মানুষ জড় হয়েছিল। সবাই দুঃখ-ভারাক্রান্ত মন নিয়ে নীরব ছিল। মনসুর হাল্লাজ এত উৎফুল্ল ছিলেন যেন তিনি তার প্রেমাস্পদের সঙ্গে মিলিত হতে যাচ্ছেন! কতলের মঞ্চের কাছে এসে তিনি বিখ্যাত সুফি সাধক আবুবকর শিবলিকে দেখলেন। শোকার্ত শিবলির চোখ ছিল অশ্রুসজল।

মনসুর হাল্লাজ শিবলিকে অনুরোধ করলেন তিনি যেন তার জায়নামাজটা কেবলামুখি করে বিছিয়ে দেন। মনসুর হাল্লাজ গভীর প্রশান্তি নিয়ে দুই রাকাত নামাজ পড়েন ও মোনাজাত করেন। তিনি তার হত্যাকারীদের জন্যও দোয়া করেন ও তাদের ক্ষমা করে দেন। এরপর প্রফুল্ল চিত্তে বীরের মতই এগিয়ে যান কতলের মঞ্চের সিড়ি বেয়ে। এরপর তিনি সমবেত জনতার দিকে তাকিয়ে উচ্চস্বরে বলেন:  ওয়াজদ্‌-এর জন্য তথা আধ্যাত্মিক মিলনের আনন্দে আত্মহারা হওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট যে এক খোদা তাকে নিজের দিকে এক করে নিয়েছেন! শেষ মুহুর্তেও কেবল এক আল্লাহকে নিয়েই তিনি ভাবছিলেন। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তার চিন্তা ওই পবিত্র শব্দের দিকে নিবদ্ধ ছিল যা তার মুখ থেকে ‘আনাল হক্ব বা আমিই খোদা’ বলে বের হয়েছিল।

 

প্রখ্যাত মরমি কবি ও সুফি সাধক ফরিদউদ্দিন আত্তার তার তাজকিরাতুল আওলিয়া বা ওলিদের স্মরণ তথা তাদের জীবনী সংক্রান্ত বইয়ে মনসুর হাল্লাজের মৃত্যুদন্ড কার্যকর হওয়ার তিক্ত ঘটনাটি বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেন, 

মনসুর হাল্লাজ যখন কতলের মঞ্চের সিঁড়িতে পা দেন তখন তাকে তার অবস্থা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন: কতলের মঞ্চ হচ্ছে মানুষের মেরাজ বা আধ্যাত্মিক উর্ধ্বগমনের স্থান। এরপর হাত তুলে মোনাজাত করেন ও আল্লাহর কাছে যা যা চাইতেন তা চাইলেন।... এরপর ভয়ানক ও কদাকার জল্লাদ আবুল হারেস কাছে এসে মনসুর হাল্লাজকে এমন প্রচণ্ড চড় মারে যে তার কপাল ফেটে যায় ও নাক দিয়ে রক্ত ঝরতে থাকে।  

হুসাইন বিন মনসুর হাল্লাজকে এক দিন ধরে কতলের মঞ্চ বা ফাঁসি-কাষ্ঠে রাখা হয় ও তার ওপর নির্যাতন করা হয়। সন্ধ্যার সময় ক্লান্ত এই বৃদ্ধ সুফি-সাধককে কারাগারে ফিরিয়ে আনা হয় এবং ৩০৯ হিজরির ২৪ জিলহজ তাকে পুনরায় বধ্যভূমিতে আনা হয়।  এ দিনের ঘটনা প্রসঙ্গে আত্তার লিখেছেন:

মনসুর হাল্লাজের দিকে যে যার ইচ্ছামত পাথর মারছিল। আবুবকর শিবলি হাল্লাজের অনুমতিসাপেক্ষে তার দিকে একটি মাটির ঢিল নিক্ষেপ করেন। এ সময় মনসুর হাল্লাজ আহ্ শব্দটি উচ্চারণ করে প্রথমবারের মত তার ব্যথার অনুভূতি প্রকাশ করেন। তাকে প্রশ্ন করা হল: এতসব পাথর নিক্ষেপের সময় কোনো আহ্ উহ্‌ করলে না! কিন্তু এই মাটির ঢিলের আঘাতে আহ্‌ করার রহস্যটা কী? তিনি বললেন: ওরা তো অজ্ঞ ও বাধ্য ছিল! কিন্তু শিবলি বাস্তবতা জানতো বলে তার কাজে মনে আঘাত পেয়েছি যে কাজটি তার করা উচিত ছিল না!

মনসুর হাল্লাজের হাত যখন বিচ্ছিন্ন করা হয় তখন তিনি হেসে ওঠেন। প্রশ্ন করা হল: হাসলেন কেন? তিনি বললেন: হাত বাঁধা মানুষের হাত কাটা সহজ! এর মাধ্যমে তিনি বিভিন্ন গুণ বা বৈশিষ্ট্যের হাত কাটাকে ইঙ্গিত করেছেন। এরপর তার পা দুটি কাটা হলে তিনি মুচকি হেসে বলেন: এ দুটি পা দিয়ে মাটির দুনিয়ায় ভ্রমণ করতাম! অন্য পা আছে যা দিয়ে এখন দুই জগতেই এমনই ঘুরে বেড়াব যে পারলে ওই দুটি পা কাটো!

এরপর হাল্লাজ রক্তাক্ত হাত দুটিতে মুখ মাখিয়ে নেন ও নিজের বাহু দুটিকেও রক্তাক্ত করেন। বলা হল: কেন এমন করলেন? উত্তর দিলেন: আমার শরীর থেকে অনেক রক্ত চলে গেছে, জানি যে আমার মুখ এখন রক্তশুন্য হয়ে হলুদ হয়ে গেছে! হলুদ মুখ হচ্ছে ভীত হওয়ার লক্ষণ! তাই মুখে রক্ত মেখে ফুলের মত মরতে চাই তোমাদের সামনে! প্রশ্ন করা হল: বাহুতেও রক্ত মাখলেন কেন? মনসুর হাল্লাজ বললেন: ওজু করব। প্রেমে দুই রাকাত নামাজ রয়েছে যার ওজু কেবল রক্তের মাধ্যমেই সঠিক হয়! এরপর মনসুর হাল্লাজের চোখ দুটি উপড়ে ফেলা হয়। এ সময় যেন জনগণের মধ্যে কিয়ামত শুরু হয়। কেউ কাঁদছিল, আবার কেউ কেউ মনসুর হাল্লাজের দিকে পাথর নিক্ষেপ করছিল। এরপর তাকে বলা হল যে তোমার জিহ্বাও কাটা হবে। তিনি বললেন: একটু ধৈর্য ধরুন! একটু কথা বলে নেই। এরপর তিনি আকাশের দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন: হে খোদা! এই কষ্ট যা তোমা থেকে উপকৃত হচ্ছে তাকে বঞ্চিত কোরো না ও তার এই কল্যাণ বা দৌলত হতে বঞ্চিত কোরো না। আলহামদুলিল্লাহ তথা সকল প্রশংসা আল্লাহর এ জন্য যে আমার হাত ও পা কাটা হয়েছে। তোমার তথা খোদার পথে যদি দেহ থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করা হয় তোমার জালাল বা ঔজ্জ্বল্যগুলো দেখার মাথা গজাবে। এরপর তার নাক ও কান কেটে দেয়া হয় ও তার দিকে পাথর ছোঁড়া হয়।

এভাবে হাত, পা, জিহ্বা, চোখ, নাক ও কানবিহীন মনসুর হাল্লাজের রক্তাক্ত দেহ ঘণ্টার পর ঘন্টা সূর্যের আলোর নীচে বাগদাদের বিস্মিত মানুষের সামনে প্রজ্জ্বোল হয়ে পড়েছিল। এশার বা মাগরিবের নামাজের সময় অর্ধমৃত মনসুর হাল্লাজের দেহ থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করা হয় এবং এভাবে তার পার্থিব জীবনের অবসান ঘটে। তার দেহের বিচ্ছিন্ন নানা অংশ মানুষের সামনে প্রদর্শনের জন্য ফেলে রাখা হয়েছিল। আত্তারের বর্ণনা অনুযায়ী যখনই মনসুর হাল্লাজের দেহ থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ত তা আল্লাহ শব্দের রূপ ধারণ করত!

মনসুর হাল্লাজের খণ্ড-বিখণ্ড লাশ পরদিন খেজুর পাতার তৈরি পাটিতে পেঁচিয়ে তাতে তেল ঢেকে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয় এবং তার দেহের ছাইগুলো শহরের মিনার থেকে বাতাসে ছিটিয়ে দেয়া হলে তা গোটা শহরে ছড়িয়ে পড়ে । মনসুর হাল্লাজকে একজন দরবেশ প্রশ্ন করেছিলেন: প্রেম কি? উত্তরে তিনি বলেছিলেন: আজ, আগামিকাল ও পরশু দেখতে পাবে। একদিন হত্যা করা হবে, পরের দিন পোড়ানো হবে ও তৃতীয় দিন তার দেহের ছাই বাতাসে ছড়ানো হবে। অর্থাৎ এটাই প্রেম।

মনসুর হাল্লাজ তার খাদেমকে বলেছিলেন, আমার শরীরের ছাই যখন দজলা নদীতে ফেলা হবে তখন তার পানি ফুলে উঠবে ও বাগদাদ এর পানিতে তলিয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা দেখা দেবে। এ সময় আমার খিরক্বা বা জামা নিয়ে যাবে দজলায় এবং তাতে পানি শান্ত হয়ে যাবে। তৃতীয় দিনে মনসুর হাল্লাজের শরীরের ভস্ম দজলার পানিতে ফেলা হলে সেখান থেকেও আনাল হক শব্দ আসত ও পানি ফুলে ওঠে। খাদেম মনসুর হাল্লাজের জামা দজলার তীরে নিয়ে আসলে পানি শান্ত হয় ও ছাইও শান্ত হলে সেসব একত্র করে দাফন করা হয়। মনসুর হাল্লাজের মৃত্যুর পর খলিফার ঘরে শোকের গভীর ছায়া নেমে আসে। খলিফার মা খুবই শোকার্ত হন। বলা হয় মনসুর হাল্লাজের মাথা খলিফার মায়ের নির্দেশে খোরাসানের নানা অঞ্চলে ঘুরিয়ে আনার পর রাজ-প্রাসাদের ধন-ভাণ্ডারের ওপর সংরক্ষণ করা হয়। তার নিহত হওয়ার স্থানের পাশের জমি ওয়াকফ করে দেয়া হয় যাতে জনগণ এই স্থানটি জিয়ারত করতে পারে।#    

পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/ ১১

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।