নভেম্বর ২৩, ২০২০ ২১:৩০ Asia/Dhaka

গত পর্বের ধারাবাহিকতায় আজও আমরা পবিত্র ইসলাম ধর্ম ও মহানবী (সা) সম্পর্কে পশ্চিমা প্রাচ্যবিদ কারেন আর্মস্ট্রং-এর বক্তব্য ও মন্তব্য শুনব।

গত পর্বের আলোচনায় আমরা জেনেছি ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের রহস্যময় ঘটনার পর মহানবীর (সা) জীবনী শীর্ষক একটি বই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বছরের সবচেয়ে বেশি বিক্রিত বই হিসেবে খ্যাতি অর্জন করে। এ বইয়ের লেখিকা কারেন আর্মস্ট্রং ছিলেন গির্জার কর্মী। ব্রিটিশ এই লেখিকা মহানবীর জীবনী সংক্রান্ত তার বইটির ভূমিকায় ক্ষোভ প্রকাশ করে লিখেছেন, ‘পাশ্চাত্যের জনগণের কাছে মুহাম্মাদ (সা) বলতে যে ছবি ভেসে ওঠে তা হচ্ছে সালমান রুশদির আঁকা ছবি অথবা এমন এক ছবি যা ক্রুসেডের যুদ্ধের যুগ থেকে খ্রিস্টানদের মধ্যে রয়ে গেছে। ১১ সেপ্টেম্বরে টুইন টাওয়ার ধ্বংসের ঘটনার পর বিশ্বের দৃষ্টি আবারও ইসলাম ও মুসলমানদের ওপর নিবদ্ধ হয়। পশ্চিমাদের ধারণা এই ঘটনা ইসলামের উগ্রতাকেই তুলে ধরছে এবং প্রমাণ করছে যে ইসলাম  সন্ত্রাস, হত্যাযজ্ঞ ও ত্রাস সৃষ্টির বা নৃশংসতার ধর্ম।!কিন্তু বাস্তবতা বা সত্য এমন নয়। কারেন আর্মস্ট্রং যুক্তি দেখান যে পশ্চিমারা এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি এড়িয়ে যান যে অন্য ধর্মগ্রন্থগুলোতেও সহিংসতার নির্দেশনা সংক্রান্ত বাক্য রয়েছে।

আর্মস্ট্রং-এর মতে মুহাম্মাদ (সা) কেবল মুসলমানদের জন্যই নানা গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষার আদর্শ নন, একইসঙ্গে তিনি পশ্চিমাদের জন্যও আদর্শ। তিনি ছিলেন যুদ্ধ ও বিবাদে অতিষ্ট হয়ে পড়া আরব ভূখণ্ডে ঠিক যেন শান্তির এক সুশীতল সমীরণ বা হাওয়ার মত। আর বর্তমানে আমাদের এমনই একজন নেতা দরকার যিনি এমন শান্তির ভূমিকা রাখার জন্যই প্রস্তুত। লোভ-লালসা, অবিচার ও আধিপত্যকামিতা বা দাম্ভিকতার বিরুদ্ধে তিনি আজীবন লড়াই করে গেছেন অক্লান্তভাবে। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে আরব উপদ্বীপ এক চরম ক্রান্তিলগ্নে পৌঁছে গেছে এবং প্রচলিত চিন্তায় আর কাজ হবে না... মুহাম্মাদ জনগণের ওপর নিজের ধর্ম চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেননি, বরং তিনি জনগণের মনমানসিকতা ও চরিত্র বদলে দেয়ার আশা করতেন।

আর্মস্ট্রং আরও লিখেছেন, মহানবীর (সা) জীবন ছিল ওহি বা পবিত্র কুরআন-কেন্দ্রীক নীতিমালায় পরিচালিত। মানবজাতিকে সুপথ দেখানো ও সুবিন্যস্ত করার জন্য প্রকৃত খোদায়ি বিধি-বিধান বাস্তবায়নই ছিল তাঁর জীবনের পরিকল্পিত কর্মসূচি। মহানবী মুহাম্মাদ (সা) জাহিলিয়্যাত বা অজ্ঞতা বলতে কেবল ইতিহাসের এক বিশেষ যুগের দিকেই ইঙ্গিত করেননি, তিনি একইসঙ্গে এটা বলতে একটি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গিকেও বুঝিয়েছেন যা হিজরি প্রথম শতকে হিজরি আরব উপদ্বীপে সৃষ্টি করেছিল সহিংসতা ও ত্রাস। আমার মতে পাশ্চাত্যে এখন যে জাহিলিয়্যাত বা অজ্ঞতা রয়েছে তা ঠিক ইসলামের ওই যুগের মতই। 

মিসেস কারেন আর্মস্ট্রং ‘মুহাম্মাদ শত্রু  শীর্ষক অধ্যায়ে চেষ্টা করেছেন মুহাম্মাদ সম্পর্কে খ্রিস্ট সমাজের আঁকা ছবির প্রতিবাদ করার যে ছবি তারা অতীত যুগ থেকে এ পর্যন্ত নানা যুগে তুলে ধরেছে। মুহাম্মাদকে তারা যুদ্ধবাজ বলে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন যা একটি অপবাদ।

মহানবীর যুগে সংঘটিত যুদ্ধগুলো সম্পর্কে মিসেস কারেন আর্মস্ট্রং মনে করেন মহানবী জিহাদি ছিলেন এবং একইসঙ্গে প্রকৃত শান্তিকামীও ছিলেন। তিনি এ প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক নানা দৃষ্টান্ত তুলে ধরতে গিয়ে ঐতিহাসিক মক্কা বিজয়ের ঘটনা তুলে ধরেন। তার মতে শান্তিকামিতাই ইসলামের মূল বৈশিষ্ট্য। মিসেস কারেন লিখেছেন: মক্কা বিজয়ের সময় মহানবী (সা) জীবন, বিশ্বাস ও নিজের ঘনিষ্ঠ সঙ্গীদেরকে জড়িত করেন এ বিজয়ে যাতে এ বিজয় কোনো রক্তপাত ছাড়াই সম্পন্ন হয়। সুরা ফাত্‌হ থেকে এ অর্থই খুব ভালোভাবে উপলব্ধি করা যায়।

কারেন মনে করেন মহানবী (সা) ইসলামের মূলনীতির আলোকেই সব সময় আলোচনা ও সংলাপের কথা ভাবতেন। কারণ ইসলাম শব্দের অর্থ মহান আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ যার মূল শব্দটি হল সালাম বা শান্তি।   

মহানবীর জীবন সম্পর্কে নিরপেক্ষ বিশ্লেষণকারী গবেষক কারেন আর্মস্ট্রং মনে করেন বর্তমান যুগে বিশ্ব অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি মাত্রায় মুহাম্মাদের মত ইসলামের মহামানবের মুখাপেক্ষী। মুহাম্মাদ (সা) বর্তমান যুগের মানুষের জন্যও সচেতনতা, ন্যায়কামিতা, নৈতিকতা, সম্মান, শান্তি, দয়া, প্রেম ও মানব-প্রেমের দিশারি। তিনি মানবতার জন্য প্রেম ও ভালবাসার কেন্দ্রবিন্দু।

কারেন আর্মস্ট্রং লিখেছেন: পাশ্চাত্যের সংকটের একটা অংশ হল এটা যে যুগ যুগ ধরে শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে পাশ্চাত্য মুহাম্মাদ (সা)কে সভ্যতার বিরোধি বলে প্রচার করে এসেছে। অথচ আমাদের উচিত ছিল তাকে উচ্চতর মনমানসিকতার মানব হিসেবে জানা যিনি নিজ জাতির জন্য ন্যায়বিচার ও শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কঠোর প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। আমরা যদি মুহাম্মাদকে এই দৃষ্টির আলোকে দেখি যে আমরা ইতিহাসের বড় ব্যক্তিত্বদের দেখব তাহলে খুবই সহজেই এটা বিশ্বাস করব যে তিনি ছিলেন ইতিহাসের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব এবং তাকে চেনা ও জানা আমাদের জন্য জরুরি। 

মিসেস কারেন লিখেছেন: কোনো গোঁড়া বা বিদ্বেষী ব্যক্তি মহানবীর জীবনীকে বিকৃত করে তা যাতে নিজের ব্যক্তিগত উদ্দেশ্যে অপব্যবহার করতে না পারে সেই ব্যবস্থা আমাদের করতে হবে। ...পরিবর্তনশীল এই বিশ্বে পাশ্চাত্যের মানুষের উচিত এই মহান ব্যক্তির জীবনী থেকে নিজের সুপথের জন্য আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো শেখা।  

আর্মস্ট্রংয়ের মতে এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য সবচেয়ে ভালো সূচনা হল মুহাম্মাদ (সা)। তিনি সবচেয়ে ভালো আদর্শিক শ্রেণীবিন্যাসের মধ্যে পড়েন।... তার ব্যক্তিত্ব প্রতিভা ও বুদ্ধিমত্তায় ভাস্বর। তিনি এমন ধর্ম ও  সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ভিত্তি গড়ে দিয়েছেন যে তা তরবারি-ভিত্তিক ছিল না, বরং তাঁর নাম থেকেই যা প্রতিভাত হয় তার ভিত্তিক তথা শান্তি ও সমঝোতার যুক্তি-ভিত্তিক।#

পার্সটুডে/আমির হুসাইন/আবু সাঈদ/ ২৩

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ