নভেম্বর ২৫, ২০২০ ১৭:৩০ Asia/Dhaka

আজ আমরা হিজরি পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতকের তথা খ্রিস্টিয় একাদশ শতকের বিখ্যাত ইরানি কবি মাসউদ সা'দ সালমান-এর জীবন ও রচনা সম্পর্কে কথা বলব।

হিজরি পঞ্চম শতকের দ্বিতীয়ার্ধের ও ষষ্ঠ শতকের প্রথমার্ধের তথা খ্রিস্টিয় একাদশ শতকের বিখ্যাত ইরানি কবি  মাসউদ সা'দ সালমান-এর পুরো নাম আমির সায়িদ উদদৌলা আবওয়ান্নাজম মাসউদ সা'দ সালমান হামেদানি। গজনির সুলতান ও সালজুক সম্রাটদের শাসনামলের এই কবি গজনি সালতানাতের ভারতীয় অংশে রাষ্ট্রীয় বড় কর্মকর্তা হিসেবে বসবাস করতেন। তার পরিবার ছিল মূলত পশ্চিম ইরানের হামেদান শহরের অধিবাসী। মাসউদ সা'দ-এর পূর্বপুরুষরা ছিলেন জ্ঞানী ও সভ্রান্ত ব্যক্তি। তার বাবা খাজা সা'দ সালমান গজনীর সুলতান মাহমুদের শাসনামলের প্রথম দিকে হামেদান থেকে গজনিতে যান এবং ষাট বছর ধরে গজনভি-সুলতানদের সেবা করেন। তিনি প্রথমে গজনিতে ও পরে লাহোরে বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং ওই অঞ্চলের শীর্ষস্থানীয় রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা হিসেবে সম্মানের অধিকারী ছিলেন। সে যুগে লাহোর ছিল গজনীর সুলতানদের শাসনাধীন অঞ্চল।

মাসউদ সা'দ সালমান-এর জন্ম হয়েছিল লাহোরে হিজরি ৪২৫ থেকে ৪৩৮ সনের বা খ্রিস্টিয় ১০৩৩ থেকে ১০৪৬ সনের কোনো এক বছরে।  তিনি শৈশবে লাহোর ও গজনিতে বড় বড় শিক্ষকদের কাছে নানা জ্ঞান ও শিল্প সম্পর্কে শিক্ষা লাভ করেন। তিনি যুদ্ধ-বিদ্যা, অশ্বচালনা ও তির নিক্ষেপ বা তিরান্দাজিতেও খ্যাতি অর্জন করেন। এ ছাড়াও মাসউদ সা'দ সালমান আরবি ভাষা, কুরআনের তাফসির, হাদিস, ইতিহাস, যুক্তিবিদ্যা ও গণিতেও দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। হিন্দি, ফার্সি ও আরবি সাহিত্য অধ্যয়ন করতে গিয়ে তিনি কবিতা ও কাব্যের গভীর অনুরাগী হয়ে পড়েন এবং ক্বাসিদা রচনায় খ্যাতি অর্জন করে এ বিষয়ের একজন শিক্ষকে পরিণত হন। মাসউদ সা'দ সালমান নিজের কলমের শক্তি ও বর্ণনাভঙ্গীর জাদুময় দক্ষতা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন।

মাসউদ সা'দ সালমান পড়াশুনা ও শিক্ষা-জীবন শেষ করে যৌবনেই রাজদরবারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন ও রাজ-দরবারের সদস্য হন।

শিল্প-রসিক সুলতান ইব্রাহিম গজনভির শাসনামলে মাসউদ সা'দ সালমান-এর বাবা তাকে নিয়ে একবার রাজ-দরবারে নিয়ে আসলে সুলতান তার কবিতা শুনতে চান। সুলতান মাসউদ সা'দ সালমান-এর কবিতা শোনার পর বলেছিলেন, এ যুবক খুবই শিল্প-প্রতিভার অধিকারী। তার ভবিষ্যত খুবই ভাল এবং তার রচনা খ্যাতি অর্জন করবে। সুলতান ইব্রাহিম তাকে বিশেষভাবে সহায়তা করেন এবং মাসউদ সা'দ সালমানও এই সুলতানের প্রশংসা করে অনেক ক্বাসিদা লেখেন ও ব্যাপক পুরস্কারও অর্জন করেন। সুলতান ইব্রাহিম/ কবি মাসউদ সা'দ সালমানকে শাহজাদা সাইফউদ্দিন মাহমুদ-এর সঙ্গী হিসেবে নিয়োগ দেন। সুলতানের এই ছেলে হিজরি ৪৬৯ সনে গজনির সুলতানদের বিশাল সাম্রাজ্যের ভারতীয় অংশের শাসক নিযুক্ত হন। এ সময়ও মাসউদ সা'দ সালমান সাইফউদ্দিনের অতি ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি ছিলেন। যুদ্ধের ময়দানে তিনি ছিলেন রণকুশলী কমান্ডার এবং শিল্প ও সাহিত্যের আসরে তিনি ছিলেন সুরুচিসম্পন্ন মিষ্টিভাষী এক কবি।

মাসউদ সা'দ সালমান সাইফউদ্দিন মাহমুদ-এর প্রশংসা করে অনেক ক্বাসিদা লিখেছেন। সাইফউদ্দিনের সব বিজয়-অভিযানের প্রশংসাও তার এসব কবিতার কোনো কোনোটিতে। সব যুদ্ধেই তিনি ছিলেন সাইফউদ্দিনের সঙ্গী ও সহযোদ্ধা।

মোহাম্মাদ  অউফি 'লুবাবুল আলবাব' নামক বইয়ে কবি মাসউদ সা'দ সালমান-এর প্রশংসা করে লিখেছেন, মাসউদ ভারতে মহৎ কাজ করতেন এবং এ জন্য তিনি সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। নানা জীবনী-গ্রন্থে দেখা যায় মাসউদ সা'দ সালমান আলেম, নবী-বংশের সদস্য বা সাদাত ও প্রবীণ ব্যক্তিদের যত্ন নিতেন এবং কোনো প্রার্থীকেই তিনি কখনও বঞ্চিত ও বিমুখ করতেন না। পরিচিত-অপরিচিত, মুসলমান ও হিন্দু- সবার প্রতিই তিনি ছিলেন দয়াদ্র ও কল্যাণকামী। তিনি বন্ধু ও শত্রু সবারই কল্যাণ করতেন। বিনম্রতা ও দয়া ছিল মাসউদ সা'দ সালমান-এর ভূষণ। তিনি যৌবনের দিনগুলো খুবই সুখ ও সমৃদ্ধির মধ্যে কাটিয়েছিলেন। কিন্তু জীবনের চল্লিশটি বছর সুখ ও সম্মানের মধ্য দিয়ে কাটানোর পর অসম্মান ও দুর্দিনের শিকার হন তিনি।

শাহযাদা সাইফউদ্দিনের বিরুদ্ধে সালযুক সম্রাটের সঙ্গে গোপন সম্পর্ক রাখার অপবাদ আনা হলে তার ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি হিসেবে কবি মাসউদও দুর্ভোগের শিকার হন। শাহাযাদাকে কবি মাসউদ-ই কুবুদ্ধি দিচ্ছিলেন বলে ষড়যন্ত্রকামীরা সুলতানের কান ভারি করে। ফলে শাহযাদার অনেক সহযোগীকে হত্যা করা হয় এবং মাসউদসহ অনেককে বন্দি করা হয়। মাসউদকে 'নেই' নামক কারাগারে থাকতে হয়েছিল প্রায় দশ বছর। কারামুক্ত হয়ে তিনি লাহোরে ফিরে আসেন এবং কালান্দার অঞ্চলের গভর্নর নিযুক্ত হন। এরপর রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে তাকে আরও আট বছর জেলে থাকতে হয়েছে। আর এ জন্য কবি মাসউদ কারাবাসী কবি হিসেবে পরিচিতি অর্জন করেছিলেন। 'নেই'-কারাগারে থাকার সময়ই মাসউদ তার শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলো লিখেছিলেন। জীবনের শেষ ক'টি বছরে তিনি বেশ সমাদৃত হয়েছিলেন সরকারের কাছে এবং এ সময় তিনি বেশ আরামেই ছিলেন।

কোনো কোনো সূত্রমতে জীবনের শেষ কয়েক বছরে কবি মাসউদ বিচারকের কাজ ছেড়ে দিয়ে আত্মশুদ্ধি, ইবাদত ও আধ্যাত্মিক সাধনায় মগ্ন হয়েছিলেন। কিন্তু প্রামাণ্য নানা তথ্য-সূত্র থেকে জানা যায় মাসউদ কারাগার থেকে মুক্ত হওয়ার পর রাজকীয় পদ বা বড় পদবীর পেছনে না ছুটলেও রাজ-দরবার পরিত্যাগও করেননি। জীবনের শেষ বছরগুলোতে তিনি গজনির মাসউদ পাঠাগার নামক বিশাল পাঠাগার পরিচালনাসহ নানা সাংস্কৃতিক কাজে ব্যস্ত ছিলেন। মাসউদ সাদ সালমান হিজরি ৫১৫ বা ৫১৬ সনে তথা খ্রিস্টিয় ১১২১ বা ১১২২ সনে গজনিতে মারা যান বলে মনে করা হয়।#

পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/ ২৫

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।