ডিসেম্বর ০৩, ২০২০ ১৮:২০ Asia/Dhaka

গত আসরে আমরা পাশ্চাত্য সমাজে পরিবার প্রথার সংকট নিয়ে খানিকটা কথা বলেছি। আমরা বলেছি পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে পরিবার ব্যবস্থার বিকল্প গড়ে তোলার চেষ্টা চলছে যা বাস্তবে কখনোই পরিবারের স্থান পূরণ করতে সক্ষম নয়।

পাশ্চাত্যে শিশুদের জন্য দুগ্ধপান ও পরিচর্যা কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে এবং মধ্যবয়সী ও বৃদ্ধদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা বিশেষকরে বৃদ্ধ মানুষদের জন্য বৃদ্ধাশ্রম গড়ে তোলা হয়েছে।  এসব বিকল্প পদ্ধতি সমস্যা সমাধান না করে উল্টো সংকট বাড়িয়ে তুলছে। এ ধরণের পদ্ধতির কারণে পরিবারের সদস্যদের একে অপরের মধ্যে কাছাকাছি অবস্থানের সুযোগ হাতছাড়া হচ্ছে। পাশাপাশি বাড়ছে একা বসবাসের প্রবণতা। গত ৩০ বছরের পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দেখা গেছে,  ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে একা বাস করেন এমন মানুষের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। বাড়ছে বিবাহ বিচ্ছেদ বা তালাকের হার। এ বিষয়েই আজ আরও বিস্তারিত আলোচনা করব। আশাকরি শেষ পর্যন্ত আমাদের সঙ্গেই আছেন।

বর্তমানে পাশ্চাত্যে পরিবারের প্রথাগত সংজ্ঞায় বাস্তবিক অর্থেই পরিবর্তন ঘটে গেছে। পরিবার মানেই অনাবিল শান্তির উৎস বলে যে কথা প্রচলিত রয়েছে তা পাশ্চাত্যের পরিবারগুলোর ক্ষেত্রে আর প্রযোজ্য নয়। পরিবারে বাবা-মা মিলে শিশুকে আগলে রেখে আদরে-সোহাগে বড় করে সমাজকে একজন ভালো মানুষ উপহার দেওয়ার যে দায়িত্ববোধ সেটা এখন আর সেখানকার অধিকাংশ মানুষের মধ্যেই কাজ করে না। শিশুদের একটা বড় অংশই এখন বড় হয় মাত্র একজন অভিভাবকের তত্ত্বাবধানে। দেখা যায় কেউ তার বাবার কাছে আবার কেউ তার মায়ের কাছে বড় হচ্ছে। কোনো কোনো শিশু আবার সৎ বাবা-মায়ের অনাদর ও চোখ রাঙানি সহ্য করে বেড়ে উঠছে।  নিজের বাবা-মা দুইজনকে একসঙ্গে নিয়ে বাস করা এখন পাশ্চাত্যের অনেক শিশুর কাছেই স্বপ্ন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রখ্যাত লেখক ফিলিস এশেলেফলি'র এ সংক্রান্ত একটি বইয়ের নাম হচ্ছে 'হু কিল্ড দ্যা অ্যামেরিকান ফ্যামিলি'। তিনি এই বইয়ে লিখেছেন, বর্তমানে আমাদেরকে নানা ধরণের পরামর্শ দেওয়া হয়। স্বাস্থ্যের দিকে নজর দিতে বলা হয়, সুষম খাবার গ্রহণে উৎসাহিত করা হয়। গ্লোবাল ওয়ার্মিং ঠেকাতে তৎপর হতে বলা হয়। এছাড়া আরও কত কী! কিন্তু যখনই পরিবারে বাবার অনুপস্থিতির প্রসঙ্গ আসে যা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর, তখনই নীরবতা লক্ষ্য করা যায়। আর এটা যেন এক নীরব ষড়যন্ত্র! জাতিসংঘ ২০১৫ সালে ওয়ার্ল্ড ফ্যামিলি ম্যাপ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে শিশুদের ওপর পরিবার প্রথায় পরিবর্তনের প্রভাব সংক্রান্ত তথ্য তুলে ধরেছে। সেখানে বলা হয়, চার দশকের তুলনামূলক পরিসংখ্যানে এটা স্পষ্ট আমেরিকা, ইউরোপ ও অস্ট্রেলিয়া মহাদেশে স্বাভাবিক নিয়মের বৈধ বিয়ের প্রথায় পরিবর্তন এসেছে এবং এসব মহাদেশের মানুষ বৈধ বিয়ের পরিবর্তে বিয়ে বহির্ভূত যৌন সম্পর্কের দিকে ঝুকে পড়ছে। এর ফলে বিয়ে বহির্ভূত সম্পর্কের কারণে জন্ম নেওয়া শিশুর সংখ্যা বেড়ে চলেছে।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৯৮ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত জন্ম নেওয়া শিশুদের বিষয়ে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৪১ শতাংশ, কানাডায় ৩৩ শতাংশ, ফ্রান্সে ৫৭ শতাংশ, সুইডেনে ৫৪ শতাংশ, ব্রিটেনে ৪৮ শতাংশ এবং অস্ট্রেলিয়ায় ৩৩ শতাংশ শিশু বিবাহ বহির্ভূত যৌন সম্পর্কের ফসল। শুধু মার্কিন যুক্তরাস্ট্রেই দুই কোটি ২০ লাখ শিশুর দায়িত্বভার পড়েছে দেড় কোটি নারীর ওপর। এসব নারীর ৩৬ শতাংশই অবৈধ সম্পর্কের মাধ্যমে সন্তান জন্ম দিয়েছে। আসলে এ ধরণের অবৈধ সম্পর্কের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সন্তানেরা। এ ধরণের শিশুরা বাবা-মায়ের মায়া-মমতা ও ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়। এর ফলে তাদের মধ্যে উদ্বেগ ও বিষণ্ণতা বাড়ে। একটা পর্যায়ে এই উদ্বেগ ও বিষণ্ণতা রূপ নেয় চরম হতাশায়। তারা পরিচিতি সংকটে ভুগতে থাকে এবং নিজেকে খুব অসহায় ও দুর্ভাগা ভাবে। কোনো দেশ ও জাতিই এ ধরণের হতাশাগ্রস্ত প্রজন্ম প্রত্যাশা করে না। 

পাশ্চাত্য নৈতিক ও সামাজিক দিক থেকে নানা সংকটের সম্মুখীন। এ ধরণের সংকটের একটা বড় অংশের উৎস হচ্ছে নারী ও পুরুষের অবাধ মেলামেশা। এই অবাধ সম্পর্ক পারিবারিক ভিত্তি ধ্বংসের পাশাপাশি বিপর্যয়কর পরিণতি ডেকে আনছে। এক সময় পাশ্চাত্য সমাজেও তালাক বা বিবাহ-বিচ্ছেদকে পারিবারিক এবং সামাজিক মারাত্মক গ্লানি হিসেবে দেখা হতো। কথায় কথায় বিবাহ-বিচ্ছেদকে ভালো চোখে দেখা হতো না। কিন্তু তাদের এই দৃষ্টিভঙ্গীতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। আধুনিকতার নামে বিয়ে প্রথাকেই টার্গেট করা হচ্ছে। পুঁজিবাদ ও ভোগবাদ চিরাচরিত পরিবার ব্যবস্থার শেকড় উপড়ে ফেলছে। বৈধ বিয়ের মোকাবেলায় লিভ টুগেদার বা বিয়ে ছাড়াই সহাবস্থানের প্রতি ঝোক প্রবণতার ফলে প্রশান্তিময় স্থায়ী পরিবারের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এ ধরণের সম্পর্কের কারণে জন্ম নেওয়া শিশুরা সাধারণত পরবর্তীতে একসঙ্গে বাবা-মায়ের সান্নিধ্য পায় না। বিয়ের মাধ্যমেও যেসব পরিবার গঠিত হচ্ছে সেগুলোও দ্রুত ভেঙে যাচ্ছে। কারণ সমাজে বিদ্যমান অবাধ যৌনাচার পরিবারে স্বামী-স্ত্রীর প্রতি বিশ্বস্ত থাকার পথকে সংকীর্ণ করে তুলেছে।

অনেকে যৌবনে বৈধ বিয়ের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন না, এ কারণে অনেক দেরিতে বিয়ে করেন। কিন্তু সেসব বিয়ে বেশি দিন টেকে না। এ কারণে পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদের হার অনেক বেশি। অনেকের ধারণা শুধু অর্থনৈতিক দৈন্যতা তালাকের বড় কারণ। কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে, পাশ্চাত্যের ধনী দেশগুলোতেই তালাকের ঘটনা বেশি ঘটে। বেলজিয়ামে ৭১ শতাংশ বিয়েই শেষ পর্যন্ত তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদে গড়ায়। এদিক থেকে বেলজিয়াম গোটা বিশ্বে শীর্ষে রয়েছে। এরপরেই রয়েছে আরেক ইউরোপীয় দেশ পর্তুগাল। সেখানে তালাকের হার ৬৮ শতাংশ। এরপরে যথাক্রমে রয়েছে হাঙ্গেরি, চেক প্রজাতন্ত্র, স্পেন, লুক্সেমবুর্গ, স্তোনিয়া, ফ্রান্স ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ব্রিটেনেও প্রায় অর্ধেক বিয়ে তালাকে গড়ায়। ২০১৯ সালের প্রথম তিন মাসের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ব্রিটেনের ইংল্যান্ড এবং ওয়েলস রাজ্যে ৪২ শতাংশ দম্পতি বিয়ে টিকিয়ে রাখেননি। তারা তালাক নিয়েছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী সেখানে ৫০ শতাংশের বেশি বিয়ে তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদে গড়ায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নানা সমস্যা ও সংকটের কারণে এই প্রবণতা বাড়ছে। মার্কিন সরকার এখনই এ বিষয়ে সোচ্চার না হলে তালাকের হার ৮০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে।

এছাড়াও পাশ্চাত্যে এমন কিছু প্রবণতা ক্রমেই বাড়ছে যা পুরোপুরি প্রকৃতি বিরোধী। সমকামিতার মতো প্রকৃতি বিরোধী প্রবণতা বিদ্যমান সংকটকে আরও জটিল করে তুলেছে। এসব দেশে এ ধরণের সম্পর্ককে বৈধতা দিয়ে চরম অন্যায় করা হচ্ছে যা পরবর্তীতে ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতির জন্ম দেবে বলে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন।#

পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ/মো: আবুসাঈদ/ ০৩

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।