ডিসেম্বর ০৯, ২০২০ ১৫:৪৩ Asia/Dhaka

আজও আমরা ইরানের বিখ্যাত সুফি-সাধক ও আরেফ এবং মরমি কবি নুরউদ্দিন আবদুর রহমান জামি’র জীবন ও অবদান নিয়ে কথা বলব।

 গত পর্বের আলোচনায় আমরা জেনেছি তৈমুরি শাসনামলের অতুলনীয় প্রতিভা ছিলেন প্রখ্যাত সুফি-সাধক ও কবি মাওলানা জামি। তার পুরো নাম মোল্লা নুরউদ্দিন আবদুর রহমান জামি। ১৪১৪ খ্রিস্টাব্দের ৭ নভেম্বর খোরাসানের জ’ম অঞ্চলে তার জন্ম হয়েছিল। আর তার মৃত্যু হয়েছিল ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দের ৯ নভেম্বর। জামি তার পুরো জীবনই ব্যয় করেছেন নিরলস সাহিত্য সাধনায়। গদ্য ও পদ্য রচনা মিলিয়ে তার বইয়ের সংখ্যা প্রায় ৫০টি। এসবের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বইগুলো হচ্ছে: ‘দীওয়ান’, ‘মাসনাভি’, বাহরিস্তান, হাফত্‌ আওরঙ্গ, ইউসুফ-জোলায়খা ইত্যাদি। দিওয়ান তিন খণ্ডে ও মাসনাভি সাত খণ্ডে সমাপ্ত।

তৈমুরি সুলতান মির্যা আবু সাঈদের শাসনামলে জামি রাজকীয় মর্যাদায় আসীন ছিলেন। তৈমুরি শাসনামলে তুর্কি এই বংশের সুলতান বা সম্রাটরা ফার্সি ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। জামি ফার্সি সাহিত্যের শীর্ষস্থানীয় কবি। কেউ কেউ তাঁকে ফার্সি  সাহিত্যের সর্বশেষ শ্রেষ্ঠ কবি বলে উল্লেখ করেছেন। জামির কবিতায় একইসঙ্গে শেখ সা’দির নীতিবোধ, রুমির উচ্চাভিলাষ, হাফেজের সারল্য এবং নিজামির আবেগের প্রতিফলন দেখা যায়। 

মাওলানা জামির বইগুলোর মধ্যে দিওয়ান-এ রয়েছে খণ্ড কবিতা ও গজল বা গীতিকবিতা। আর তার মাসনাভিতে রয়েছে কুরআন-হাদিস, মহানবী (সা), পীর-পয়গাম্বর, সাধু-দরবেশ, মরমীবাদ, আরবি ব্যকরণ, ছন্দপ্রকরণ ও সঙ্গীতসহ নানা বিষয়ে বিষদ আলোচনা ও মাঝে মধ্যে কবিতার সংযোগ। কবিতাগুলো যুক্ত করা হয়েছে বক্তব্যকে জোরালো ও প্রামাণ্য করে তুলতে। ইরানি জাতির একটি সুন্দর ও ঐতিহ্যবাহী স্বভাবই হল কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে বক্তব্যকে জোরালো বা প্রামাণ্য করা।

মাওলানা জামির গদ্য বইগুলোর মধ্যে তোহফাতুল উনস্ বইটি সুফিতত্ত্বের তথ্য ও তত্ত্ব সম্পর্কিত বিশদ আলোচনার বই। তার ইউসুফ জোলায়খা হচ্ছে প্রেমধর্মী রোমান্স কাব্য এবং হাফত্‌ আওরঙ্গ হচ্ছে সাতটি দীর্ঘ কবিতার সংকলন। কবিতাগুলোর নাম দেখেই বোঝা যায় যে তিনি এসব কবিতায় কোন্‌সব বিষয়ের অবতারণা ও ব্যাখ্যা করেছেন। এই সাতটি কবিতার প্রথম দীর্ঘ কবিতা বা কাব্যটির নাম সিলসিলাতুল দাহাব তথা স্বর্ণ বা হীরার হার। দ্বিতীয় দীর্ঘ কবিতাটির নাম সালমান ওয়া আবসাল তথা সালমান ও আবসালের রোমান্টিক কাহিনী। হাফত্‌ আওরঙ্গের তৃতীয় দীর্ঘ কবিতাটির নাম তুহফাতুল আহরার বা সত্যের উপহার। চতুর্থ দীর্ঘ কবিতাটির নাম সুবহ্‌তুল আবরার তথা ধার্মিকের গোলাব বা পুরস্কার। পঞ্চম কাব্যটির নাম ইউসুফ জোলায়খা তথা ইউসুফ-জোলায়খার প্রেমকাহিনী। হাফত্ আওরঙ্গের ষষ্ঠ কাব্যটির নাম লায়লা ও মাজনুন বা লাইলি-মজনুর প্রেমকাহিনী এবং সপ্তম কাব্যটির নাম খিরাদনামায়ে সিকান্দারি বা অ্যালেক্সান্ডারের বুদ্ধিমত্তা বা প্রজ্ঞার কাহিনী।  

জামির বাহ’রিস্তান বইটি গদ্য ও পদ্যে রচিত। বাহরিস্তান শব্দটির অর্থ বসন্তের বাগান। শেখ সা’দির গোলেস্তান ও বোস্তান বইয়ের অনুসরণে লেখা হয়েছে এ বই। কাহিনীগুলোর বক্তব্যেও একই রীতির ছাপ স্পষ্ট। জামির দর্শন, চিন্তাশক্তি ও প্রকাশভঙ্গীর ক্ষমতা তার রচনাকে করেছে চির-উজ্জ্বল ও মহিমান্বিত। মানাকিবুশ শোয়ারা, মাজমাউল ফুসাহা ও তারিখই জাহান গোশা নামক বিখ্যাত বইসহ নানা গবেষণা-গ্রন্থে জামির ভাষা, বক্তব্য ও দর্শনের ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে এবং জামিকে ফার্সি সাহিত্যের সাত শ্রেষ্ঠ তারাকা বা সাত শ্রেষ্ঠ স্তম্ভের অন্যতম বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই সাত তারকা হলেন রুদাকি, ফেরদৌসি, ওমর খৈয়াম, সা’দি শিরাজি, রুমি, হাফেজ ও জামি। ফার্সি সাহিত্য সম্পর্কে বলা হয়: ফেরদৌসির শাহনামা, রুমির মাসনাভি, হাফেজের দিওয়ান, নিজামির পাঞ্চগাঞ্জ ও জামির হাফত্ আওরঙ্গ প্রভৃতি ইতিহাস থেকে কখনও মুছে যাবে না এবং কেবল এই বইগুলোই ফার্সি সাহিত্যের প্রতিনিধিত্ব করতে সক্ষম। তাই নিঃসন্দেহে জামি ফার্সি সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল। 

 এবারে জামির বাহরিস্তান থেকে দু’টি কাব্যাংশের অনুবাদ এখানে তুলে ধরছি:

প্রেমিকের প্রতি:

আমরা ছুটেছি শুধু অতিদূর সন্মুখের পানে/পাহাড় পর্বত নদী পার হয়ে কি এক আহ্বানে-

সব কষ্টের ঘাম অবজ্ঞায় ফেলেছি যে দূরে,/যেহেতু পৌঁছব মোরা ইচ্ছার মঞ্জিলে ঘুরে ঘুরে।

জীবনের সব কষ্ট একটি আকাঙ্ক্ষা ঘিরে আছে-/উৎস সন্ধানে হেঁটে মহান মিলন শুধু যাঁচে।

  ‘গজল থেকে’ শীর্ষক অন্য এক কাব্যাংশে জামি লিখেছেন:  

যেহেতু তোমার মুখ রয়েছে আমার অন্তরালে/যেমন সে চাঁদ থাকে অন্ধকার রাতের আড়ালে,

অশ্রুর-তারকা জ্বালি অহরহ, অথচ আঁধার/বিনষ্ট না হয়ে শুধু এ হৃদয়ে থাকে নির্বিকার।

আমরা এখান আছি কর্মময় জীবন বাগানে/নদীর মতোন গতি মিলনের উৎস-সন্ধানে;

আমরা এখানে শুধু হাতাহীন কলসী কানায়/ চুমো দিয়ে পার হই দিনরাত কী এক ইচ্ছায়।

এইখানে এসো সাকী! তোমার সুরার মন্ত্র দিয়ে/সমগ্র ‘বৃহৎ’ পাপ ধুয়ে দাও ক্ষমা ব্রত নিয়ে।/

... তোমার মায়াবি প্রেমে জামি তো অজ্ঞান হয়ে আছে

সুরা না পিয়ালা? এই জ্ঞান আজ নাই তার কাছে!#

পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/ ০৯

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। 

ট্যাগ