ইরান-ইরাক যুদ্ধের ইতিহাস (পর্ব-৪৬): রমজান অভিযান
আমরা ইরাকের অভ্যন্তরে ইরানি যোদ্ধাদের চালানো ‘রমজান’ অভিযান নিয়ে আলোচনা করেছি। আজ আমরা এ অভিযানে ইরানের অর্জন সম্পর্কে আরো বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরব।
গত আসরে আমরা বলেছি, ইরান তার দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর খোররামশাহর পুনরুদ্ধার করার পর ইরাকের তৎকালীন শাসক সাদ্দাম ও তার আন্তর্জাতিক মিত্ররা যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য উঠেপড়ে লেগে যায়। কিন্তু তারা এ যুদ্ধের আগ্রাসী শক্তিকে চিহ্নিতকরণ ও তার কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় সংক্রান্ত ইরানের দু’টি প্রধান দাবি মেনে নিতে বেমালুম অস্বীকার করে। খোররামশাহর যুদ্ধে ইরানের বিজয়ের ফলে পাশ্চাত্য ইরানের ইসলামি বিপ্লবের উত্তরোত্তর বিজয়ের সামনে নিজেকে অসহায় অবস্থায় দেখতে পায়। এ কারণে পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো খোররামশাহর পুনরুদ্ধারের ঘটনাকে আট বছরের চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধে ইরানের বৃহত্তম বিজয় হিসেবে অভিহিত করে। এমনকি মার্কিন সরকার এক বিশ্লেষণে ঘোষণা করে: “ইরানের এই সিদ্ধান্তমূলক বিজয়ের ফলে মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যপন্থি দেশগুলোতে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করার দরজা তেহরানের জন্য উন্মুক্ত হয়ে যাবে।”
এ ধরনের বিদ্বেষী বিশ্লেষণ থেকে সহজেই অনুমান করা যায় যে, ইরাক সরকার ও তার আন্তর্জাতিক সহযোগীরা কখনোই ইরানের এত বড় বিজয় আশা করেনি। এ কারণে তারা উদ্ভূত পরিস্থিতিতে করণীয় ঠিক করতে গিয়ে সাদ্দামকে ইরাকের ক্ষমতায় ধরে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। ইরানের বিজয় যদি এভাবে অব্যাহত থাকে তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার তাবেদার সরকারগুলোর অবস্থা খারাপ হয়ে যেতে পারে ভেবে শঙ্কায় পড়ে যায় পাশ্চাত্য। এ কারণে তারা একদিকে ইরানবিরোধী রাজনৈতিক চাপ ও প্রচারণা জোরদার করে এবং অন্যদিকে ইরাককে আরো বেশি পরিমাণে অত্যাধুনিক অস্ত্রসস্ত্র সরবরাহ করতে শুরু করে। অন্য কথায়, ইরান যাতে ইরাকের অভ্যন্তরে অভিযান না চালিয়ে নিজের সীমান্ত নিয়ে সন্তুষ্ট থাকে সে লক্ষ্যে ব্যাপক চেষ্টা শুরু করে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্ব। পাশ্চাত্যের এই পরিকল্পনার আওতায় ইরাক ইরানের অভ্যন্তরে অনুপ্রবেশকারী নিজের সকল সেনাকে সীমান্তে ফিরিয়ে নেয়। শক্ত অবস্থানে থেকে ইরানের পাল্টা হামলা মোকাবিলা করার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক দেন-দরবারে ইরাককে অসহায় হিসেবে তুলে ধরা ছিল এই কৌশলের উদ্দেশ্য।

ইরাকের আগ্রাসন প্রতিহত করার পর আন্তর্জাতিক সীমান্ত অতিক্রম করে ইরাকের ভূমিতে অনুপ্রবেশ করা ছিল ইরানি যোদ্ধাদের জন্য বিশাল বিজয়। কিন্তু বাগদাদ ও তার পশ্চিমা মিত্ররা চেয়েছিল দুই দেশকে ‘না যুদ্ধ না শান্তি’ পরিস্থিতিতে ফেলে রাখতে। যতদিন আগ্রাসী ইরাকি সেনারা একের পর এক ইরানি ভূমি দখল করে যাচ্ছিল তখন তারা মুখে কুলুপ এঁটে বসেছিল। কিন্তু যখনই ইরানি যোদ্ধারা ঘুরে দাঁড়িয়েছে তখনই তাদের কৌশলে এই পরিবর্তন আসে। তবে, ইরানের দেশপ্রেমিক যোদ্ধারা যুদ্ধ বন্ধের জন্য তাদের দু’টি প্রধান দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ইরাকের অভ্যন্তরে অভিযান পরিচালনা করেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, দজলা ও আরভান্দ নদীর ওপার পর্যন্ত দখল করা এবং বসরা নগরীর চারপাশের মহাসড়কগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। ইরাকের ভূমি চিরকাল দখলে রাখার কোনো পরিকল্পনা ইরানি যোদ্ধাদের ছিল না বরং সাদ্দাম ও তার পশ্চিমা সহযোগীদেরকে ইরানের দু’টি প্রধান দাবি মেনে নিতে বাধ্য করা অথবা অন্তত যুদ্ধের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে ধরে রাখার জন্য রমজান নামের ওই অভিযান পরিচালনা করেন ইরানি যোদ্ধারা।
রমজান অভিযানে ইরানের সবগুলো উদ্দেশ্য পূরণ না হলেও তেহরান কিছু গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য অর্জন করেছিল। ওই অভিযানে ইরাকি যোদ্ধাদের বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি করার বিষয়টি বাদ দিলেও ইসলামি বিপ্লব ও যুদ্ধের ইতিহাসে ইরাকের অভ্যন্তরে অনুপ্রবেশ করাই ছিল ইরানের জন্য বিশাল অর্জন। আর সেই অর্জন এসেছিল সাদ্দাম বাহিনী এবং প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে তার সহযোগী গোটা বিশ্বের বিরুদ্ধে লড়াই করে। এছাড়া, রমজান অভিযানের মাধ্যমে তেহরান পাশ্চাত্যকে একথা বুঝিয়ে দিয়েছিল যে, ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান শুধু যে তার ভূমি থেকে আগ্রাসী ইরাকি বাহিনীকে হটিয়ে দিয়েছে তাই নয় বরং নিজের ন্যায়সঙ্গত অধিকার আদায় না হওয়া পর্যন্ত শক্তিমত্তার সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার পূর্ণ সক্ষমতা রাখে।
প্রকৃতপক্ষে সামরিক দিক দিয়ে রমজান অভিযান পরিচালনার সক্ষমতা ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের ছিল না। তবে ওই অভিযানের মাধ্যমে যুদ্ধের পরবর্তী ধাপগুলো অতিক্রম করার লক্ষ্যে একটি নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়েছিল। অন্য কথায়, আগ্রাসী ইরাকি সেনারা যখন নিজেদের আন্তর্জাতিক সীমান্তে ফিরে গিয়ে কঠোরভাবে আত্মরক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সেই অবস্থায় যুদ্ধ চালিয়ে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনের জন্য ইরানের প্রয়োজন ছিল নয়া কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন। রমজান অভিযান সে উদ্দেশ্যেই পরিচালিত হয়েছিল। ওদিকে ইরাকি বাহিনী ইরানের আগ্রাসন প্রতিহত করার জন্য আত্মরক্ষামূলক কয়েকটি বলয় তৈরি করে প্রমাণ করেছে, তারা ইরানি যোদ্ধাদের রণকৌশল সম্পর্কে সম্যক ধারনা পেয়েছে এবং তার ভিত্তিতে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে ইরানি সৈন্যদের অভিযান প্রতিহত করেছে।
আর এ বিষয়টি ইরানকে যুদ্ধের কৌশল নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছে। তেহরান একথা উপলব্ধি করেছে যে, পুরনো কৌশল দিয়ে নয় বরং সম্পূর্ণ নতুন রণকৌশল এবং মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়নের মাধ্যমে যুদ্ধ পরিচালনা করতে হবে; তা না হলে তাকে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে। এসব ছাড়াও রমজান অভিযানে এমন আরো কিছু অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়েছিল যেগুলো বিবেচনা না করে পরবর্তীতে কোনো অভিযান পরিচালনা করা ছিল দুরূহ ব্যাপার। এরকম একটি অভিজ্ঞতা ছিল- ইরাকি বাহিনী গোলন্দাজ ইউনিট ব্যবহার করে বিশাল মরু প্রান্তরে ইরানি যোদ্ধাদের অগ্রাভিযান থামিয়ে দিয়েছিল। কাজেই যেকোনো যুদ্ধে শত্রুকে ধরাশায়ী করার জন্য আগ্রাসী বাহিনীর ওপর গোলাবর্ষণের বিকল্প নেই। দ্বিতীয় অভিজ্ঞতাটি ছিল- ফাতহুল মোবিন ও বায়তুল মুকাদ্দাস অভিযানে ইরাকের বিরুদ্ধে বড় ধরনের বিজয় অর্জন করা সত্ত্বেও ওই একই কৌশলে আর কোনো অভিযানে জয়ী হওয়া ইরানের পক্ষে সম্ভব ছিল না।
বরং উল্টো ইরানের অভ্যন্তরে ইরাকি সেনাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার সময় শত্রু সেনারা ঘেরাও অবস্থায় থাকত বলে তাদের পক্ষে ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ ছিল না। কিন্তু ইরাকের অভ্যন্তরে পরিস্থিতি তেমনটি নয়। সেখানে ইরাকি সেনারা তাদের কেন্দ্রীয় কমান্ডের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিল এবং সব ধরনের অস্ত্রসস্ত্র, গোলাবারুদ ও রসদের চালান সার্বক্ষণিকভাবে পেয়ে যাচ্ছিল। কাজেই রমজান অভিযানের এসব অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ইরান যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য নিজের সামরিক সক্ষমতা শক্তিশালী করার পরিকল্পনা করে। কিন্তু এ কাজ করার জন্য ইরানের যথেষ্ট সময়ের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সময় নেয়ার জন্য যুদ্ধের ময়দানে সম্পূর্ণ নিস্ক্রিয় হয়ে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে শত্রুর আগ্রাসনের মোকাবিলায় নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করা। এ কারণে নিজের সামরিক সক্ষমতা শক্তিশালী করার পাশাপাশি ইরাক সীমান্তে সংঘর্ষ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন ইরানি সামরিক কমান্ডাররা।#
পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ / ০৯
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।