ডিসেম্বর ১৩, ২০২০ ১৮:৩০ Asia/Dhaka

গত পর্বের ধারাবাহিকতায় আজও আমরা ইরানের বিখ্যাত সুফি-সাধক ও আরেফ এবং মরমি কবি নুরউদ্দিন আবদুর রহমান জামি’র জীবন ও অবদান নিয়ে কথা বলব।

মোল্লা জামি বা মাওলানা নুরউদ্দিন আবদুর রহমান জামি ছিলেন খ্রিস্টিয় ১৫ শতকের একজন বিখ্যাত ইরানি কবি, সুফি সাধক ও ইতিহাসবিদ। জামি গণিতসহ প্রচলিত নানা শাস্ত্রে ও ইসলামী বিদ্যায় এবং আরবি ভাষা ও গ্রীক দর্শনেও দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। সুফিতাত্ত্বিক নকশাবান্দি তরিকার তিনি ছিলেন অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্ব। জামি ছিলেন ইবনে আরাবির সুফি দর্শনের অনুসারী। সুফি সা’দউদ্দিন কাশগরি ছিলেন তার শিক্ষক। কাশগরির নাতনীকে তিনি বিয়ে করেছিলেন। চারটি সন্তানের জনক হলেও তার তিন সন্তান শিশু অবস্থায়ই মারা যায়। জামি ছিলেন অত্যন্ত ধার্মিক, বিনয়ী ও প্রচার-বিমুখ।

মাওলানা জামি ছোট ও বড় ৪০টির বেশি বই লিখে গেছেন। কেউ কেউ তার চিঠিপত্রের সংকলনসহ মোট বইয়ের সংখ্যা ৮৭ বলে উল্লেখ করেছেন। গদ্য ও পদ্যে লেখা এসব বইয়ের মধ্যে দিওয়ান, হাফত্‌ আওরঙ্গ, মাসনাভী, সাবাআ, বাহরিস্তান, শাওয়াহিদুন নবুওয়্যাত ও নাফাহাতুল উনস্ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য বই। জামির সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে সাদি, নিজামি ও হাফিজের প্রভাব দেখা যায়। জামি নাফাহাতুল উনস্ শীর্ষক বইটি লিখেছিলেন তৈমুরি সাম্রাজ্যের শিল্প-রসিক এবং শিক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞান বিস্তারের প্রেমিক বিশিষ্ট মন্ত্রী আমির আলীশির নাওয়ায়ির উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায়।

নাফাহাতুল উনস্‌ জামির লেখা বিখ্যাত গদ্য বইগুলোর অন্যতম। বইটির পুরো নাম নাফাহতুল উনস্‌ মিন হাযারাতিল কুদসি। আজ আমরা এ বইটি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার চেষ্টা করব।

নাফাহতুল উনস্‌ মিন হাযারাতিল কুদসি শীর্ষক বইটি জামির মৃত্যুর পর তার অন্য সব বইয়ের চেয়ে বেশি প্রভাব রেখেছিল ধার্মিক ও শিক্ষিত মহলে। ফলে বইটি তার অন্য সব বইয়ের চেয়েও বেশি খ্যাতি অর্জন করে। বইটিতে মুসলিম বিশ্বের বিখ্যাত সুফি সাধকদের জীবনী এবং সুফি দর্শনের নানা তথ্য ও তত্ত্ব তুলে ধরা হয়েছে। এ বইটি তিনি লিখেছিলেন হিজরি ৮৮১ থেকে ৮৮৩ সনে।   

নাফাহতুল উনস্‌ বইয়ে ইসলামের সুফি ধারার প্রাথমিক যুগ থেকে জামির নিজ যুগ পর্যন্ত বিখ্যাত সুফিদের জীবনী স্থান পেয়েছে। এ ধরনের বই অতীতেও অনেক লেখা হয়েছে। যেমন, ফরিদউদ্দিন আত্তারের লেখা বই তাজকিরাতুল আওলিয়া ও ফার্সি ভাষায় লেখা খাজা আবদুল্লাহ আনসারির বই ত্বাবাক্বাতাস সুফিইয়্যাহ। তবে এ ধরনের জীবনী গ্রন্থের মধ্যে জামি ও আত্তারের লেখা বই দুটি সবচেয়ে বেশি নির্ভরযোগ্য ও বিখ্যাত।

জামির নাফাহতুল উনস্‌ বইটি খ্রিস্টিয় পঞ্চদশ শতকের তথা হিজরি নবম শতকের সুন্দরতম গদ্যের নিদর্শন। জামি এ বইটি মূলত খাজা আবদুল্লাহ আনসারির বই ত্বাবাক্বাতাস সুফিইয়্যাহ’র ভিত্তিতেই বা ওই বইটিকে অনুসরণ করেই লিখেছেন। অবশ্য নাফাহতুল উনস্‌ বইটি লেখার ক্ষেত্রে জামি বিখ্যাত সুফি সাধক ও কবি দাতাগঞ্জ বখশ হুজুইরির লেখা কাশফুল মাহজুব; আবু সায়িদ আবুল খাইরের লেখা আসরার আত্‌তাওহিদ, ইজ্জাদ্দিন ক’শ’নির লেখা মানাক্বিবে আফলাকি ও মিসবাহুল হিদায়া নামক বইগুলোও ব্যবহার করেছেন। জামির এ বইটি সাধারণ মানুষের প্রচলিত ভাষায় লেখা এবং এ সংক্রান্ত অন্য বইগুলোর ভাষার চেয়ে অনেক বেশি সহজ। তিনি এ বইয়ে মহান সুফি সাধকদের অলৌকিক ঘটনাগুলোর চেয়ে তাদের আচার-আচরণ ও চিন্তাধারাই বেশি মাত্রায় তুলে ধরেছেন।

জামির এ বইটি তথা নাফাহতুল উনস্‌-এ স্থান পেয়েছে মোট ৬০৪ জন সুফি সাধক বা মহান আরেফের জীবনী জন্ম-তারিখের ক্রমানুসারে। অন্যদিকে খাজা আবদুল্লাহ আনসারির বই ত্বাবাক্বাতাস সুফিইয়্যাহ-য় রয়েছে ১২০ জন ওলি বা সুফি সাধকের জীবনী। এই ১২০ জন সুফি সাধকের জীবনীর পাশাপাশি আরও ৪৮৪ জন ওলির জীবনী যুক্ত করেছেন জামি তার এ বইয়ে। নারী সুফি সাধকদের জীবনী তিনি আলাদা অধ্যায়ে লিখেছেন। একটি ভিন্ন অধ্যায়ে সুফি সাধকদের নানা তত্ত্ব ও চিন্তাধারা তুলে ধরে সেসবের আলোকে তাদের শ্রেণী-বিন্যাসও করেছেন জামি। বইটির সর্বশেষ অধ্যায়ে রয়েছে সমগ্র বইয়ে তুলে ধরা তথ্য, তত্ত্ব ও জীবনীর আলোকে নিজস্ব মত-ভিত্তি একটি উপসংহার।

নানা ঘটনা ও ঐতিহাসিক তথ্যের কারণে মহান সুফি-সাধকদের জীবনী সংক্রান্ত জামির এ বই তথা নাফাহতুল উনস্‌ শীর্ষক বইয়ের ঐতিহাসিক মূল্য অপরিসীম।

জামি তার এ বইয়ে সুফি সাধকদের ব্যক্তিত্ব, বক্তব্য ও মতামতের বিষয়ে কখনও সরাসরি নিজের মত ব্যক্ত করেননি এবং বিতর্কিত বা বিরোধপূর্ণ বিষয়েও কোনো অবস্থান নেননি। বরং এসব ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময়ই বড় বড় সুফি-ব্যক্তিত্বদের মতামত অথবা খাজা আবদুল্লাহ আনসারির মতই তুলে ধরেছেন।  নাফাহতুল উনস্‌ শীর্ষক বইয়ে তথ্য ও মতামত তুলে ধরার ক্ষেত্রে প্রয়োজনমত তথ্যের সূত্রগুলোও যথাযথভাবে উল্লেখ করেছেন মাওলানা জামি। #

পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/ ১৩

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। 

ট্যাগ