ডিসেম্বর ১৭, ২০২০ ১৮:৩০ Asia/Dhaka

আমরা হিজরি সপ্তম শতক তথা খ্রিস্টিয় ত্রয়োদশ শতকের বিখ্যাত ইরানি কবি ও আধ্যাত্মিক সাধক বা আরেফ ফখরুদ্দিন ইরাকির রচনা ও অবদান নিয়ে কথা বলব।

ইরানি কবি ও সুফি-সাধক ইরাকির পুরো নাম শাইখ ফাখরুদ্দিন ইব্রাহিম বিন বোজর্গমেহের বিন আবদুল গাফফার হামেদানি। কিন্তু তিনি ফাখরুদ্দিন ইরাকি নামেই বেশি খ্যাত। ইরাকি জন্ম নিয়েছিলেন হামেদানের কাছে আনুমানিক ৫৯২ থেকে ৬১০ হিজরির কোনো এক বছরে এক সভ্রান্ত ও উচ্চ-শিক্ষিত পরিবারে।

ফার্সি ও ইসলামী সুফি সাহিত্যের তারকা ইরাকি ছিলেন বিখ্যাত ইরানি কবি শেখ সা’দি ও মাওলানা রুমির সমসাময়িক। অত্যন্ত মেধাবি এই কবি বাল্যকালেই পবিত্র কুরআনের হাফিজ হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলেন। বলা হয় ৫ বছর বয়সে তিনি কুরআন হিফজ্‌ শুরু করেন ও পুরো কুরআন হিফজ্‌ করতে তার সময় লেগেছিল মাত্র নয় মাস! তার তিলাওয়াতও ছিল খুবই মিষ্টি ও হৃদয়গ্রাহী। ৮ বছর বয়সেই ইরাকির খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। ১৭ বছর বয়সেই তিনি হামেদানে উচ্চ শিক্ষা অর্জন সম্পন্ন করে শিক্ষকতায় নিযুক্ত হন। এ সময়ই তিনি ফখরুদ্দিন রাজি’র তাফসিরে কাবির, ইবনে সিনার দর্শন, ইরফান ও যুক্তিবিদ্যা সংক্রান্ত বই ইশারাত এবং আবু মাহমুদ শ’মেখির মাআলাম আত্‌তানজিল-এর মত উচ্চ পর্যায়ের বইগুলো পড়াতেন!

সুফিবাদের প্রজ্জ্বোল তারকা হিসেবে খ্যাত ইরাকিও রুমি ও শেখ সা’দির মত বহু দেশ সফর করেছিলেন। তিনি লাহোর অঞ্চলের কাছাকাছি মুলতানে ২৫ বছর বসবাস করেছিলেন। এখানে তিনি প্রখ্যাত সুফি-সাধক শেখ বাহাউদ্দিন যাকারিয়ার সান্নিধ্যে আসেন এবং সুফি-তত্ত্বে তাঁর জ্ঞান-ভাণ্ডার পূর্ণ করেন। এরপর তিনি হজব্রত পালন উপলক্ষে পবিত্র মক্কা ও মদিনায় যান ও ফেরার পথে অনেক দেশ সফর করে দামেস্কে অবস্থান করেন। কবি ইরাকি ১২৮৯ খ্রিস্টাব্দে দামেস্কেই ইন্তিকাল করেছিলেন। তিনি মিশর ও তুরস্কও সফর করেছিলেন।

ইরাকির কাব্যগ্রন্থ থেকে জানা যায় হিজরি ৬২৭ বা ৬২৮ সনে তথা খ্রিস্টিয় ১২৩০ সনে ইরাকি যখন হামেদানের একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতায় মশগুল ছিলেন এমন সময় কালান্দার নামে খ্যাত ভ্রাম্যমান এক দরবেশ গোষ্ঠীর একদল দরবেশ তার ক্লাসে প্রবেশ করে ও বাদ্য যন্ত্র ব্যবহার করে আকর্ষণীয় ধর্মীয় সঙ্গীত বা সামা গাইতে থাকে। তাদের সঙ্গীতের কথা বা কবিতা ইরাকিকে এতই মুগ্ধ ও শিহরিত করে যে তিনি শিক্ষকতা বাদ দিয়ে তখনই ওই দরবেশদের দলে যোগ দিয়ে তাদের সঙ্গে সামা গাইতে থাকেন ও একটি গজল রচনা করেন। ওই গজলে বলা হয়েছে:

কতই না খুশি বা সুখের বিষয় তুমি যদি হওয়ার আমার হৃদয়ের অধিপতি

তুমিই যদি হও সঙ্গী ও প্রেমিক এবং সহযোগী !

এই কলন্দারদের দলে যোগ দিয়ে ইস্ফাহান হয়ে ইরানি কবি ও সুফি সাধক ইরাকি ভারতবর্ষে যান। মুলতানে পৌঁছার পর তিনি সোহরাওয়ার্দি সুফি তরিকার প্রতিষ্ঠাতা শাইখ বাহাউদ্দিন যাকারিয়ার খানকায় ওঠেন। যাকারিয়া ইরাকির দিকে তাকিয়েই তার আধ্যাত্মিক উচ্চতর প্রতিভা আঁচ করতে পারেন এবং তাকে মুলতানেই থেকে যেতে বলেন। কিন্তু যুবক ইরাকির মন তখনও কালান্দারি দরবেশদের টানছিল। ফলে তিনি মুলতানে না থেকে কালান্দারদের সঙ্গে দিল্লি ও সোমনাথে যান। সেখানে কিছুকাল থাকার পর তাদের কাফেলা আবারও যাত্রা শুরু করে। কিন্তু প্রবল ঝড়-তুফান ইরাকি ও অন্য একজন কালান্দারদের থেকে আলাদা হয়ে যান। ফলে ইরাকি একাই মুলতানে বাহাউদ্দিন যাকারিয়ার খানকায় ফিরে আসেন। সেখানে তাকে সাদরে বরণ করেন যাকারিয়া। যাকারিয়া প্রশ্ন করেছিলেন: ইরাকি তুমি কি আমাদের কাছ থেকে পালিয়ে গিয়েছিলে? ইরাকি তাৎক্ষণিকভাবে কবিতার দুই লাইন রচনা করে জবাব দেন যার মর্মার্থ হল শরীর কিভাবে প্রাণ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারে? আর তখন থেকেই ইরাকি যাকারিয়ার কাছ থেকে খোদাপ্রেম তত্ত্বের পাঠ নিতে থাকেন।

ইরাকিকে সুফিতত্ত্ব পরিপূর্ণভাবে শিক্ষা দেয়ার পর যাকারিয়া তাকে নিজের  বিশেষ পোশাক বা খেরক্বা দান করেন। কিছুকাল পর যাকারিয়া নিজের মেয়েকে ইরাকির কাছে বিয়ে দেন। ইরাকির এক পুত্র সন্তান জন্ম নিয়েছিল। কবিরউদ্দিন নামের এই পুত্র হয়েছিলেন পিতা ইরাকির মৃত্যুর পর তার স্থলাভিষিক্ত ও তার মুরিদদের পীর ।  যাকারিয়া মারা যাওয়ার পর ইরাকি গদিনশীন পীর হবেন বলেই কথা ছিল। কিন্তু একদল পরশ্রীকাতর ব্যক্তির নানা হয়রানিতে অস্থির হয়ে ইরাকি মুলতান ছেড়ে ওমান হয়ে হজ্বে যান এবং ফেরার সময় ওমান ও বাহরাইন ও দামেস্ক হয়ে তুরস্কের রুম বা কৌনিয়াতে যান। তিনি সেখানে শেখ সাদরুদ্দিন কৌনাভির সুফি-তাত্ত্বিক ক্লাসে যোগ দেন এবং সেখানে লামাআত বা সহসা সচকিত আলো শীর্ষক গদ্য ও পদ্য মিশ্রিত বইটি রচনা করেন। এ সময় তার বয়স হয়েছিল ষাট। এ বইয়ে তিনি মাঝে মাঝে আরবি কবিতা ব্যবহার করেছেন।

ইরাকির জীবনে যাকারিয়া ও সাদরুদ্দিন কৌনাভি- এ দু’জনেরই প্রভাব দেখা যায়। কৌনাভির মাধ্যমে ইরাকির ওপর আরব সুফি-দার্শনিক ইবনে আরাবির প্রভাবও পড়েছে। আর তা লামাআত বইয়েও দেখা যায়। ইরাকি ছিলেন রুমির গুরু শামসে তাব্রিজি ও শাইখ সায়িদ ফারগানিরও সমসাময়িক। তাদের সঙ্গে ইরাকির যোগাযোগ বা দেখা-সাক্ষাত হয়েছিল। কৌনিয়ায় থাকার সময় ইরাকি রুমির সামা’র মজলিশে যোগ দিতেন। রুমি তাকে খুব গুরুত্ব দিতেন ও প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব আমির মুয়িন উদ্দিন পারওয়ানার সহযোগিতায় তার জন্য তুকাত শহরে একটি খানক্বা বা আধ্যাত্মিক সুফিতত্ত্ব চর্চার কেন্দ্র বানিয়ে দেন এবং ওই কেন্দ্রের প্রধান ছিলেন ইরাকি। ইরাকি এখানেই লিখেছিলেন এশাকনামে শীর্ষক বই। ইরাকি মুলতান থেকে দূরে চলে গেলেও সেখানে তার মুরিদদেরকে নিজের ছেলের মাধ্যমে সুফিবাদের শিক্ষা দেয়া অব্যাহত রেখেছিলেন।

এক কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে ৭৮ অথবা ৮২ বছর বয়সে ইন্তিকাল করেন ইরাকি। তাকে দামেস্কের যাবাল আসসালিহিয়্যা এলাকায় মহিউদ্দিন আরাবির মাজারের পাশে দাফন করা হয়। কিন্তু বর্তমানে তার কবরের কোনো চিহ্ন সেখানে নেই।#

পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/ ১৭

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। 

ট্যাগ