ডিসেম্বর ২১, ২০২০ ১৮:২৫ Asia/Dhaka

গত দুই পর্বের ধারাবাহিকতায় আজও আমরা হিজরি সপ্তম শতক তথা খ্রিস্টিয় ত্রয়োদশ শতকের বিখ্যাত ইরানি কবি ও আধ্যাত্মিক সাধক বা আরেফ ফখরুদ্দিন ইরাকির রচনা ও অবদান নিয়ে কথা বলব।

গত পর্বে আমরা শাইখ ফাখরুদ্দিন ইরাকির দু'টি বিখ্যাত বই এশাকনামেহ ও  লামাআত বা সহসা সচকিত আলো শীর্ষক বই সম্পর্কে কথা বলেছি।

ইরাকির লেখা খোদাপ্রেম বিষয়ক বই 'লামাআত' কাঠামোগত দিক থেকে আহমাদ গাজ্জালির সাওয়ানিখ ও  শেখ সাদির গোলেস্তান বইয়ের মত। কিন্তু চিন্তাগত দিক ও বিষয়বস্তুর বিন্যাসের দিক থেকে বইটি ইবনে আরাবির ফুসুসু আল হিকাম-এর অনুসরণে লেখা হয়েছে।

বলা হয় ইবনে আরাবির ধর্মীয় বিশ্বাসের বিষয়ে সাদরুদ্দিন কৌনাভির একটি ক্লাসে খোদায়ি প্রেরণা বা আধাত্মিক ইঙ্গিত পাওয়ার পর তারই ভিত্তিতে ইরাকি রচনা করেন লামআত নামক বইটি।  সাইয়্যেদ হোসাইন নাসর্‌-এর মতে এ বইটি ফার্সি ভাষায় ইবনে আরাবিকে জানা ও বোঝার ব্যাপারে hঅন্য যে কোনো বইয়ের চেয়ে বেশি কার্যকর। সাদরুদ্দিন কৌনাভি ছিলেন ইবনে আরাবির পালিত পুত্র ও ছাত্র। একদল মানুষ কৌনাভির সামনে ইবনে আরাবির ‘ফুসুস’ ও ‘ফুতুহাতে মাক্কি’ বইটি পড়ত ও আলোচনা করত। ইরাকি সেসব শুনে হতেন উপকৃত। আর এসব আলোচনা শোনার পরপরই ইরাকি লামাআত বইটি লিখতেন।

লামাআত বইটি পুরোপুরি লেখা শেষ হলে ইরাকি তা কৌনাভিকে দেখান। কৌনাভি তা পুরোপুরি পড়ে তাতে চুমো দেন এবং বলেন: ইরাকি তুমি তো লোকদের কথার রহস্য প্রকাশ করে দিলে। তোমার লামাআত সত্যিই ফুসুসের ঠোঁট!  অনেক ক্ষেত্রে লামাআতের ভাষাও বেশ সাংকেতিক ও প্রতীকি হওয়ায় এ বইটির ব্যাখ্যা নিয়েও অনেক ব্যাখ্যা-গ্রন্থ লেখা হয়েছে।

প্রখ্যাত কবি জামি এ বইয়ের একটি ব্যাখ্যা-গ্রন্থ লিখেছেন যার নাম আশ্আয়ে আল লামাআত। জামি লামাআত বইটি সম্পর্কে লিখেছেন: এটি গদ্য ও পদ্য মিশিয়ে এমন সুন্দর আলোকময় যুক্তিতে ভরা যে তা ঘুমন্ত ব্যক্তিদের জাগিয়ে তোলে ও জাগ্রত ব্যক্তিদের করে আরও সচেতন। জামি লামাআতের নানা ব্যাখ্যাগ্রন্থের সমালোচনা করে বলেছেন, ইরাকির এ বইয়ের বক্তব্যে সংক্ষিপ্ততা ও সাংকেতিকতা থাকলেও  মূল বইটি  তার এ বইয়ের ব্যাখ্যাগ্রন্থগুলোর চেয়ে অনেক বেশি বোধগম্য!

সাইয়্যেদ হোসাইন নাসর্-এর মতে ইরাকির লামাআত বইয়ের বক্তব্যে সংক্ষিপ্ততা ও সাংকেতিকতা কুরআনের রীতিরই অনুসরণ! ইরাকি ও কবি হাফেজসহ অনেক আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্বই মনে করেন যে কোনো কোনো বিষয় সংকেত বা প্রতীক ছাড়া সাধারণ শব্দ দিয়ে বোঝানো যায় না।

আধ্যাত্মিক বিষয়গুলো বোঝাতে  আয়না, দরিয়া, সাগরের ঢেউ বা স্রোত, চাঁদ, আলো ও ছায়ার মত প্রতীক বা সংকেত ব্যবহার করেছেন ইরাকি। প্রেমিক ও প্রেমাস্পদের সম্পর্ক ও প্রেমিকের ওপর প্রেমাস্পদের অনিবার্য নির্ভরতা বোঝাতে শাইখ ফাখরুদ্দিন ইরাকি লিখেছেন:  প্রেমিক প্রেমাস্পদের ছায়ার মত। সে যেখানেই যায় তাকেও ছায়ার মত তার সঙ্গে সঙ্গে যেতে হয়। ছায়া কি কখনও আলো থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারে? আলো সরল রেখায় চলে বলে ছায়াকেও সরলরেখায় চলতে হয়। অস্তিত্বের একত্ব ও মৌলিক বা পরিপূর্ণ অস্তিত্বের মধ্যে অন্য অস্তিত্বের বিলীন বা ফানা হওয়া সম্পর্কে ইরাকি বলেছেন: কেউ একজন বরফ দিয়ে কলসি বানিয়ে তাতে পানি রাখে। এরপর সূর্য ওঠার পর দেখে যে বরফ ও পানি একাকার হয়ে গেছে। ঘরের ভেতর ঘরের অধিবাসী ছাড়া আর কেউ থাকতে পারে না।  

ইরাকির লামআত বইটির গদ্য-পদ্য মেশানো ভাষা এবং গদ্যময় পদ্য ও পদ্যময় গদ্য  তথা পদ্যের কাছাকাছি গদ্যের প্রকাশভঙ্গীর সঙ্গে শেখ সা’দির গোলেস্তান বইয়ের রীতিরও মিল দেখা যায়। কেউ কেউ মনে করেন তুরস্কের রুম অঞ্চলে ইরাকির সঙ্গে সা’দির সাক্ষাত হয়েছিল। তাদের জন্ম-সনের পার্থক্য কেবল চার বছর। রুমির সঙ্গেও ইরাকির যোগাযোগ ছিল। রুমি ইরাকিকে একজন সুফি কবি বলে মনে করতেন। অনেকে মনে করেন শেখ সা’দির  গোলেস্তান বইয়ে ইরাকির লামআত বইয়ের চিন্তাগত প্রভাব রয়েছে।

শাইখ ইরাকির লামাআত বইতে আরবি শব্দের ব্যাপক ব্যবহারও লক্ষ্যনীয়। কুরআনের আয়াত ও হাদিস ছাড়াও ফার্সিতে ব্যাপক প্রচলিত আরবি শব্দ, উদ্ধৃতি ও আরবি কবিতার অংশ থাকায় বইটির প্রায় ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ টেক্সটই হয়ে পড়েছে মূলত আরবি ভাষার টেক্সট্। ইরাকির এ বইটিতে ছোট ছোট বাক্যের ব্যাপক ব্যবহারও লক্ষ্যনীয়। এটা মূলত সে যুগের খোরাসানি রীতিরই স্বাক্ষর। ইরাকির লামাআত বইটিতে ইবনে আরাবি, কৌনাভি ছাড়াও রুমি, তাব্রিজি ও অন্য অনেক আরেফের সুফি চিন্তাধারার প্রভাবও লক্ষ্যনীয়। তার এ বইটির গদ্য হিজরি সপ্তম শতকের উৎকৃষ্ট ইরফানি ফার্সি গদ্যের নিদর্শন।

ইরাকির লামআত বইয়ের কেন্দ্রীয় বিষয় হল মা’রেফাত। মানুষ, অস্তিত্ব ও খোদা এই ত্রিবেনীর সম্পর্ক বিষয়ক জ্ঞান ও বিশেষভাবে আল্লাহর পরিচয় অর্জনই হল আধ্যাত্মিক জ্ঞান বা মারেফাত। মহান আল্লাহ সম্পর্কে জানাই হচ্ছে মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য। ইরাকির দৃষ্টিতে মানুষ নিজেকে জানার তথা আত্মার নানা অবস্থা ও শক্তি বা ক্ষমতাকে জানার মাধ্যমে আল্লাহ, পরকাল ও বিশ্ব-জগতকে জানতে পারে। আত্মার ক্ষমতাকে অনেকেই অসীম বলে মনে করেন। আল্লাহকে জানার ও পাওয়ার পথে যেসব বাধা আছে সেগুলো দূর করার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন ইরাকি। এসব বাধার মধ্যে রয়েছে সন্দেহ, অজ্ঞতা ও অপছন্দনীয় স্বভাব এবং জ্ঞান ও আত্মবিশ্বাসের বাধা।

নিজেকে জানার ও খোদাকে জানার বা খোদাপ্রেমের নানা পর্যায় নিয়ে আলোচনা করেছেন ইরাকি তার লামাআত বইয়ে। অন্তরের আয়না যত স্বচ্ছ হয় ততই তাতে খোদায়ি জ্ঞান বা আলোর ঝলক বেশি হয়। মানুষের আত্মা যখন হয় খোদার আয়না তখন সে দুই সত্তার আকর্ষণ থেকে মুক্ত হয়ে এক খোদার সঙ্গ পায়। ইরাকির মতে সব কিছুতেই ছড়িয়ে আছে আল্লাহর নিদর্শন এবং তাই প্রেমিকের দৃষ্টিতে সে সবই সুন্দর। সৃষ্টির নানা অংশ বা অস্তিত্ব পরম অস্তিত্ব বা চূড়ান্ত অস্তিত্বের তথা খোদার মুখাপেক্ষী বলে তারা সবই খোদামুখী। পুরনো সাগরে যে নতুন ঢেউ ওঠে তা আসলে সাগরেরই অংশ। খোদাপ্রেম কেবল পবিত্র অন্তরেই বাসা বাঁধে। হৃদয়ের চোখ খুলতে হলে অস্তিত্বগুলো সম্পর্কে জানতে হবে এবং তখনই খোদা ও মানুষের মধ্যে থাকা পর্দাগুলো দূর হয়ে যাবে।#

পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/ ২১

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। 

ট্যাগ