ডিসেম্বর ২৩, ২০২০ ১৮:২৯ Asia/Dhaka

গত কয়েক পর্বের ধারাবাহিকতায় আজও আমরা হিজরি সপ্তম শতক তথা খ্রিস্টিয় ত্রয়োদশ শতকের বিখ্যাত ইরানি কবি ও আধ্যাত্মিক সাধক বা আরেফ ফখরুদ্দিন ইরাকির রচনা ও চিন্তাধারা নিয়ে কথা বলব।

গত দুই পর্বের আলোচনায় আমরা হিজরি সপ্তম শতক তথা খ্রিস্টিয় ত্রয়োদশ শতকের  বিখ্যাত ইরানি কবি ও আধ্যাত্মিক সাধক বা আরেফ ফখরুদ্দিন ইরাকির রচনাবলী ও চিন্তাধারা নিয়ে কথা বলেছি। আজ আমরা ইরাকির গজল সাহিত্য নিয়ে কথা বলব।

ফখরুদ্দিন ইরাকির সাহিত্য-সাধনার লক্ষ্য ছিল ইরফান তথা খোদাপ্রেম ও খোদাপ্রেম-বিষয়ক আধ্যাত্মিক তত্ত্ব বা রহস্যগুলো প্রচার করা। তিনি ছিলেন মূলত মহিউদ্দিন ইবনে আরাবির ও আহমাদ গাজ্জালির চিন্তাধারার অনুসারী। খুব প্রাণবন্ত, সুন্দর ও আকর্ষণীয় গজলের মাধ্যমে এইসব চিন্তাধারা তুলে ধরেছেন ইরাকি। তার গজল খুবই আকর্ষণীয় ও স্বকীয়তায় ভাস্বর। ওয়াহ্‌দাতে অজুদ বা অস্তিত্বের একত্ব তথা কেবল মহান আল্লাহর অস্তিত্বই হচ্ছে মূল ও আসল অস্তিত্ব এই তত্ত্ব, কলন্দরি দরবেশদের মতবাদ, যোহোদ্ বা আধ্যাত্মিক সংযম-সাধনা- এসবই ইরাকির গজলের উপজীব্য। ফার্সি গজল রচয়িতাদের মধ্যে ইরাকি শীর্ষ-স্থানীয় বা অন্যতম সেরা আদর্শ হিসেবে বিবেচিত।

হিজরি সপ্তম শতক তথা খ্রিস্টিয় ত্রয়োদশ শতকে তৎকালীন ইরান-অঞ্চলে কবিতার নানা শাখার মধ্যে গজলই ছিল সবচেয়ে বেশি প্রচলিত ও জনপ্রিয়। ক্বাসিদা বা প্রশংসাসূচক কবিতার জনপ্রিয়তা ছিল তখন নিম্নগামী।

ইরাকি সব ধরনের কবিতা লিখলেও সবচেয়ে বেশি লিখেছেন গজল। ইরফান বা খোদাপ্রেম তত্ত্বের বাহন হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে তার গজল। আধ্যাত্মিক বা আত্মিক মুক্তির সাধনা তথা খোদাপ্রেমই ছিল তার গজলের মূল সুর। অবশ্য মরমি কবি ফরিদউদ্দিন আত্তারের ক্ষেত্রেও একই বক্তব্য প্রযোজ্য। সে যুগে, বিশেষ করে হিজরি সপ্তম শতকের গজল-রচয়িতাদের বেশিরভাগই ছিলেন আরেফ বা সুফি-সাধক। শেখ সা’দি, ফরিদউদ্দিন আত্তার,  ফখরুদ্দিন ইরাকি ও মাওলানা রুমি এই দিক থেকে একই শ্রেণীর আওতাভুক্ত। 

ফখরুদ্দিন ইরাকি তার গজলে যে ইরফান বা সুফিবাদের কথা বলেছেন তা হৃদয়-নিংড়ানো প্রকৃত খোদাপ্রেম-কেন্দ্রীক, তা আধ্যাত্মিক-সংযম-কেন্দ্রীক ইরফান বা সুফিবাদ নয়। গজলের মধ্যে কলন্দরি দরবেশদের চিন্তাধারা ও প্রতিবাদ বা অনুযোগ-কেন্দ্রীক উন্নত মানের গজল রচনা এবং এই ধারার বেশি সংখ্যক গজল রচনার দিক থেকে ফার্সি গজল সাহিত্যে হাকিম সানায়ির পরই সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছেন ফখরুদ্দিন ইরাকি। 

ইরফানি বক্তব্য ও দর্শন তুলে ধরার ক্ষেত্রে ইরাকির গজল যত বেশি সুমিষ্ট, আবেগময়, প্রাণবন্ত ও হৃদয়গ্রাহী তার এ সংক্রান্ত গদ্য ততটা সুমিষ্ট, প্রাণবন্ত ও হৃদয়-জুড়ানো নয়। অবশ্য এ বিষয়ে তার গদ্যের চেয়ে গজলের পরিমাণ অনেক বেশি।

ফখরুদ্দিন ইরাকির গজলের ভাষা মিষ্টি হলেও সহজ-সরল, সুস্পষ্ট ও প্রাঞ্জল। ছোটো ছোট পংক্তি বা চরণ নিয়ে তিনি রচনা করেছেন গজল।  ইরাকি গদ্যকে হৃদয়গ্রাহী করার চেয়ে গজল বা পদ্যকে বেশি হৃদয়গ্রাহী করতে পেরেছেন পদ্যের স্বভাবগত অপেক্ষাকৃত বেশি মিষ্টতা ও বেশি গীতিময়তা বা সুরময়তা এবং আবেগময়তার কারণেই।  একই কারণে ইরফানি বক্তব্যের ক্ষেত্রে ইবনে আরাবির গদ্যের চেয়ে ইবনে ফারেজ মিসরির কবিতা বেশি জনপ্রিয়।

সরলতা ও কোমল স্নেহময় আবেগময়তার দিক থেকে ইরাকির কবিতা ও গজল সা’দির কবিতা ও গজলের সমতুল্য। ইরফানি গজল ইরাকির মত কবিদের হাতে পেয়েছে অনন্য নান্দনিকতা ও সমৃদ্ধি যা দেহ এবং আত্মায় যোগায় অনাবিল সজীবতা ও স্বর্গীয় আনন্দে আত্মহারা হওয়ার অনুভূতি। আর এসবই সম্ভব হয়েছে আধ্যাত্মিক প্রেমকে তুলে ধরার কারণে। ইরাকির গজলের ভাষ্য-মতে যে হৃদয়ে খোদা-প্রেম নেই তা দানব বা শয়তানের ঘর। তার মতে প্রেমাস্পদ ছাড়া প্রেমিকের অস্তিত্ব অর্থহীন, কিন্তু প্রেমাস্পদ বা খোদা কারো মুখাপেক্ষী নন। প্রেমাস্পদের সৌন্দর্য ও প্রেমময় তৎপরতার সঙ্গে প্রেমিকের মিলন ছাড়া প্রেমিক  পূর্ণতা পায় না। আর এ জন্য প্রয়োজন আত্মসত্তা ও আত্মকেন্দ্রীকতাকে বিসর্জন দেয়া। খোদার প্রেমে আত্মহারা প্রকৃত প্রেমিক নিজের কিছুই মনে রাখে না ও রাখার দরকারও মনে করে না।

ইরাকির গজলের ভাষ্য-মতে পরিপূর্ণতা পাওয়া জ্ঞান বা বুদ্ধি তথা ঐশী জ্ঞান ও প্রেম সমার্থক।  খোদার প্রেমের পথে সামান্য বাধাও প্রকৃত প্রেমিকের কাছে হীরা-জহরতে ভরা দুই জাহানের চেয়েও বেশি প্রিয়। তাই দেখা যায় নবী-রাসুল, ইমাম ও আল্লাহর ওলিরা সব ধরনের বাধা, বিপদ, পরীক্ষা, যন্ত্রণা ও সর্বোচ্চ ত্যাগকেও হাসিমুখে বরণ করে নেন। এই ব্যথার পূজার মধুর সুর ইরাকির গজলের অন্যতম আকর্ষণ।

ইরাকি তার গজলে আধ্যাত্মিক প্রেমের নানা অবস্থা বা অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে উপমা বা রূপক ব্যবহার করেছেন। যেমন. খোদা প্রেমের পথে বেদনাকে আবে কাওসারের চেয়েও প্রিয় কিংবা খোদা থেকে বিচ্ছিন্নতার বেদনাকে কখনও আগুনে পোড়ার মত যন্ত্রণাদায়ক এবং কখনও এ বিরহ বা বেদনাকে মুখ ও হৃদয়ে তালা মেরে দেয়ার মত কষ্টকর বলে উল্লেখ করেছেন।

 ইরাকির গজলে দুঃখ ও বেদনার রয়েছে বিচিত্র রূপ। এই ব্যথা কখনও আনন্দদায়ক ও কখনও বেদনাময়। তার গজলে কখনও কখনও সুখটাই দুঃখের মত বেদনাদায়ক।  আসলে প্রত্যেক সুখের সঙ্গেই থাকে বেদনার সম্পর্ক বা পটভূমি।  আর এর বিপরীত কথাও সত্য। প্রত্যেক পবিত্র বেদনাই আনে অনাবিল সুখ। বেদনার রক্ত বা কাঁটাগুলো এক সময়  হীরা-জহরত বা ফুল হয়ে দেখা দেয়।#

পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/ ২৩

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। 

ট্যাগ