ডিসেম্বর ১৬, ২০২০ ০২:৩০ Asia/Dhaka

আজ আমরা খ্রিস্টিয় দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতকের তথা হিজরি ষষ্ঠ ও সপ্তম শতকের বিখ্যাত ইরানি কবি ও আধ্যাত্মিক সাধক আওহাদউদ্দিন কেরমানির জীবন নিয়ে কথা বলব।

আওহাদি কেরমানি নামে খ্যাত প্রখ্যাত ইরানি মনীষী শাইখ আবু হামিদ আওহাদউদ্দিন কেরমানির মূল নাম হচ্ছে হামিদ। তার জন্মের তারিখ পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। তবে অনুমান করা হয় যে তিনি জন্ম নিয়েছিলেন কেরমানের কাছে বার্দসির শহরে ৫৬১ হিজরিতে জিলহজ মাসের কোনো এক দিনে। যৌবনে পড়াশুনার জন্য বাগদাদে যান কেরমানি। বাগদাদেই পড়াশুনা শেষ করে শাইখ শামশুদ্দিন সাজ্জাসির মুরিদ বা শিষ্য হন ও তার কাছ থেকে প্রতিনিধিত্ব বা খেলাফতের পোশাক তথা খিরকা লাভ করেন কেরমানি। সাজ্জাসি ছিলেন প্রখ্যাত সুফি সাধক শামসে তাব্রিজির গুরু বা ওস্তাদ। তাব্রিজি মাওলানা রুমির শিক্ষক বা গুরু হিসেবে খ্যাত। যাই হোক্ বাগদাদ থেকে তুরস্কে যান কেরমানি। সেখানে তিনি অনেক মুরিদ বা শিষ্য পান। এ ছাড়াও বহু দেশ বা অঞ্চল সফর করেন আওহাদি কেরমানি।

আওহাদি কেরমানি ৬৩২ হিজরিতে বাগদাদে ফিরে আসেন। তিন বছর পর খ্রিস্টিয় ১২৯৮ সনে বাগদাদেই মারা যান কেরমানি। দিনটি ছিল ৬৩৫ হিজরির তেসরা শাবআন সোমবার। এ সময় তার বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর।

আওহাদউদ্দিন কেরমানি যখন বাগদাদে ফিরে আসেন তখন স্থানীয় আলেম ও দরবেশ বা সুফি-সাধকদের প্রধান হিসেবে খ্যাত শাইখ শিহাবউদ্দিন ওমর সোহরাওয়ার্দি ইন্তেকাল করেন। কেরমানি তার জানাজার নামাজে শরিক হয়েছিলেন। এ সময় তৎকালীন আব্বাসীয় খলিফা মুসতান্‌সার কেরমানিকে আলেমদের প্রধান তথা শাইখ আশশিউখ পদে নিয়োগ দেন।

আওহাদি কেরমানির রুবাইয়াত বা চতুর্পদী কবিতার খ্যাতি ইউরোপসহ বিশ্বের বহু অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে।

ইবনে আরাবি তার 'ফুতুহাত মাক্কিয়া' শীর্ষক বইয়ে আওহাদির নাম আওহাদউদ্দিন হামিদ বিন আবিল ফাখ্‌র বলে উল্লেখ করেছেন।  মানাকেবে আওহাদি নামক জীবনী বইয়ে আওহাদি কেরমানিকে তুরানশাহ সে’ শানবেহি’র সন্তান বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তুরান শাহ ছিলেন কেরমানের শাসক। সালযুকি রাজবংশের শাসকরা ১৫০ বছর পর্যন্ত কেরমান শাসন করেছেন। কিন্তু আওহাদি তুরানশাহের সন্তান ছিলেন-এমন তথ্য সঠিক নয় বলে মনে করেন আওহাদির কবিতা সংকলন 'দীওয়ান'-এর সম্পাদক আহমাদ আবু মাহবুব। তবে আওহাদি তুরানশাহ বিন তুগরিলের সন্তান না হলেও তার সঙ্গে জ্ঞাতি-গোষ্ঠীগত বা বংশীয় কোনো সম্পর্ক রাখতেন এবং এ কারণে অথবা আওহাদির ব্যাপক প্রতিভার কারণে কিংবা অন্য কোনো কারণে তাকে যুবরাজ পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন তুরানশাহ।

আওহাদি কেরমানি কেরমানের অশান্ত রাজনৈতিক পরিবেশ, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংকটের কারণে বাগদাদে হিজরত করতে বাধ্য হয়েছিলেন বলে মনে করা হয়। বাগদাদে ছাত্র হিসেবে একটি মাদ্রাসায় ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়ে কেরমানি শাফিয়ি মাজহাবের আইন বিষয়ক বই 'মিফতা'হ পড়েন।  উজ্জ্বল প্রতিভার গুণে অল্প দিনের মধ্যেই তিনি ওস্তাদের প্রতিনিধি ও ছাত্র-উপদেষ্টা হওয়ার  এবং হাক্কাকিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক হওয়ারও সৌভাগ্য অর্জন করেন। এ সময় তিনি একজন ইসলামী আইনবিদ হিসেবে খ্যাতিমান ছিলেন।

দৃশ্যত ফক্বিহ্‌ বা ইসলামী আইনবিদ হিসেবে খ্যাতিমান হয়ে ওঠার সময়ই আওহাদি কেরমানি সুফিবাদের প্রতি ঝুঁকে পড়েন। এ যুগে বাগদাদ ছিল সুফিদের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। পীর মাশায়েখদের জন্য সে সময় খানক্বাহ তৈরি করে দিতেন খলিফা ও রাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা। পীরদের প্রতিষ্ঠানের নামে ওয়াকফ্‌ করা হত উর্বর জমি। সাধারণ জনগণও তাদের খুব সম্মান করত ও তাদের নির্দেশকে ঐশী বা খোদায়ি নির্দেশের মতই গুরুত্ব দিত। সাধারণ মানুষ ও শাসক শ্রেণী তাদেরকে মূল্যবান উপহার সামগ্রী দিতেন। ফলে পীর-মাশায়েখরা এ সময় খুব স্বচ্ছল ও আরামদায়ক জীবন যাপন করতেন।

আওহাদি কেরমানি তার জীবনের এক বড় অংশই কাটিয়েছেন শিক্ষাদান কার্যক্রম ও জ্ঞানগর্ত বিতর্কে। কিন্তু তার তৃষ্ণার্ত আত্মা তাতে পরিতৃপ্ত হয়নি। এ সময় তিনি সুফিবাদে আকৃষ্ট হলেও  পীর-মাশায়েখদের প্রতিও ঝুঁকে পড়েননি। বরং তিনি ইবাদাত ও সংযম সাধনাকেই গুরুত্ব দিয়ে কোনো অর্থ ও রসদ-পত্র ছাড়াই হজ-যাত্রা শুরু করার সিদ্ধান্ত নেন। কষ্ট করার অভ্যাস না থাকায় তা করার সাধনা শুরু করেন হজ-সফরের প্রস্তুতি হিসেবে। যেমন, দীর্ঘ সময় ধরে রোজা রাখতেন এবং দিন ও রাতে বহু রাকাআত নামাজ আদায় করতেন। প্রবল শীতের রাতে ও গরমের দিনগুলোতে খালি পায়ে হাঁটতেন। কিন্তু এত কিছু করার পরও তার হৃদয়ে খোদাপ্রেমের আগুন জ্বলে ওঠেনি। অবশেষে রুকন্‌উদ্দিন মুহাম্মাদ সাজ্জাশির আস্তানা বা খানকাহ মুবারকে তিনি পেলেন ঐশী প্রেমের প্রকৃত স্বাদ। #

পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/ ২৩

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। 

ট্যাগ