জানুয়ারি ২১, ২০২১ ১৯:০৩ Asia/Dhaka

পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র এ পর্বে সূরা আয-যুমারের ৩৩ ও ৩৭ নম্বর আয়াতের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা তুলে ধরা হবে। এই সূরার ৩৩ ও ৩৪ নম্বর নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

 وَالَّذِي جَاءَ بِالصِّدْقِ وَصَدَّقَ بِهِ أُولَئِكَ هُمُ الْمُتَّقُونَ (33) لَهُمْ مَا يَشَاءُونَ عِنْدَ رَبِّهِمْ ذَلِكَ جَزَاءُ الْمُحْسِنِينَ (34)

“যে সত্য নিয়ে আগমন করছে এবং (যে) সত্যকে সত্য (হিসেবে) মেনে নিয়েছে; তারাই তো খোদাভীরু।” (৩৯:৩৩)

“তাদের জন্য তাদের পালনকর্তার কাছে তাই রয়েছে, যা তারা চাইবে। এটা সৎকর্মশীলদের পুরস্কার।” (৩৯:৩৪)

কিয়ামতের দিন মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করা হবে। মুমিন ও মুশরিক। গত আসরের শেষ আয়াতে কিয়ামতের দিন মুশরিকদের পরিণতির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, বিদ্বেষ, গোঁয়ার্তুমি ও সত্যের বিরোধিতা করার কারণে জাহান্নামই হবে তাদের ঠিকানা। এরপর এই দুই আয়াতে মুমিন ব্যক্তিদের পরিণতির কথা বর্ণনা করে বলা হচ্ছে: তারা আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা সত্য বাণী শুনেছে, তাকে সত্য হিসেবে স্বীকার করেছে এবং তার প্রতি ঈমান এনে মুত্তাকি বা খোদাভীরু বান্দায় পরিণত হয়েছে। এ ধরনের মানুষ অন্তর দিয়ে আল্লাহর বাণী মেনে নিয়েছে এবং মুখে সেটা স্বীকার করেছে। এরাই দ্বীন প্রচারকারী ও দ্বীনের শিক্ষা বাস্তবায়নকারী সত্যিকারের সৎকর্মশীল বান্দা। এ ধরনের মানুষ ধর্ম পালনের ক্ষেত্রে লৌকিকতা ও নিফাকি আচরণ থেকে মুক্ত ও পবিত্র।

কাজেই মুশরিকদের পরকালীন আবাস জাহান্নাম হলেও এ ধরনের সৎকর্মশীল মুমিনকে জান্নাতে আমন্ত্রণ জানানো হবে। সেখানে তারা যা চাইবে তাদের জন্য তারই ব্যবস্থা করা হবে। সেখানে তাদের শারিরীক চাহিদা পূরণের যেমন ব্যবস্থা থাকবে তেমনি তাদের আত্মিক প্রয়োজনও মেটানো হবে।  সত্যিকারের মুমিন ব্যক্তিরা পার্থিব জীবনে অনেক বেশি সৎকর্ম করেন এবং পরোপকারে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। কাজেই জান্নাতের যে পুরস্কার তাদের জন্য অপেক্ষা করছে তা পার্থিব জীবনের এসব সৎকর্মেরই প্রতিদান। 

এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১. কথা ও কর্মে সত্যবাদিতা আল্লাহর প্রতি ঈমানের পূর্বশর্ত। ঈমানদার ব্যক্তির আত্মার সঙ্গে মিথ্যাচারের সম্পর্ক নেই অর্থাৎ ঈমানদার ব্যক্তি মিথ্যা বলতে পারে না।

২. ধর্ম প্রচারকারী বা মুবাল্লিগের বক্তব্য তখনই মানুষের ওপর প্রভাব ফেলে যখন সে নিজে তার বক্তব্য আমল করে। তা না হলে দ্বীন প্রচারের কাজে উল্টো ফল হতে পারে।  অর্থাৎ মানুষ ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার পরিবর্তে ধর্ম থেকে আরো দূরে সরে যেতে পারে।

৩- তাকওয়া ও সৎকর্ম পরস্পরের পরিপূরক।  পবিত্র কুরআনের বক্তব্য অনুযায়ী মুত্তাকির দ্বারা কখনো অসৎকর্ম সম্পাদিত হতে পারে না। 

এই সূরার ৩৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে:

لِيُكَفِّرَ اللَّهُ عَنْهُمْ أَسْوَأَ الَّذِي عَمِلُوا وَيَجْزِيَهُمْ أَجْرَهُمْ بِأَحْسَنِ الَّذِي كَانُوا يَعْمَلُونَ (35)

“যাতে আল্লাহ তাদের মন্দতম কর্মসমূহ মার্জনা করেন এবং তাদের সর্বোত্তম কর্মের পুরস্কার তাদেরকে দান করেন।” (৩৯:৩৫)

মুত্তাকি ও সৎকর্মশীল ব্যক্তিরা সব সময় মহান আল্লাহর কাছে এই আকাঙ্ক্ষা করে যে, তিনি যেন তাদের মন্দ কর্ম বা গোনাহগুলো মাফ করে দেন এবং পুরস্কার দেয়ার সময় তাদের সর্বোত্তম কাজগুলোকে মাণদণ্ড হিসেবে গ্রহণ করেন। এই আয়াতে বলা হচ্ছে, আল্লাহ তায়ালা মুত্তাকিদের এই দোয়া কবুল করেন এবং তাদের গোনাহগুলো ক্ষমা করে দেয়ার পাশাপাশি তাদেরকে সর্বোত্তম পুরস্কার দান করেন।

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, তাকওয়ার অর্থ এই নয় যে মুত্তাকি ব্যক্তি সব ধরনের গুনাহমুক্ত থাকবে এবং তার দ্বারা কখনোই কোনো মন্দ কর্ম সংঘটিত হবে না। বরং তাকওয়ার অর্থ হচ্ছে, মানসিকভাবে এই দৃঢ়তা থাকা যে, সে কোনো গোনাহের কাজ করবে না বা আল্লাহ তায়ালার অবাধ্য হবে না। কিন্তু সেই দৃঢ়তার মধ্যেই মুত্তাকি ব্যক্তির কখনো কখনো ভুল হয়ে যেতে পারে এবং অনিচ্ছাকৃতভাবে তিনি গোনাহর কাজে জড়িয়ে যেতে পারেন। এমনটি না হলে আল্লাহ তায়ালা মুত্তাকিদের গুনাহ মাফ করে দেয়ার প্রসঙ্গ তুলতেন না। তারা গুনাহ করে ফেলতে পারেন বলেই ক্ষমা করে দেয়ার প্রসঙ্গ এসেছে।

তাকওয়া হচ্ছে, এমন একটি ঢাল যা দিয়ে একজন যোদ্ধা প্রতিপক্ষের তীর থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারেন। কিন্তু কখনো কখনো এমন তীরও শত্রুর পক্ষ থেকে নিক্ষিপ্ত হতে পারে যা ঢাল দিয়ে ঠেকানো সম্ভব নয়।

তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, মুত্তাকি ব্যক্তি গুনাহমুক্ত থাকার জন্য যে আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালান আল্লাহ তায়ালা তাতে খুশি হয়ে তার অনিচ্ছাকৃত গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেন এবং সে যেসব সৎকর্ম করেছে তার চেয়ে অনেক বেশি উত্তম পুরস্কার দান করেন।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১- মানুষের মনের নিয়ত বা সংকল্পই বড় কথা। সে যদি গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে তাহলে আল্লাহ তায়ালার তার গোনাহগুলোকে উপেক্ষা করবেন এবং তার ভালো কাজের সর্বোত্তম পুরস্কার দেবেন।

২- আল্লাহর দয়া পাওয়ার পূর্বশর্ত হচ্ছে গুনাহমুক্ত জীবনযাপনের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চালানো।

সূরা যুমারের ৩৬ ও ৩৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

 أَلَيْسَ اللَّهُ بِكَافٍ عَبْدَهُ وَيُخَوِّفُونَكَ بِالَّذِينَ مِنْ دُونِهِ وَمَنْ يُضْلِلِ اللَّهُ فَمَا لَهُ مِنْ هَادٍ (36) وَمَنْ يَهْدِ اللَّهُ فَمَا لَهُ مِنْ مُضِلٍّ أَلَيْسَ اللَّهُ بِعَزِيزٍ ذِي انْتِقَامٍ (37)

“আল্লাহ কি তার বান্দার জন্য যথেষ্ট নন? অথচ (কাফেররা) আপনাকে আল্লাহর পরিবর্তে অন্য উপাস্যদের ভয় দেখায়। এবং আল্লাহ যাকে গোমরাহ করেন, তার কোন পথপ্রদর্শক নেই।” (৩৯:৩৬)

“আর আল্লাহ যাকে পথপ্রদর্শন করেন, তাকে পথভ্রষ্টকারী কেউ নেই। আল্লাহ কি পরাক্রমশালী ও প্রতিশোধগ্রহণকারী নন?”(৩৯:৩৭)

আগের আয়াতগুলোতে ঈমানদার ও কাফেরদের মধ্যকার পার্থক্য তুলে ধরার পর এই দুই আয়াতে আল্লাহ তায়ালা মহানবী (সা.)কে উদ্দেশ করে বলেন: কাফেররা আপনার দাওয়াতের বাণী গ্রহণ করার পরিবর্তে আপনার বিরুদ্ধাচরণ করছে এবং হুমকি দিচ্ছে। অথচ আল্লাহ তায়ালা আপনার জন্য যথেষ্ট এবং তাঁর অনুমতি ছাড়া কেউ আপনার ক্ষতি করতে পারবে না। এরপর বলা হচ্ছে, যে ব্যক্তি আল্লাহর হেদায়েতের বাণী মেনে নেবে সে পথভ্রষ্টতার হাত থেকে রক্ষা পাবে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি হেদায়েতকে দূরে ঠেলে দেবে পথভ্রষ্টতা থেকে তাকে কেউ রক্ষা করতে পারবে না।

এই দুই আয়াতের শেষাংশে বলা হচ্ছে, কাফির ও মুশরিকরা কি একথা জানে না যে, তাদের পক্ষে আল্লাহ তায়ালার বিরুদ্ধাচরণ করে টিকে থাকা সম্ভাব নয়? তারা কি জানে না যে, যারা আল্লাহর রাসূল ও তাঁর শিক্ষার বিপরীতে দাঁড়িয়ে যায় তাদের কাছ থেকে আল্লাহ তায়ালা প্রতিশোধ গ্রহণ করেন? আল্লাহর প্রতিশোধ হচ্ছে এ ধরনের মানুষকে গোমরাহ বা পথভ্রষ্ট করে দেয়া।

এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১- মানুষ যদি আল্লাহর অনুগত বান্দা হয় তাহলে তার জীবনের সব দায়িত্ব আল্লাহ তায়ালা নিজে গ্রহণ করেন।

২- মুমিন ব্যক্তি শত্রুর হুমকির মোকাবিলায় আল্লাহর আশ্রয় চায় এবং শত্রুর শক্তিমত্তা দেখে ভয় পাওয়ার পরিবর্তে আল্লাহর সাহায্য পাওয়ার আশা রেখে সত্য পথে অটল ও অবিচল থাকে।

৩- মানুষের পথভ্রষ্ট হয়ে যাওয়ার জন্য সে নিজেই দায়ী। সে তার অপরাধী কর্মকাণ্ডের জন্য হেদায়েতের আলো থেকে বঞ্চিত হয় ও পথভ্রষ্ট হয়ে যায়।#

পার্সটুডে/এমএমআই/এআর/২১

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।