জানুয়ারি ৩০, ২০২১ ১৯:৩০ Asia/Dhaka

তালাক বা বিয়ে বিচ্ছেদ নিয়ে কথা বলছিলাম আমরা। গত আসরে আমরা বলেছি মানব জাতিকে টিকিয়ে রাখার জন্যে হলেও যে একটি সুশৃঙ্খল ও নিয়মতান্ত্রিক পরিবার ব্যবস্থা জরুরি তা অনেকেই উপলব্ধি করতে পারেন না।

মানুষকে যদি যেনতেনভাবে যেখানে সেখানে তার যৌন আকাঙ্ক্ষা পূরণের অনুমতি দেয়া হতো তাহলে পরিবার প্রথাই চালু হতো না এবং সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটতো না। কিন্তু অনেকেই এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করে লাগামহীন ও অবাধ যৌন সম্পর্কে জড়াচ্ছেন। বাস্তবতা হচ্ছে যেসব সমাজে যৌন সম্পর্ক উন্মুক্ত এবং লাগামহীন সেখানেই পরিবার ব্যবস্থা দুর্বল। কারণ এ ধরনের সমাজে নারী ও পুরুষেরা যৌন সম্পর্কের জন্য পরিবার গঠনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন না, তারা পরিবার বা বিয়ে বহির্ভূত যৌন সম্পর্কে জড়াতে দ্বিধাবোধ করেন না।

পাশ্চাত্যের অনেক গবেষকই মনে করেন, নারী ও পুরুষের সৃষ্টিগত ও প্রকৃতিগত পার্থক্যের বিষয়টি গভীরভাবে বিবেচনায় না নিয়ে সমতার যে স্লোগান তোলা হয়েছে এবং এই স্লোগানের ভিত্তিতে যে আইন প্রণয়ন করা হয়েছে এখন তা গোটা সমাজ ব্যবস্থার জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ধরনের আইনের কারণে তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদ ক্রমেই বেড়ে চলেছে। তারা পরিসংখ্যান তুলে ধরে বলেছেন, পশ্চিমা দেশগুলো বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এ ধরনের আইন পাশের পর তালাক উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। হ্যালমোট শেলসকির মতো সমাজ বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এ ধরনের আইন পারিবারিক শৃঙ্খলা নষ্ট করে দিয়েছে। তার মতে, সমাজের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো পরিবারেও প্রতিটি সদস্যের আলাদা আলাদা ভূমিকা ও দায়িত্ব রয়েছে এবং প্রতিটি সদস্যের পক্ষ থেকেই আলাদা আলাদা দায়িত্ব গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে দায়িত্বের ক্ষেত্রে যে পার্থক্য ও তারতম্য তা পারিবারিক জীবনকে অকৃত্রিম আনন্দ দেয় এবং পরিবারকে প্রাণবন্ত করে তুলতে ভূমিকা রাখে বলে তিনি মনে করে। তার মতে, পরিবার  টিকে থাকার নিশ্চয়তাও দেয় দায়িত্বের ক্ষেত্রে এই পার্থক্য। 

একটি প্রতিষ্ঠান বা গ্রুপে যদি সব সদস্যের দায়িত্ব একই ধরনের হয় এবং সবাই একই পর্যায়ের হয় তাহলে ওই প্রতিষ্ঠান বা গ্রুপ টিকে থাকার সম্ভাবনা কমে যায়।  এ ধরণের প্রতিষ্ঠান বেশি দিন টিকে থাকতে পারে না। পরিবারের মতো ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানেও নারী ও পুরুষকে তাদের শারীরিক ও মানসিক অবস্থা, গঠন ও সক্ষমতা অনুযায়ী দায়িত্ব নিতে হবে। সে অনুযায়ী কাজ করতে হবে। এর ব্যতিক্রম হলে এ ধরণের প্রতিষ্ঠান টিকে থাকবে না অর্থাৎ পরিবার প্রথা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এর ফলে মানবজাতিই ধ্বংসের মুখে পড়বে। পাশ্চাত্য সমাজে তালাকের একটি বড় কারণ হল নারী ও পুরুষের ভূমিকার মধ্যে গোলমালে অবস্থা। অন্যভাবে বলা যায়, নারী ও পুরুষের ভূমিকা ও দায়িত্বের মধ্যে জটিল মিশ্রণ ঘটে গেছে সেখানে। এর ফলে  দায়িত্ব বণ্টনের ক্ষেত্রে এক ধরনের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। পাশ্চাত্যে এখন নারী ও পুরুষের দায়-দায়িত্বের মধ্যে আলাদা বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই। অতীতে পরিবার গঠনের আগেই হবু স্বামী ও স্ত্রী পারিবারিক দায়িত্ব পালনের জন্য প্রস্তুতি নিত। দায়িত্ব পালনের জন্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতো।  মানসিক দিক থেকেও নিজেকে সেভাবে গড়ে তুলত।

বর্তমানে পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে ফেমিনিজমের আলোকে শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে এবং নারী ও পুরুষের দায়িত্ব সংক্রান্ত কাঠামো ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে দেখা যাচ্ছে পরিবার বা সমাজের কোনো সদস্য পারিবারিক দায়িত্ব পালনের জন্য আগে থেকে কোনো ধরণের প্রস্তুতি নিচ্ছে না। কোনো ধরণের পূর্বপ্রস্তুতি না থাকার কারণে পরিবার গঠনের পর সেখানে এক জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে, বিশৃঙ্খলা দেখা দিচ্ছে। এর ফলে পরিবার নামের প্রতিষ্ঠানটি আর বেশি দূর এগোতে পারছে না।  খোদ পরিবারই ভেঙে যাচ্ছে। এর ফলে স্বামী ও স্ত্রী যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তেমনি অন্য সদস্যরাও ক্ষতির মুখে পড়ছে। বিখ্যাত সমাজ বিশ্লেষক কির্ক প্যাট্রিক মনে করেন, তালাকের কারণে একজন শিশু সন্তানের মধ্যে যে মানসিক বিপর্যয় ঘটে তা বাবা-মায়ের কোনো একজনের মৃত্যুর চেয়েও ভয়াবহ।  শিশুরা বাবা-মায়ের মৃত্যুকে যতটা সহজে মেনে নিতে পারে ততটা সহজে বাবা-মায়ের বিয়ে বিচ্ছেদ বা ডিভোর্স মেনে নিতে পারে না। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, বাবা-মায়ের সম্পর্কচ্ছেদ বা তালাকের সঙ্গে ওই দম্পতির সন্তানের মানসিক সমস্যার সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে।

ব্রিটেনে ছয় হাজার শিশু-কিশোরের উপর চালানো এক গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, শিশুদের উপর বিশেষকরে সাত বছরের বেশি বয়সী শিশুদের ওপর বাবা-মায়ের বিচ্ছেদের মারাত্মক প্রভাব রয়েছে। সাধারণভাবে তাদের মধ্যে বিষণ্ণতার পাশাপাশি নানা ধরনের মানসিক সমস্যা দেখা দেয় এবং বয়স বাড়ার সাথে সাথে এসব সমস্যা আরো বাড়তে থাকে। বিশেষ করে পরিবারে বাবার অনুপস্থিতি কন্যা সন্তানের উপর খুবই নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।  'টোয়াইস এডোপটেড' বা 'দুই বার দত্তক নেয়া হয়েছে' শীর্ষক বইয়ের লেখক মাইকেল রিগান তার নিজের বাবা-মায়ের বিচ্ছেদের উদাহরণ টেনে লিখেছেন, যখন আমার বাবা-মা আলাদা হয়ে গেল তখন তারা যেন আমার জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু কেড়ে নিলো। নিরাপত্তাবোধ, ভালোবাসা, সুখানুভূতি এর সবই তারা যেন নষ্ট করে দিল, সব ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে গেল। এখন শিশু সন্তানটির ওপর দায়িত্ব পড়লো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ছিন্ন-ভিন্ন অংশ জড়ো করে গুছিয়ে নেয়ার এবং একটি পথ নির্বাচনের। তালাক সব সময় এ ধরণেরই এক কঠিন সামাজিক সমস্যা।

তালাকের কারণে একটি পরিবারের সদস্যরাই কেবল ক্ষতিগ্রস্ত হয় তা কিন্তু নয়। এই ভাঙনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে গোটা সমাজ- সংস্কৃতি এমনকি অর্থনীতির ওপরও।  এই বাস্তবতা উপলব্ধি করেই পাশ্চাত্যের সরকারগুলো তালাক বা বিয়ে বিচ্ছেদ কমাতে নানা পরিকল্পনা হাতে নিচ্ছে। কিন্তু জীবন সম্পর্কে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন সাধিত না হলে এ ধরণের পরিকল্পনা করে খুব একটা সাফল্য পাওয়া যাবে না। এক্ষেত্রে সফল হতে হলে লাইফ স্টাইলে পরিবর্তন আনতে হবে, দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। পরিবার টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনীয়তা হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে হবে।#

পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ/মো: আবুসাঈদ/ ৩০

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ