ফেব্রুয়ারি ০৯, ২০২১ ১৯:৩০ Asia/Dhaka

ইরানে ইসলামী বিপ্লবের বয়স ৪২ বছর পূর্ণ হল। বিস্ময়করভাবে এ বিপ্লবের অগ্রযাত্রা আজও অব্যাহত রয়েছে এবং তা এখনও বিশ্বের চিন্তাশীল মহলে ও সংবাদের জগতে শীর্ষস্থানীয় আলোচ্য বিষয় হিসেবে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছে।

ইরানের এ মহান বিপ্লবের প্রশংসা করে বিভিন্ন সময়ে বক্তব্য রেখেছেন মুসলিম ও অমুসলিম অনেক মনীষী এবং এখনও তা অব্যাহত রয়েছে।

বাংলাদেশের প্রখ্যাত সুন্নি আলেম ও শিক্ষাবিদ মাওলানা মোহাম্মাদ উল্লাহ হাফেজজি হুজুর ইরানের ইসলামী বিপ্লবের নানা দিকের ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। ইরানি যুব সমাজের মধ্যে জিহাদের প্রতি প্রবল আকর্ষণ, নারী সমাজের ইসলামী শালীন পোশাক ও ইমাম খোমেনীর চালচলন আর ব্যক্তিত্বে মহানবীর (সা) প্রভাব তাকে গভীরভাবে মুগ্ধ করেছিল। ভারত উপমহাদেশের প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ সাইয়্যেদ আবুল আলা মওদুদি বলেছিলেন, ইরানের ইসলামী বিপ্লব আমার হৃদয়ের স্পন্দন। তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ ও ইসলাম ধর্ম প্রচারক মরহুম আহমাদ দিদাত তার ইরান সফরের স্মৃতিচারণে বলেছিলেন,
'ইমাম এলেন, তার থেকে দশ মিটার মত দূরে ছিলাম আমি; আমি ইমামকে দেখলাম। তিনি আমাদেরকে প্রায় আধা ঘণ্টার একটি লেকচার দিলেন, আর কুরআনের বাইরে এতে কিছু ছিল না। এই মানুষটা যেন কম্পিউটারাইজড এক কুরআন। আর তিনি যখন পাশের একটা রুম থেকে হেঁটে এসে ভিতরে ঢুকলেন, সবার উপর তাঁর যে প্রভাব, তাঁর যে কারিশমা – বিস্ময়কর ! তাঁর দিকে তাকানোর সাথে সাথে কোনো ভাবনা ছাড়াই চোখের কোল বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে শুরু করে। আপনি তাঁর দিকে তাকান : আপনার চোখ অশ্রুসজল হয়ে যাবে। এর চেয়ে বেশি সুদর্শন বৃদ্ধ মানুষ আমি জীবনে কখনো দেখিনি।  কোনো ছবি, ভিডিও বা টিভি তাঁকে উপযুক্তভাবে তুলে ধরতে পারবে না : আমার সারা জীবনে দেখা সবচেয়ে হ্যান্ডসাম মানুষ হলেন তিনি। 
সভ্যতাগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব তত্ত্বের প্রণেতা মার্কিন তাত্ত্বিক হান্টিংটন ১৯৯৩ সালে বলেছিলেন, রাজনৈতিক ইসলাম অনুপ্রেরণা পেয়েছে ইরানের ইসলামী বিপ্লবের কাছ থেকে। তিনি বলেছেন, যে ইসলাম নিজেকে পাশ্চাত্যের প্রতিদ্বন্দ্বী বলে মনে করে তা মার্কিন বিশ্ব-ব্যবস্থার জন্য প্রধান বিপদ।
ফরাসি ইসলাম বিশেষজ্ঞ ইয়ান রিচার্ড বিপ্লব-পূর্বকালে ইরানে শাহের বিরোধিতা সম্পর্কে লিখতে গিয়ে বলেছেন, ষাটের দশকের পর পাহলভি সরকারের পাশ্চাত্য-প্রীতির ব্যাপকতায় ইরানী জনগণ অসন্তুষ্ট হয়েছিলো। যার ফলে ইরানী জনগণ তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির দিকে ফিরে আসা এবং আত্মপরিচয় ফিরে পাবার তাকিদ অনুভব করেছিল। দল-মত-মাযহাব নির্বিশেষে ইরানের ইসলামী বিপ্লবে জনগণের ব্যাপক উপস্থিতি সম্পর্কে ফরাসি বিশিষ্ট লেখক, সাংবাদিক এবং মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ এরিক রোলো বলেছেন, ইরানের বিপ্লবই একমাত্র ধর্মীয় বিপ্লব যেখানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা পর্যন্ত একত্রে মিলেমিশে আন্দোলন করেছিল। ব্রিটিশ গবেষক এবং ইরান বিষয়ক বিশেষজ্ঞ প্রেড হ্যালিডে শাহের বিরুদ্ধে জনগণের বিশাল বিক্ষোভকে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড়ো গণবিক্ষোভ বলে উল্লেখ করেছেন।

ফরাসি চিন্তাবিদ মিশেল ফুকো ইরানের ইসলামী বিপ্লব নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। তিনি বলেছেন, 'আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করতাম, জনগণের ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা বা প্রত্যয় অনেকটা খোদা কিংবা আত্মার মতোই অদৃশ্য, চোখে দেখা যায় না...কিন্তু আমরা তেহরানে এবং সমগ্র ইরানে একটি জাতির সামষ্টিক ইচ্ছা লক্ষ্য করেছি। এটা খুবই প্রশংসনীয় এবং বিরল একটি ঘটনা।'
ফুকো ইরানের ইসলামী বিপ্লব পরিদর্শনে এসেছিলেন। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা এবং জনগণের ঐক্য ও সংহতি দেখে তিনি অভিভূত হয়েছেন। তিনি তাঁর 'নিষ্প্রাণ বিশ্বের প্রাণ ইসলামী বিপ্লব' নামক গ্রন্থে লিখেছেন-"বাস্তবতা হলো এই বিপ্লবী ঘটনার উদাহরণ ইতিহাসে বিরল। কারণ এই বিপ্লবে পুরো একটি জাতির আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে।" তিনি আরো বলেছেন, "আধ্যাত্মিকতা ছিল ইরানের ইসলামী বিপ্লবের মূলভিত্তি। এ বিপ্লব পুরনো চিন্তাধারার প্রতি ফিরে যাওয়ার পরিবর্তে আধ্যাত্মিকতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ নতুন দৃষ্টিভঙ্গি পেশ করেছে। এ বিশেষত্ব ইরানের ইসলামী বিপ্লবকে বিশ্বের অন্যান্য বিপ্লব থেকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য দান করেছে এবং নিজেই একটি আদর্শে পরিণত হয়েছে।" 
ফুকো মরহুম ইমাম খোমেনীর যোগ্যতা ও ব্যক্তিত্ব প্রসঙ্গে বলেছেন: আয়াতুল্লাহ খোমেনীর ব্যক্তিত্ব কিংবদন্তীতুল্য ও ক্যারিজমাটিক এবং অন্য কোনো বিপ্লবেই এমন নেতা দেখা যায় না। কারণ, জনগণের সঙ্গে তাঁর রয়েছে গভীর ঘনিষ্ঠতার বন্ধন। কোনো সরকার-প্রধান বা রাজনৈতিক নেতাই দুনিয়ার সব গণমাধ্যমের সমর্থন নিয়েও ইমাম খোমেনীর অবস্থান বা মর্যাদার সমতুল্য অবস্থার দাবি করতে পারবেন না। ফুকো ইরানের ইসলামী বিপ্লবকে "প্রথম অত্যাধুনিক বিপ্লব" ও "গণজাগরণের আধুনিকতম রূপ" বলেও মন্তব্য করেছেন। 
ফ্রান্সের বিশিষ্ট সাংবাদিক পিয়ের ব্যাল্যান্সে বিপ্লবী আন্দোলন চলাকালে তেহরানে ছিলেন। তিনি 'ইরান,আল্লাহর নামে বিপ্লব' নামক গ্রন্থে লিখেছেন, যে বিষয়টি আমাকে বিস্মিত করেছে তাহলো একটি জাতির প্রায় সমস্ত মানুষ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে...। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা দল বেঁধে এসে বলছে আমরা সবাই এক, সবাই কুরআনের সমর্থক, সবাই মুসলমান, আমাদের মাঝে কোনো ভেদাভেদ নেই।'
ডক্টর মিশেল জনসন বলেছেন-ইরানের ইসলামী বিপ্লব ষোল শতকের পর পশ্চিমাদের ওপর মুসলমানদের প্রথম বিজয় হিসেবে স্বীকৃত। এই বিপ্লবের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বা মূল চালিকাশক্তি হল ইসলাম-নির্ভরতা।
মার্কিন এম.আই.টি. বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এম ফিশার সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ইসলামী বিপ্লবের প্রভাব সম্পর্কে বলেন, ইমাম খোমেনী (রহ)-এর কাছে বিপ্লব কেবল একটা রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক বিপ্লব ছিল না, একইসঙ্গে তা ছিল আধ্যাত্মিক এবং ইসলামী বিপ্লব। ফলে সরকার, শাসনব্যবস্থা এবং সামাজিক আচরণের ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তনের প্রত্যাশা দেখা দেয়। 
রুশ রাজনীতিবিদ সের্গেই বাবুরিন বিপ্লবে ইসলামের ভূমিকা সম্পর্কে বলেছেন-ইসলামী বিপ্লব কেবল ধর্মীয় কোনো বড়ো আন্দোলনই নয়,বরং মানুষের স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্যে সামাজিক ন্যায়-ভিত্তিক একটি রাজনৈতিক পট পরিবর্তন।#

 

পার্সটুডে/আমির হুসাইন/আবু সাঈদ/০৯

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ