পাশ্চাত্যে জীবন ব্যবস্থা (পর্ব-১৬)
গত আসরে আমরা বলেছি পাশ্চাত্যের পরিবার ব্যবস্থায় নৈতিক মূল্যবোধের বিষয়টি খুব একটা গুরুত্ব পায়নি। আইন দিয়েই পরিবারের নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু পরিবার ব্যক্তিগত সীমানার আওতাভুক্ত এবং সেখানে সব বিষয়ই গোপন রাখা সম্ভব।
এ কারণে পারিবারিক সহিংসতার নানা দিক ও খুটিনাটি বিষয় প্রমাণ করা অত্যন্ত কঠিন। এর ফলে এ ধরণের আইন থাকা সত্ত্বেও পারিবারিক সহিংসতা কমছে না। কিছু দিন আগেও ইতালির সরকারকে সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে নয়া আইন অনুমোদন করতে হয়েছে। পারিবারিক সহিংসতা রোধে আইনের প্রয়োজন রয়েছে কিন্তু এর পাশাপাশি এই সহিংসতার কারণ অনুসন্ধান করে সেদিকেও নজর দিতে হবে। কিন্তু পাশ্চাত্যের জীবন ব্যবস্থায় সেটা খুব একটা গুরুত্ব পাচ্ছে না। তারা ক্রমেই পরিবার ব্যবস্থা থেকেই বেরিয়ে আসছে।
পরিবারের সদস্যদের মধ্যে যোগাযোগ ও সম্পর্কের ওপর সুখ-শান্তি নির্ভর করে। পরিবারই হচ্ছে সন্তানদের নৈতিক ও মানসিক শিক্ষার প্রধান কেন্দ্র এবং তাদের বৈষয়িক ও আধ্যাত্মিক পৃষ্ঠপোষক। পরিবার নামক প্রতিষ্ঠান বা কেন্দ্রটি যদি সঠিকভাবে কাজ না করে তাহলে তা সন্তান তথা শিশুদের জন্য তা একটি অনিরাপদ স্থানে পরিণত হয়। যেসব পরিবারে সব সময় ঝগড়া-ঝাটি ও সহিংসতা লেগেই থাকে সেসব পরিবারের সদস্যরা নানা ধরণের সমস্যায় ভোগেন। প্রত্যেক সদস্যই কোনো না কোনোভাবে এই পরিস্থিতির কারণের ক্ষতির শিকার হন। তবে শিশুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শিশুরা পরিবারের কোনো সদস্যের মধ্যেই সহিংসতা প্রত্যাশা করে না। তাদের কোমল মন-মানসিকতা সহজেই ঝগড়া-বিবাদ সহ্য করতে পারে না। আর এই শিশুরা নিজেরাই যখন সরাসরি সহিংসতার শিকার হয় তখন তা ওদের জন্য হয়ে ওঠে মহাবিপর্যয়।
কিন্তু দুঃখজনকভাবে পাশ্চাত্যের লাইফ স্টাইল অনুসরণকারী দেশগুলোতে শিশুদের বিরুদ্ধে পারিবারিক এমনকি যৌন সহিংসতা ক্রমেই বাড়ছে। এধরণের সহিংসতা পুরো সমাজ ব্যবস্থার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ২০১৮ সালের পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, জার্মানিতে ওই বছর ১৪ হাজারেরও বেশি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এছাড়া পারিবারিক সহিংসতার কারণে শতাধিক শিশু মারা গেছে। এক বছরে সেদেশে শিশুদের উপর নানা ধরণের নির্যাতনের মোট ঘটনা ঘটেছে চার হাজারের বেশি। এর মধ্যে ব্যাপক মারপিট এবং গরম জিনিস দিয়ে শরীরে সেক দেওয়া বা শরীর পুড়িয়ে দেওয়ার মতো ঘটনাও রয়েছে। জার্মানির অপরাধ মোকাবেলা বিষয়ক দপ্তরের প্রধান এই পরিসংখ্যান সম্পর্কে বলেছেন, যেসব ঘটনা ফাঁস হয়েছে অথবা পুলিশকে জানানো হয়েছে কেবল সেগুলোই এই পরিসংখ্যানে এসেছে। কিন্তু আত্মীয়স্বজন এবং পরিচিতজনদের মাধ্যমে শিশুদের উপর যৌন নির্যাতনের এমন অনেক ঘটনা ঘটছে যেগুলো লজ্জার কারণে বা অভ্যন্তরীণ কলহ রোধে চেপে যাচ্ছেন অনেকেই। তারা কোনও অভিযোগও দায়ের করছেন না,"
ব্রিটিশ পত্রিকা দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট লিখেছে, যুক্তরাজ্যের প্রায় আড়াই লাখ শিশু এখন পারিবারিক সহিংসতার শিকার। দাতব্য সংস্থা 'এনএসপিসিসি'র ধারণা, ব্রিটেনের ১৮ বছরের কম বয়সী শিশুদের ১৪ শতাংশই পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও পরিচিতদের মাধ্যমে যৌন নির্যাতনের ঘটনা বেড়ে চলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের যৌন নির্যাতন মোকাবেলা বিষয়ক সংস্থা আরএআইএনএন'র পরিসংখ্যান বলছে, সেদেশে ৭০ শতাংশ ধর্ষণের ঘটনাই ঘটে পরিচিতজনদের মাধ্যমে। এর মধ্যে আবার ৩৫ শতাংশ ঘটনার সাথে পরিবারেরই সরাসরি কোনো সদস্য জড়িত। সহজভাবে বলা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের উপর যৌন নিপীড়নের এক-তৃতীয়াংশ ঘটনার সঙ্গে নিজের পরিবারের সদস্যরাই জড়িত। এখন প্রশ্ন হলো, এসব দেশ যারা নিজেদেরকে মানবাধিকারের পথিকৃৎ হিসেবে গণ্য করে এবং শিশু ও নারীর অধিকার রক্ষার শ্লোগান দেয় সেখানে যৌন অনাচারসহ পারিবারিক সহিংসতার মাত্রা এত বেশি কেন?
১৯৬০'র দশক থেকে ১৯৮০ দশক পর্যন্ত সময়ে পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে অবাধ যৌনাচারের পক্ষে জনমত গড়ে তোলা হয়। এটাকে যৌন বিপ্লব হিসেবেও অভিহিত করা হয়। কথিত এই যৌন বিপ্লবের ফলে পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে চিরাচরিত বিয়ে প্রথায় বড় ধরণের আঘাত আসে। এর ফলে বেড়ে যায় বিবাহ বহির্ভূত যৌনতা, জনসমক্ষে নগ্ন হওয়ার প্রবণতা এবং সমকামিতাসহ নানা ধরণের প্রকৃতি বিরোধী যৌনাচার। একই সঙ্গে বেড়ে যায় জন্মনিয়ন্ত্রণ ট্যাবলেটের ব্যবহার। পাশাপাশি গর্ভপাতকে বৈধতা দেওয়া হয়। ব্যক্তি স্বাধীনতার কথা বলে এসব করা হয়। পাশ্চাত্যে যৌন স্বাধীনতার পরিণতিতে পারিবারিক সহিংসতার পাশাপাশি যৌন সহিংসতা অনেক বেড়েছে, পারিবারিক ব্যবস্থায় ব্যাপক ধস নেমেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৫০'র দশকে এ ধরণের পরিস্থিতি ছিল অকল্পনীয়। মার্কিন সাংবাদিক সাওয়ালিন ব্রাউডারের মতে, ১৯৫০-এর দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মাত্র দুই ধরণের যৌন রোগ ছিল। কিন্তু বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২৪টিরও বেশি যৌনরোগ ছড়িয়ে পড়েছে।
কেবল যৌন সংক্রমণজনিত রোগই নয়, বিকৃত যৌনাচারও বেড়েছে ভয়াবহ গতিতে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে এখন সমকামিতার মতো চরম বিকৃত যৌনাচারকে রাষ্ট্রীয়ভাবে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। ইউনিসেফের মতে, বিশ্বব্যাপী যৌন ব্যবসায় ব্যবহৃত হচ্ছে ২০ লাখের বেশি শিশু। শিশু তথা মানব পাচার এই ব্যবসাকে টিকিয়ে রেখেছে। পাশ্চাত্যের ধাঁচের জীবন ও সমাজ ব্যবস্থা অনুসরণকারী দেশগুলোর পতিতালয়গুলোতে শিশুদের ব্যবহার করা হচ্ছে অবাধে। বিভিন্ন দেশ থেকে নারী ও শিশুদের অপহরণ করে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে এসব স্থানে। চিরদিনের জন্য বন্দী হয়ে পড়ছে এসব অসহায় মানুষ। পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে পতিতাবৃত্তিকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। মানব জাতি বিশেষকরে নারীদের জন্য চরম অবমাননাকর এই ক্ষেত্রটিকে ব্যবসা হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। সর্বোপরি পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় নারীকে ব্যবহার করা হচ্ছে পণ্য হিসেবে। পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে রাস্তার পাশে পতিতালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে খদ্দের সংগ্রহের জন্য নারীদের অঙ্গভঙ্গি থেকে এটা স্পষ্ট নারীদেরকে কতটা নিচে নামিয়ে আনা হয়েছে। নানা ধরণের পণ্যের মতো তারাও বিক্রি হচ্ছে অবলীলায়।
পাশ্চাত্যের দেশগুলো অর্থনৈতিকভাবে অনেক উন্নতি সাধন করলেও এসব নারীকে এ ধরণের অবমাননাকর কাজ থেকে মুক্তি দেওয়ার উদ্যোগ নেয় নি। তারা বলছে, অর্থের প্রয়োজনে এই কাজে নেমেছে ওই সব নারী। কিন্তু এতো অর্থ-বিত্তের দেশগুলো এসব নারীর আর্থিক অভাব মিটিয়ে তাদেরকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করছে না কেন, এটি একটি স্বাভাবিক প্রশ্ন। পাশ্চাত্যের পুরুষেরা তাদের ভোগ ও কামনা চরিতার্থ করতেই স্বাধীনতার নামে নারীদেরকে পতিতাবৃত্তির মতো অবমাননাকর পেশায় বন্দি করে রেখেছে। এসব ঘটনা থেকেও প্রমাণিত হয় পাশ্চাত্য নারী ও পুরুষের সমতার যে শ্লোগান দেয় তার পেছনে লুকিয়ে আছে অসৎ উদ্দেশ্য। গভীরভাবে চিন্তা করলে এটা সবার কাছেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে, পাশ্চাত্যের সমাজ ব্যবস্থায় নারীর সম্মান- মর্যাদাতো বাড়েইনি বরং তাদের প্রকৃত অধিকার ও সম্মান খোয়া গেছে।#
পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ/মো: আবুসাঈদ/ ১৫
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।