ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২১ ১৫:৩০ Asia/Dhaka

গত দুই পর্বের আলোচনায় আমরা শিশু ও কিশোরদের আদর্শ মানুষ ও মুসলমান হিসেবে গড়ে তোলার পূর্ব শর্ত হিসেবে বিয়ের জন্য উপযুক্ত ও ধার্মিক বর-কনে নির্বাচনের গুরুত্ব এবং সন্তানের মা-বাবা হওয়ার ক্ষেত্রে মানসিক প্রস্তুতি ও দৈহিক সম্পর্কের পূর্ব-প্রস্তুতি বা আদব-কায়দা সম্পর্কেও কথা বলেছি

আজ আমরা মায়ের গর্ভ ধারণের সময়ের করণীয় কর্তব্য এবং সন্তানকে মানুষ করার ক্ষেত্রে হালাল রিজিকের গুরুত্ব নিয়ে কথা বলব। 
মায়ের গর্ভ ধারণ সন্তান প্রতিপালনের এক গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়। মহানবীর (সা) বক্তব্য অনুযায়ী মানুষের সৌভাগ্য ও দুর্গতি এ সময়ই নির্দিষ্ট হয়। মহানবী একবার সন্তানের সুশিক্ষা ও প্রশিক্ষণের বিষয়ে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেছিলেন, সন্তানকে মায়ের গর্ভেই সুশিক্ষিত কর। -সাহাবিরা বিস্মিত হয়ে এর মর্মার্থ জানতে চাইলে মহানবী (সা) বলেন, মাকে পবিত্র ও হালাল খাবার খাইয়ে তা কর। 
ইসলাম ধর্ম দারিদ্র দূর করতে কাজ করার ওপর গুরুত্ব দেয়ার পাশাপাশি রিজিক যেন হালাল হয় সে ব্যাপারেও ব্যাপক গুরুত্ব দিয়েছে। মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে সুরা বাকারার ১৬৮ নম্বর আয়াতে বলেছেন, হে মানুষেরা! পৃথিবীর হালাল ও পবিত্র বস্তু-সামগ্রী খাও। আর শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। সে নিঃসন্দেহে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু । 
-এটা ঠিক যে মহান আল্লাহ সব সৃষ্টির জন্য রিজিকদাতা। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে কাজ না করে বসে থাকতে হবে। সুরা হুদের ৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, 
ভূপৃষ্ঠে বিচরণকারী এমন কোন জীব নেই যার জীবিকার দায়িত্ব আল্লাহ নেননি এবং তিনি তাদের স্থায়ী আবাসস্থল ও অস্থায়ী আবাস সম্বন্ধেও অবহিত। সবকিছুই সুস্পষ্ট গ্রন্থে (সংরক্ষিত) রয়েছে।
-মানুষ যখন হালাল রিজিকের জন্য কাজ করে তখন সে দেহ ও আত্মায় প্রশান্তি অনুভব করে। সে তখন অন্যের বোঝা হয়ে থাকে না। হালাল রিজিক অর্জনের জন্য একনিষ্ঠতা ও অবিচলতা রিজিক বাড়িয়ে দেয় এবং এর ফলে পরিবার ও সমাজে নৈতিকতার বিস্তারের পাশাপাশি পারস্পরিক সম্প্রীতিও বৃদ্ধি পায়। 
ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তথা সন্তানকে যদি সৎকর্মশীল ও পবিত্র রাখতে হয় তাহলে প্রথম শর্তই হল  তাকে হালাল রিজিক থেকে হালাল খাবার খাওয়াতে হবে। হারাম খাদ্য খেয়ে বড় হয়ে ওঠা সন্তানরাও পাপী হবে বা পাপের দিকে ঝুঁকবে -এটাই স্বাভাবিক। হারাম খাদ্য সন্তানের ব্যক্তিত্বের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এমনকি এসব অপবিত্র ও নিকৃষ্ট খাদ্য সন্তানের ভবিষ্যৎ বংশধরের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব রাখবে। তাই ভবিষ্যৎ পবিত্র প্রজন্ম অর্জনের জন্য বাবা-মা হওয়ার অনেক আগেই ও শিশুকে মাতৃস্তন্য পান করানোর অনেক আগেই তার প্রশিক্ষণের প্রক্রিয়া শুরু করতে হয়। পবিত্র সন্তানের প্রত্যাশীকে যথাসম্ভব সব ধরনের গোনাহ বা পাপ বর্জন করতে হবে এবং এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পন্থা হল সব ধরনের হারাম খাদ্য ও এমনকি সন্দেহজনক খাদ্য খাওয়া থেকেও দূরে থাকা। 

মাতৃগর্ভে সন্তানের প্রাথমিক অস্তিত্ব লাভ বা জীবনের সূচনা বীর্য স্থাপনের পর থেকেই ঘটে থাকে। এ সময়ে বাবা-মাকে ইবাদাত-বন্দেগি ও নৈতিক দিক থেকে দায়িত্বশীল হওয়ার ক্ষেত্রে খুব সচেতন হতে হবে। মাতৃগর্ভে শিশুর বয়স যখন চার মাস তখন তার মধ্যে রুহ ও আত্মা চলে আসে। তাই সে তার আশপাশের পরিবেশে প্রভাবিত হয়। এ সময়ে মায়ের চলাফেরা, আচার-আচরণ, খাদ্য গ্রহণ, পোশাক-পরিচ্ছদ, তার প্রতিটি কাজ বা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, মানসিক অবস্থা, দর্শন ও শরবন -এসবই গর্ভস্থ শিশুর প্রশিক্ষণে ভূমিকা রাখে। কোনও শিশু নিজ থেকে নিজের জন্য বা বাবা-মায়ের জন্য দুর্ভাগ্য নিয়ে আসে -এমন ধারণা ভুল। বরং মানুষের ভবিষ্যৎ, সুখ ও দুঃখ বা দুর্ভাগ্যের জন্য মানুষ নিজেই দায়ী। বীজকে যেমন অযত্নের মধ্যে ফেলে রাখলে বা পাপময় পরিবেশের শিকার করলে তা তার জন্য যেভাবে নেতিবাচক ভবিষ্যৎ নিয়ে আসবে শিশুর ব্যাপারটিও ঠিক তেমন। সন্তানকে পবিত্র পরিবেশে রাখলে তার পরিণতি মন্দ হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই। 
সুখে ও দুঃখে সব সময় সৎ থাকা এবং হালাল রুজির পথ থেকে বিচ্যুত না হওয়া সুসন্তান লাভ ও সন্তানকে সৎ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। হাদিসমতে খারাম আয়ের প্রভাব সন্তানের ওপর পড়াটা অনিবার্য এবং তা সুস্পষ্ট।  মানুষের মধ্যে যে শয়তানের সেনাবাহিনী গড়ে ওঠে তা হারাম খাদ্য থেকে গড়ে ওঠা বা জন্ম নেয়া মানুষের মাধ্যমেই গড়ে ওঠে। এ ধরনের মানুষ বা সন্তান ভালো ও মন্দের পার্থক্য করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে এবং হারিয়ে ফেলে বিচক্ষণতা, দূরদর্শিতা ও খোদাভীতি অর্জনের যোগ্যতা। 
আধুনিক বিজ্ঞানের গবেষণায়ও দেখা গেছে মানুষের খাদ্যের নানা উপাদান তার আচরণ ও বংশগতির স্মারক বা জিনের ওপর প্রভাব ফেলে। মানুষের খাবারের উপাদানগুলো যদি পবিত্র ও হালাল পন্থা থেকে আসে তাহলে তা দৈহিক ও আত্মিক এবং মানসিক সুস্থতা বাড়িয়ে দেয়। হালাল ও সুষম খাদ্য গ্রহণ মানুষের সততা ও সৎগুণগুলোর বিকাশে সহায়ক হয়। ফলে অপরাধ ও পাপের দিকে তাদের ঝুঁকে পড়ার সম্ভাবনা কমে যায়। 
কেউ যদি সন্তান ও স্ত্রীর জন্য নানা ধরনের মজাদার এবং বিচিত্রময় খাবার সংগ্রহ করতে গিয়ে হারাম উপায়ে অর্থ উপার্জন করে তাহলে তা নিজের জন্য, স্ত্রীর জন্য, সন্তানের জন্য ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অনেক অকল্যাণের উৎসে পরিণত হল। এই পরিবারের সন্তান ভালো মুসলমান হিসেবে গড়ে উঠবে না-এটাই স্বাভাবিক। অন্যদিকে যে ব্যক্তি সৎ থাকার কারণে নানা ধরনের সুস্বাদু খাদ্য পরিবারের জন্য সংগ্রহ করতে পারল না সে ঘরের অল্প এবং খুব সাদামাটা খাবারের মধ্যেই এমন বরকত থাকবে যে সেই ঘর হয়ে উঠবে ভালো মুসলমান সন্তান গড়ে তোলার কেন্দ্র। এমন ঘরের সন্তান নানা ধরনের সুন্দর গুণ ও উন্নত নৈতিক চরিত্রের অধিকারী হবে। পবিত্র ইমামদের বর্ণনা থেকে জানা যায় মা শিশুকে গর্ভ ধারণের সময় ও বুকের দুধ পান করানোর সময় যেসব খাবার খেয়েছেন সেসবই সন্তানের শরীর ছাড়াও তাদের মন-মানসিকতা এবং স্বভাব ও চরিত্রের ওপরও নানা ধরনের প্রভাব ফেলে।
পাপাচার এবং নাপাক ও হারাম খাদ্য গ্রহণ মানুষের অন্তরকে অন্ধকার করে দেয়। তখন ভালো কোনো উপদেশে তার মন গলে না। হযরত ইমাম হুসাইন (আ) আশুরার দিন ইয়াজিদের অনুগত এবং ওমর সাদের নেতৃত্বাধীন বাহিনীকে অনেক অকাট্য যৌক্তিক ও সুন্দর উপদেশ দেয়া সত্ত্বেও তা তাদের মধ্যে প্রভাব ফেলেনি। তাই ইমাম হুসাইন (আ) বলেছিলেন, তাদের অস্তিত্বের মধ্যে হারাম মিশে যাওয়ায় তারা সত্য কথা শুনতেও চাইছে না ও বুঝতেও পারছে না। 
তাই পরিবারের আয়-উপার্জনকারীকে আয়ের পন্থা ও উৎস এবং হারাম খাদ্য সম্পর্কে খুবই সতর্ক থাকতে হবে। তাই ইসলামী শিক্ষায় এ বিষয়ে যত্নশীল ও সতর্ক থাকতে ব্যাপক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।#

পার্সটুডে/এমএএইচ/আবুসাঈদ/২১

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ