সন্তান গ্রহণের বা ধারণের প্রাথমিক পর্যায় থেকেই বাবা-মাকে হতে হবে খুব সতর্ক
আদর্শ মানুষ গড়ার কৌশল (পর্ব-৪)
গত কয়েকটি পর্বে আমরা শিশু ও কিশোরদের আদর্শ মানুষ ও মুসলমান হিসেবে গড়ার শিক্ষা বা কৌশল প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে আদর্শ মানুষ গড়ার পূর্ব শর্ত হিসেবে বিয়ের জন্য উপযুক্ত ও ধার্মিক বর-কনে নির্বাচনের গুরুত্ব, সন্তান গ্রহণের পূর্ব-প্রস্তুতি বা আদব-কায়দা সম্পর্কেও কথা বলেছি।
এ ছাড়াও মায়ের গর্ভ ধারণের সময়ের করণীয় কর্তব্য এবং সন্তানকে মানুষ করার ক্ষেত্রে হালাল রিজিকের গুরুত্ব নিয়ে কথা বলেছি গত পর্বে। আজ আমরা গর্ভবতী মায়ের যত্ন ও খাদ্য বিষয়ে কিছু কথা বলব।
গর্ভবতী মায়ের দৈহিক অবস্থা ও খাবারের ধরন তার গর্ভস্থ শিশুর ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। তাই গর্ভবতী মায়ের সুস্বাস্থ্য, যথাযোগ্য খাবার ও দৈহিক অবস্থার দিকে লক্ষ্য রাখা বেশ জরুরি। প্রত্যেক পরিবারই সুস্থ শিশু কামনা করে। কিন্তু সুস্থ শিশু পেতে হলে মা-বাবাকেও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হতে হবে এবং এ সংক্রান্ত বিধি-বিধানগুলো মেনে চলতে হবে। এক্ষেত্রে গর্ভবতী মায়ের জন্য যথাযোগ্য নানা খাবারের যোগান দেয়ার গুরুত্ব অপরিসীম।
মাতৃগর্ভের শিশু হচ্ছে একজন মুসাফির বা যাত্রীর মত। যার যাত্রা শুরু হয়েছিল বীর্য থাকা অবস্থায়। এরপর তাকে চূড়ান্ত গন্তব্যে পৌঁছতে নয় মাস সফর করতে হয়। তার এই সফরে রয়েছে প্রতি মুহূর্তে অনেক বিপদের আশঙ্কা। যেমন, অযত্নের কারণে অঙ্গহানির আশঙ্কা, আঘাত পেয়ে নিহত বা আহত হওয়ার আশঙ্কা। সুস্থভাবে মাতৃগর্ভের বাইরে আসার আগ পর্যন্ত তথা জন্মগ্রহণের আগ পর্যন্ত শিশু যেন মায়ের শরীরেরই অংশ। তা যা যা মায়ের শরীর ও মনের জন্য উত্তম তা গর্ভস্থ শিশুর জন্যও উত্তম। আর এ জন্যই ইসলাম সুস্থ, সুন্দর ও পরিপূর্ণ শিশুর জন্মগ্রহণ সহজ করতে গর্ভবতী মাকে উপযুক্ত খাদ্য সামগ্রী দেয়ার ওপর ব্যাপক জোর দিয়েছে।
বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে শিশুদের নানা রোগ ও ত্রুটির কারণ বা মূল উৎস হল গর্ভকালীন সময়ে মায়ের অপুষ্টি বা যথাযোগ্য খাদ্যের অভাব। আর যেসব মা গর্ভকালীন সময়ে পুষ্টিদায়ক ও যথাযোগ্য খাবার খেয়েছেন তাদের সন্তান বেশি বুদ্ধিমত্তার অধিকারী হয়েছে এবং সহজেই তারা শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে অগ্রগতি অর্জন করেছে। গর্ভস্থ ভ্রূণ ও শিশুরা মায়ের কাছ থেকেই খাদ্য গ্রহণ করে ও তাদের বিকাশের সব উপকরণই মায়ের কাছ থেকে পেয়ে থাকে।
মায়ের খাদ্য গ্রহণের বিষয়টি ছাড়াও তার আচার-আচরণ এবং মানসিকতা গর্ভস্থ শিশুর ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। শিশুর চোখ ও চুলের রং, সৌন্দর্য ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ভারসাম্য- এসবই মায়ের খাদ্য গ্রহণের ধারার প্রভাবের ছাপ বহন করে। যেসব নারী প্রথমবারের মত সন্তানের অধিকারী হতে যাচ্ছেন তাদের খাদ্য-গ্রহণসহ নানা তৎপরতার ব্যাপারে পরিকল্পনা থাকা উচিত। কারণ যে কোনো ধরনের অপূর্ণতার প্রতিরোধের পদক্ষেপ নেয়া এ ধরনের সমস্যা দেখা দেয়ার পর চিকিৎসা করার চেয়ে সহজ। ইসলাম এ বিষয়টির ওপর খুব গুরুত্ব দিয়েছে।
মাতৃগর্ভে শিশুর ভ্রূণ তৃতীয় সপ্তা'র পর থেকে খুব স্পর্শকাতর পর্যায়ে পৌঁছে। তার প্রথম তিন মাস বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এ সময় শিশু-ভ্রূণের নানা অঙ্গ গড়ে উঠতে থাকে। তাই এ সময় খাদ্য সম্পর্কিত করণীয় ও বর্জনীয় বিষয়গুলোর ব্যাপারে গর্ভবতীকে বিশেষভাবে সচেতন থাকতে হবে। ইসলামী ও ঐতিহ্যবাহী ইরানি চিকিৎসা বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ডক্টর হুসাইন আকবারির মতে গর্ভ সঞ্চারের পর প্রথম মাসে সকাল বেলায় একটু মিষ্টি আপেল খেতে হবে গর্ভবতীকে। শুক্রবারগুলোতে নাস্তার আগে ডালিম ও প্রতিদিন খালি পেটে দু'টি খেজুর খেতে হবে। দ্বিতীয় মাসের প্রতি সপ্তায় ভেড়ার গোশত খেতে হবে এবং এই গোশতের সঙ্গে স্বল্প পরিমাণে গাভীর খাঁটি দুধ, মিষ্টি আপেল মিশিয়ে রাখতে হবে। অথবা প্রতিদিন সকালে খালিপেটে আন্নাব নামক ফল খেতে হবে দু'টি করে। তৃতীয় মাসের প্রত্যেক সালে টেবিল চামচের এক চামচ মধু ও খালি পেটে একটি আপেল খেতে হবে। এ ছাড়াও প্রতিদিন একটি করে কান্দুর খেতে হবে.... ।
চতুর্থ মাসের প্রতিদিন গর্ভবতীকে মিষ্টি আপেল ও ডালিম এবং সকালে খালি পেটে দুটি ডুমুর খেতে হবে। পঞ্চম মাসে প্রতিদিন সকালে কয়েকটি খেজুর খেতে হবে এবং ষষ্ঠ মাসে সকালের নাস্তার পর ডুমুর ও জয়তুন খেতে হবে গর্ভবতীকে। এই মাসে গর্ভবতী যেন দুন্বা নামে খ্যাত ভেড়ার লেজ-সংলগ্ন এক ধরনের চর্বি জাতীয় অংশকে না খায়। এই মাসে গর্ভবতীর উচিত প্রতিদিন সকালে খালিপেটে একটি ডালিম খাওয়া।
সপ্তম মাসে গর্ভবতীর উচিত সকালে বাদাম খাওয়া এবং তা চল্লিশ দিন অব্যাহত রাখা উচিত। যদি গরমকাল হয়ে থাকে সে সময় প্রত্যেক বেলার খাবারের পর ফুটি বা বাঙ্গি জাতীয় ফল বিশেষ করে খারবুজা বা পার্শিয়ান মেলোন খাওয়া উচিত। এ ধরনের ফল খাওয়ার আগে ও পরে পানি পান করা যাবে না। এ ছাড়াও এ সময় প্রতিদিন একটি করে ফল সকালে খালি পেটে খেতে হবে।
অষ্টম মাসে গর্ভবতীকে মিষ্টি দই, মধু ও প্রত্যেক শুক্রবারে মিষ্টি ডালিম খেতে পরামর্শ দেয়া হয়। নবম তথা শেষ মাসে গর্ভবতীর জন্য সবচেয়ে ভালো খাবার হল ভেড়ার কাবাব। তবে মশলা পরিহার করতে হবে। এ ছাড়াও খেতে হবে খেজুর অথবা প্রতি দিন কিছুটা দুধ ও খেজুর সকাল খালি পেটে খেতে হবে। এসবই খেতে বলা হয় যাতে সন্তান সুস্থ দেহ ও মন নিয়ে জন্ম নিতে পারে।
গর্ভবতীর জন্য খেজুর খাওয়া খুবই ভালো। কারণ খেজুরের মধ্যে রয়েছে ভিটামিন এ, বি ও সি ব্যাপক মাত্রায় এবং খেজুরের প্রকৃতি হল গরম। এ ছাড়াও খেজুরে রয়েছে আয়রন, সোডিয়াম, ফসফরাস ও ক্যালসিয়াম। খেজুরকে বলা হয় পরিপূর্ণ শক্তিদায়ক, প্রশান্তিদায়ক ও হৃদযন্ত্রকে সতেজকারী। মহানবী (সা) বলেছেন, তোমরা গর্ভবতীকে সন্তান প্রসবের সময় ঘনিয়ে আসার প্রাক্কালে খুরমা তথা খেজুর খেতে দাও যাতে তার সন্তান হয় ধৈর্যশীল ও সহিষ্ণু। হযরত মারিয়াম (সা. আ) ঈসা নবীকে জন্ম দেয়ার পর খেজুর খেয়েছিলেন। আর খেজুরের চেয়েও ভালো কোনো ফল থাকলে মহান আল্লাহ নিশ্চয়ই তা বিবি মারিয়ামের কাছে পাঠাতেন।
গবেষণায় দেখা গেছে ফল খেতে দেয়ার কারণে মায়েরা বিশেষ শক্তি ও সজীবতা পেয়ে থাকেন এবং এ কারণে শিশুর চেহারা ও গড়ন যেমন সুন্দর হয় তেমনি তার আচার-আচরণ ও স্বভাবও সুন্দর হয়। হাদিসে গর্ভাবস্থায় কান্দুর তথা বিশেষ গাছের গাম বা জমাট-বাধা আঠা খাওয়ার ওপর, বেহ ফল বা কুয়িন্সি ফল, নাশপাতি এবং খারবুজা বা পার্সিয়ান মেলোন খাওয়ার ওপরও বেশ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। #
পার্সটুডে/এমএএইচ/আবুসাঈদ/২৩
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।