শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ: ড. সিদ্দিকুর রহমান
মহামারি করোনার সময়ে বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা, সরকারের সিদ্ধান্ত এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশার প্রসঙ্গ নিয়ে আমাদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন বিশিষ্ট গবেষক, কলামিস্ট, সাংবাদিক ও লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদ। সম্প্রতি তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। এছাড়া আমাদের সঙ্গে এ বিষয়ক সাক্ষাৎকারে অতিথি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মাদ সিদ্দুকুর রহমান।
সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।
সৈয়দ আবুল মকসুদ ছিলেন প্রথিতযশা সাংবাদিক, লেখক ও গবেষক। তিনি রেডিও তেহরানের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে কথা বলেছেন, সরকার, দেশ জাতিকে নির্দেশনামূলক পরামর্শ দিয়েছেন। করোনাকালে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা নিয়ে তিনি রেডিও তেহরানের সাথে সবশেষ কথা বলেছিলেন গত অক্টোবর মাসের ২ তারিখে। তাঁর স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে সেই সাক্ষাৎকারের অংশ বিশেষ এখানে তুলে ধরা হলো।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার ফলে শিক্ষার্থীদের জীবনে কোনো ভালো ফল বয়ে আনবে না-আবুল মকসুদ
রেডিও তেহরান: জনাব সৈয়দ আবুল মকসুদ, বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ভয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হচ্ছে না,শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছুটির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। তবে বলা চলে গণপরিবহনসহ অন্য সব কিছু খোলা রয়েছে। কীভাবে দেখছেন বিষয়টিকে?

সৈয়দ আবুল মকসুদ: দেখুন, বলা চলে প্রায় মাস তিনেক পর আজই রাস্তায় বেরিয়েছিলাম। দেখলাম যে গণপরিবহন একেবারেই স্বাভাবিক এবং শুধু ঢাকায় না ঢাকার বাইরেও একই অবস্থা। শুধু তাই নয় জায়গায় জায়গায় যানজটও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সুতরাং বলতে গেলে মানুষের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক।
শুধুমাত্র স্কুল-কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় অর্থাৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রয়েছে। এই যে দুই শিক্ষা মন্ত্রণালয় যে সিদ্ধান্তগুলো নিচ্ছে তা যথেষ্ট গবেষণালব্ধ সিদ্ধান্ত নয়। আমরা নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে বলেছি কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের পরামর্শ নিয়ে এবং অতীতে যারা শিক্ষামন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন তাঁদের অনেকে শিক্ষাবিদ নন কিন্তু ধরুন-সচিব ছিলেন অথবা যুগ্ম সচিব ছিলেন অর্থাৎ যারা অভিজ্ঞ তাদের পরামর্শ নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে। তবে সেই কাজটি তারা না করে শিক্ষামন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী অথবা তাদের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তারা নিজেরাই মাঝে মাঝে সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন।
আমি বলব শিক্ষা-ক্ষেত্রে এই যে অবস্থাপনা হচ্ছে তার ফলে শিক্ষার্থীদের জীবনে এর পরিণতি কি হতে পারে সে বিষয়টি নিয়ে আমার শিক্ষামন্ত্রণালয় কোনো রকমের গবেষণা করেছে বলে মনে হয় না। যার ফলে একেক সময় একেক নির্দেশ জারি করছে। এই একটি বছর শিক্ষার্থীদের জীবনে যে অভিঘাত সৃষ্টি করল এবং ভবিষ্যতে কি বিরুপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে সে বিষয়ে যথেষ্ট গবেষণা না করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় নির্দেশ দিচ্ছে। এরফলে আমার মনে হয় না যে তা শিক্ষার্থীদের জীবনে কোনো ভালো ফল বয়ে আনবে না।
জনাব সৈয়দ আবুল মকসুদ আমাদেরকে সময় দেয়ার জন্য আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: আপনাকেও ধন্যবাদ।
মহামারি করোনার বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা নিয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশার প্রসঙ্গ নিয়ে আমাদের সঙ্গে আজ কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মাদ সিদ্দুকুর রহমান।
রেডিও তেহরান: অধ্যাপক সিদ্দুকুর রহমান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ-অন্যসবকিছু খোলা-সরকারের এই সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা কি?
ড.সিদ্দিকুর রহমান: দেখুন, আপনি লক্ষ্য করে থাকবেন গত মাসের ১৯ তারিখ জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের একটি আন্দোলন হয়েছিল। সেখানে ছাত্রদের সাথে স্থানীয়দের একটি সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে ছাত্র আন্দোলনটি হয়েছিল। স্থানীয়দের সাথে ছাত্রদের সংঘর্ষের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যখন ছাত্রদের দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করল তখন তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি-নিষেধ উপেক্ষা করে আবাসিক হলগুলোতে অবস্থান নিয়েছিল। এর জের হিসেবে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা একই পদ্ধতিতে আন্দোলন শুরু করেছিল। আমার ধারনা সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার তারিখ ঘোষণার মধ্য দিয়ে ছাত্রদের কাছে একটি বার্তা পৌঁছে দিয়েছে যে আমরা এই সময়ের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় খুলব। এর আগে কোনোরকমের খোলার সম্ভাবনা নেই বা খোলা হবে না। সর্বশেষ সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা এসেছে ৩০ মার্চ স্কুল কলেজ খোলা হবে।

তো আমি সরকারের প্রথমে দেয়া ঘোষণাকে মনে করি ব্যবস্থাপনার একটি বড় রকেমর ক্রটি এখানে তৈরি হয়েছে। আর সেই ক্রটির কারণেই সরকারের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্তৃপক্ষের একটা সমন্বয়হীনতার একটা আলামত আমরা লক্ষ্য করছি।
স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিজস্ব অ্যারেঞ্জমেন্টকেও সরকারের পক্ষ থেকে গুরুত্ব দেয়া উচিত ছিল। সবকিছু মিলিয়ে আমরা এটা মনে করি সরকার আকর্ষিকভাবে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেটি ছাত্রবান্ধব বা শিক্ষাবান্ধব সিদ্ধান্ত হয়নি।
রেডিও তেহরান: জনাব অধ্যাপক সিদ্দুকুর রহমান, সরকারের ঘোষণা নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশা ছড়িয়ে পড়েছে বলে দৈনিক মানবজমিন পত্রিকায় একটি খবর প্রকাশিত হয়েছে। আপনার দৃষ্টিতে এই বিষয়টি কী হতাশাজনক?
ড. সিদ্দিকুর রহমান: করোনা মহামারিতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ২০২০ সালের মার্চ মাসের আঠার তারিখ থেকে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। এরইমধ্যে আপনারা জানেন যে বাংলাদেশে করোনার টিকা দেয়া শুরু হয়েছে। আমাদের জীবনযাত্রার অন্য সব ক্ষেত্র স্বাভাবিকভাবে চলছে। কেবলমাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই একবছর হয়ে গেল বন্ধ থাকার পরও খোলা হয়নি। যদিও কোথাও কোথাও অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু দেশের সিংহভাগ শিক্ষার্থী পড়াশুনা করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আর সেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখনও খুলে দেয়া সম্ভব হয় নি।
শিক্ষার্থীরা বছরের শুরুতেই বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেয়ার দাবি করেছিল। আমরাও আশা করেছিলাম যে টিকা দেয়া শুরুর পর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেয়া হবে। যেহেতু করোনার প্রকোপ কমে গেছে। সে অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় মার্চ মাসের ১৩ তারিখ থেকে হল খুলে দিয়ে- ২ সপ্তাহর মধ্যে শিক্ষা কার্যক্রম এবং পরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু আমরা দেখলাম শিক্ষামন্ত্রণালয়ের নতুন সিদ্ধান্ত এল বিশ্ববিদ্যাদলগুলোর ১৭ মে খোলা হবে। তার এক সপ্তাহ পর শিক্ষার স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু করা হবে। এতে স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষার্থীর মধ্যে হতাশা তৈরি হয়েছে। শিক্ষার্থীরা শুধুমাত্র তাদের একাডেমিক কার্যক্রমের জন্যই শুধু যে অসুবিধার সন্মুখীন হয়েছে তা নয়; আরও নানামুখী সমস্যায় পড়েছে তারা। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যারা পড়াশুনা করেন তাদের বেশিরভাগই হচ্ছে নিম্ন মধ্যিবিত্ত পরিবারের সন্তান। তারা হলে থেকে পড়াশুনার পাশাপাশি পার্টাইম জব করেন, কেউ বা টিউশনি করে পড়াশুনার খরচ চালান।
তো দীর্ঘদিন ধরে হলগুলো বন্ধ থাকায় সেই সব শিক্ষার্থীরা অসুবিধার মধ্যে পড়েছে। অনেকের টিউশনি চলে গেছে। গ্রামে গিয়ে দীর্ঘদিন বসে থাকার ফলে তাদের মধ্যে একটা হতাশার জন্ম নিয়েছে। যে কারণেই আমি বলব ছাত্রদের মধ্যে একটা উদ্বেগ উৎকণ্ঠা এবং সরকারের এই সিদ্ধান্ত তাদের মধ্যে হতাশা বাড়িয়ে দিয়েছে। আমি একজন শিক্ষক হিসেবে মনে করি- আমাদের দেশের কলকারখানা, হাট বাজারসহ জীবনের সর্বস্তরে স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু শিক্ষাক্ষেত্রে অনুকূল পরিবেশের মধ্য দিয়ে শিক্ষাকার্যক্রম স্বাভাবিকভাবে পরিচালনা করতে পারছি না এটা মনে হয় আমাদের একটা বড় সীমাবদ্ধতা। আরও তিন মাসের মতো যে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে সেটি শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশা শুধু নয় হতাশার সাথে সাথে তারা ক্ষোভও প্রকাশ করেছেন।
রেডিও তেহরান: জনাব অধ্যাপক সিদ্দুকুর রহমান আমরা সাক্ষাৎকারের শেষ দিকে চলে এসেছি। তো বাংলাদেশে যখন করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন দেয়া হচ্ছে তখন নতুন করে আরেক ধরনের করোনাভাইরাস এসেছে। যা নিয়ে উদ্বেগ সৃস্টি হয়েছে। চিকিৎসরা বলছেন, শিক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের ক্ষতি হচ্ছে। তবে হুট করে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া ঠিক হবে না। তাহলে চরম মূল্য দিতে হবে। এর দায়ভার কে নেবে?
ড.সিদ্দিকুর রহমান: দেখুন, জনস্বাস্থ্যবিদরা যেকথা বলছেন সেটিকে আমরা গুরুত্বের সাথেই নিতে চাই। কিন্তু দেখুন, জীবনের সর্বক্ষেত্রে- আমার যে শিক্ষার্থীটি ক্লাসে আসছে না সে কিন্তু সমাজের জীবনের বাস্তবতায় অংশ নিচ্ছে। সে রাজনৈতিক কর্মকান্ডে অংশ নিচ্ছে। সে মিছিল মিটিং করছে, সে মার্কেটে যাচ্ছে, গণপরিবহন ব্যবহার করছে। সেখানে স্বাস্থ্য বিধি মানার ন্যুনতম কিছু লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
সেক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কথা যদি আমরা বলি এখানে সবাই ম্যাচিউরড স্টুডেন্ট ফলে তাদেরকে নির্দেশনা দেয়া হলে তারা যে সচেতন হবে না সেটা আমি মনে করি না। হয়তো প্রাথমিক বা মাধ্যমিক শিক্ষাক্ষেত্রে আরও কিছু সময় অপেক্ষা করা যেতে পারে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এখন নতুন একটা পরিবেশ ছিল যে পরিবেশে খোলা যেত। আর হলগুলোতে প্রায় দেড় লক্ষ থেকে দুই লক্ষ শিক্ষার্থী থাকে। তাদেরকে টিকাদান প্রক্রিয়ার আওতায় এনে দ্রুততার সাথে যদি হলগুলো মার্চ মাসের মধ্যেই খুলে দেয়া হতো এবং শিক্ষার্থীরা স্বাভাবিকভাবে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে পারত সেটি শিক্ষা ব্যবস্থা এবং শিক্ষার্থী উভয়ের জন্য উপকারই হতো। সবকিছু মিলিয়ে আমরা মনে করি জীবন তো আগে তবে শুধুমাত্র শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে অজুহাত দেখিয়ে বাকি সব ক্ষেত্রে উন্মুক্ত করে দেই তাহলে আমাদের সদিচ্ছার ব্যাপারে মানুষের মনে প্রশ্ন থাকতেই পারে আর সেটিই এখন মানুষের মনের মধ্যে বিরাজ করছে।
রেডিও তেহরান: তো করোনাকালে বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা, সরকারের সিদ্ধান্ত এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশা নিয়ে রেডিও তেহরানের সাথে কথা বলার জন্য আপনাদেরকে আবারও অশেষ ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
ড. সিদ্দুর রহমান: আপনাকে এবং রেডিও তেহরানের সব শ্রোতাকে শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ। #
পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/১২
- বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।