মার্চ ১৩, ২০২১ ১৭:৩০ Asia/Dhaka

গত কয়েকটি পর্বে আমরা শিশু ও কিশোরদের আদর্শ মানুষ ও মুসলমান হিসেবে গড়ার শিক্ষা বা কৌশল প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে আদর্শ মানুষ গড়ার পূর্ব-শর্ত হিসেবে বিয়ের জন্য উপযুক্ত ও ধার্মিক বর-কনে নির্বাচনের গুরুত্ব ও সন্তান গ্রহণের পূর্ব-প্রস্তুতি সম্পর্কেও কথা বলেছি।

এ ছাড়াও মায়ের গর্ভ ধারণের সময়ের করণীয় কর্তব্য এবং সন্তানকে মানুষ করার ক্ষেত্রে হালাল রিজিকের গুরুত্ব ও  গর্ভবতী মায়ের যত্ন ও খাদ্য সম্পর্কে কথা বলেছি। গত পর্বে আমরা সুসন্তান গড়ে তোলার ক্ষেত্রে উত্তরাধিকারগত বৈশিষ্ট্য এবং স্বাধীন ইচ্ছা ও যথাযথ শিক্ষা বা প্রশিক্ষণের গুরুত্ব প্রসঙ্গে কথা বলেছি। আজ আমরা সন্তান মায়ের পেট থেকে ভূমিষ্ট হওয়ার পর করণীয় সম্পর্কে কথা বলব।

নয় মাস মায়ের গর্ভে থাকার পর নবজাতক যখন প্রথমবার দুনিয়ার মুখ দেখে তখন তার ফুসফুসে বাতাস প্রবেশ করে ও ফুসফুসে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস নেয়া শুরু হয় এবং  নবজাতক প্রথমবারের মত কেঁদে ওঠে। এভাবে সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশে শিশুর শুরু হয় নতুন জীবন। ইসলাম ধর্মে গর্ভধারণ ও সন্তান প্রসবকে খোদায়ি মহা-অনুগ্রহ হিসেবে দেখা হয়। সৃষ্টি জগতে নারী মানব প্রজন্ম অব্যাহত রাখার মাধ্যম হিসেবে সম্মানিত। নারীকেই মহান আল্লাহ এই যোগ্যতা দিয়েছেন। আর এদিক থেকে নারীর রয়েছে বিশ্ব জগতে এক অনন্য আলোকোজ্জ্বল অবস্থান। একদিন মহানবী (সা) জিহাদের গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করছিলেন। একজন নারী বললেন: হে আল্লাহর রাসুল (সা) ! নারীরা কি জিহাদের গৌরব থেকে বঞ্চিত? মহানবী (সা) বললেন: না, নারীও জিহাদের সাওয়াব পেতে পারেন। নারী যখন থেকে গর্ভবতী হন ও সন্তান জন্ম দেন ও যতদিন বাচ্চাকে নির্দিষ্ট নিয়মমাফিক স্তন্যের দুধ পান করান ততদিন তা পুরুষের মতই জিহাদের সমতুল্য। এ সময় যদি নারী মারা যান তাহলে তিনি আল্লাহর পথে শহীদ হওয়ার মর্যাদা পাবেন।

সন্তান দুনিয়াতে আসার পর এমন কিছু কাজ করতে হয় যা সন্তানের জীবন সংরক্ষণ ও শিক্ষার কাজে লাগে। এইসব কাজের অন্যতম হল সন্তানের কানে আযান ও একামত দেয়া। একামত প্রায় আযানেরই অনুরূপ। ইসলাম ধর্মে এ বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মহানবী (সা) ও পবিত্র আহলে বাইত সন্তান জন্ম নেয়ার পর প্রথমেই যে কাজটি করতেন তা হল নবজাতকের ডান কানে আযান ও বাম কানে একামত দেয়া। 

ইমাম সাজ্জাদ (আ) বা জাইনুল আবেদিন থেকে বর্ণিত হয়েছে যে যখন ইমাম হুসাইন (আ) জন্ম নেন তখন মহানবী (সা) তাঁর কানে আযান দেন। কোনো কোনো বর্ণনায় নবজাতকের কানে আযান ও একামত দেয়ার আত্মিক এবং প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত প্রভাব ও গুরুত্ব সম্পর্কে বক্তব্য এসেছে। যেমন, বলা হয় যে নবজাতকের কানে আযান ও একামত দেয়া হলে তা তার আত্মাকে প্রশান্ত করে। আযান ও একামতে রয়েছে মহান আল্লাহর একত্ববাদের ও মহানবী (সা)'র রিসালাতের সাক্ষ্য। ফলে বিষয়টি শিশুর ভবিষ্যত শিক্ষায়ও ভূমিকা রাখে। এভাবে জীবনের উষালগ্নেই ধর্মীয় ও বিশ্বাসগত বিষয়গুলোর সংস্পর্শে থাকার কারণে এবং তা বার বার কানে বাজতে থাকায় ভবিষ্যতেও সন্তান এসব বিষয়ের আরও বেশি অনুরাগী হয়। 

নবজাতক যখন জন্ম নেয় তখন তার বাবা ও মাকে অভিনন্দন জানানোও একটি মহান ইসলামী রীতি। মহানবীর আহলে বাইতের প্রথায় এই রীতি দেখা গেছে। এক ব্যক্তি ইমাম সাদিক্ব (আ)কে জানান যে তিনি এক পুত্র সন্তানের জনক হয়েছেন। তখন ইমাম অভিনন্দন জানিয়ে ও দোয়া করে বললেন, মহান আল্লাহ তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা বা প্রশংসা করা যেন তোমার ভাগ্যে রাখেন এবং তোমার সন্তানকে তোমার জন্য পবিত্র করেন, তাঁকে রক্ষা করেন ও তাঁর কল্যাণ থেকে তোমাকে করেন উপকৃত। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস পুত্র সন্তানের পিতা হয়েছেন শুনে আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলী (আ) একদল সঙ্গী নিয়ে তাঁকে দেখতে যান এবং তিনি তাঁকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, মহান আল্লাহ তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা বা প্রশংসা করা যেন তোমার ভাগ্যে রাখেন এবং তোমার সন্তানকে তোমার জন্য পবিত্র করেন। অর্থাৎ নবজাতকের জন্য আনন্দ প্রকাশ করা একটি ইসলামী রীতি ও প্রথা। আর অভিনন্দন বার্তায়ও থাকতে হবে এমন বক্তব্য যা খোদায়ি, আধ্যাত্মিক ও শিক্ষণীয় মূল্যবোধ তুলে ধরে এবং থাকতে হবে মহান আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের তাগিদ ও থাকতে হবে নবজাতকের বাবা ও খোদ নবজাতকের ভবিষ্যতের কল্যাণ কামনার দোয়া।

এখানে দুটি বিষয় লক্ষ্যণীয়। প্রথমত সন্তানের অধিকারী হওয়ার কারণে বাবা-মাকে অভিনন্দন জানানোর মধ্যে  ও আনন্দ প্রকাশের মধ্যে এ বার্তাও দেয়া হয় যে বাবা-মা যদি কোনো কারণে সন্তানের বাবা-মা হওয়ায় অসন্তুষ্ট থাকেন তাহলে তা পরিহার করে তারাও যেন খুশি হন। একইসঙ্গে তাদেরকে খোদায়ি নেয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হলে বাবা-মা আগ্রহ নিয়ে ও পরিপূর্ণ সন্তুষ্ট চিত্তে শিশুর প্রতিপালন ও প্রশিক্ষণে মনোযোগী হবেন এবং তার প্রভাবও শিশুর ওপর পড়বে। যে মা পরিপূর্ণ সন্তুষ্টি নিয়ে নিজ সন্তানকে বুকের দুধ পান করান ও তাঁকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করেন এবং তাঁকে আদর করেন তা ওই শিশুর ব্যক্তিত্বের যথাযথ ও উন্নত মাত্রার বিকাশে বেশি প্রভাব রাখে। দ্বিতীয়ত শিশুর সুস্থতা ও সৌভাগ্যের জন্য দোয়া করা সব সময়ই ও যে কোনো পর্যায়ে শিশুর শিক্ষার জন্য বেশ প্রভাবদায়ক। আর এ জন্যই তা বাবা-মায়ের প্রতি অভিনন্দন বার্তায় উল্লেখ করা হয়। দোয়া শিশুর আত্মিক, দৈহিক ও মানসিক ক্ষেত্রে প্রভাব রাখে। শিশু যখন বার বার বাবা-মাকে তার জন্য দোয়া করতে দেখে তখন শিশু নিজেও খোদায়ি সাহায্যের প্রতি এবং মহান আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে। 

শিশুর জন্য আকিকা করা ইসলামের একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রথা। সন্তান জন্ম নেয়ার পর সপ্তম দিনে আকিকা করতে হয়। আকিকা বলতে শিশুকে বালা মুসিবত থেকে রক্ষার জন্য পশু কুরবানি করাকে বোঝানো হয়। কোনো কোনো বর্ণনায় আকিকা করাকে ওয়াযিব বলা হয়েছে। আকিকা শিশুর শিক্ষা-প্রশিক্ষণ এবং মানসিক ও আত্মিক অবস্থার ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। হযরত ইব্রাহিম (আ) যখন মহান আল্লাহর নির্দেশে পুত্র ইসমাইল (আ)-কে কুরবানি করতে উদ্যত হন তখন মহান আল্লাহ একটি ভেড়া পাঠান ইসমাইলের পরিবর্তে। আর ওই ঘটনা থেকেই আকিকার প্রচলন হয়েছে।  আকিকার মাধ্যমে মহান আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করা হয়। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে: যদি তোমরা নেয়ামতের শোকর আদায় কর তাহলে তোমাদের নেয়ামত বাড়িয়ে দেব।  তাই আকিকার মাধ্যমে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ যে সন্তানের জীবন দীর্ঘ হওয়া ও সন্তান শক্তিশালী হওয়ার ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। নেয়ামত বৃদ্ধি বলতে সমাজ ও বাবা-মায়ের জন্য সন্তানটি সুসন্তান এবং বরকতপূর্ণ হওয়ার পাশাপাশি তার বাহ্যিক সৌন্দর্য ও সুস্বাস্থ্য লাভকেও বোঝায়। 

আকিকার পশু কুরবানির সময় বলা হয় : হে আল্লাহ তোমার নেয়ামতের কৃতজ্ঞতা হিসেবে এই কুরবানি করছি। আমার পরিবারের ওপর তুমি যে অনুগ্রহ করেছ তা উপলব্ধি করেই একে জবাই করছি।#

পার্সটুডে/এমএএইচ/আবুসাঈদ/১৩

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ