মার্চ ১৫, ২০২১ ১৬:১০ Asia/Dhaka

মানুষের জীবনে নামকরণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। মানুষের ব্যক্তিত্ব ও পরিচয়ের অনেক কিছুই বহন করে নাম। কেবল বাহ্যিক পরিচয়ই মানুষের নামের সব কিছু নয়।

ব্যক্তির নাম তার বাহ্যিক পরিচয়ের বাইরেও মানুষের কাছে সুপ্ত অনেক গভীর অর্থও অনেক সময় তুলে ধরে অব্যাহত সামাজিক সম্পর্কের সুবাদে। এভাবে মানুষের নাম সময়ের পরিক্রমায় পূর্ণতাকামী বা অধিকতর পরিপূর্ণ রূপ পেতে থাকে।

হৃদয়ের গভীর থেকে উঠে আসা মানুষের এক একটি নাম একে-অপরের কাছে অনেক সময় স্মৃতির আর্কাইভ থেকে তুলে ধরে অনেক স্মৃতি/ ও প্রভাব ফেলে পরস্পরের মনন-ও আচরণে। নানা ধরনের পছন্দ বা বাছ-বিচার, বিশ্লেষণ ও ঝোঁক-প্রবণতারও মাধ্যম হয়ে ওঠে মানুষের নাম। নাম কাউকে না দেখার অপূর্ণতা মিটিয়ে দেয় এবং খুব কাছ থেকে তার ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে না জানার তথ্যগত ঘাটতিগুলোও মিটিয়ে দেয়। কেবল তার নাম শুনেই আমাদের সমস্ত কল্পনা ও ধারণার পাখাগুলো ওই ব্যক্তির নানা গুণ আর বৈশিষ্ট্যের এক পরিপূর্ণ ছবি আমাদের কাছে তুলে ধরে।

মানুষ সন্তানদের জন্য যদি খুব সুন্দর নাম বাছাই করতে পারে তাহলে তা তাদের শিক্ষণ বা প্রশিক্ষণ এবং তাদের মন-মানসিকতার ওপরও বেশ জোরালো প্রভাব রাখতে সক্ষম।  ইসলামের একটি ঐতিহ্যবাহী ধারা হল এটা যে বাবা-মা সন্তানের ভবিষ্যৎ শিক্ষা ও উচ্চতর প্রশিক্ষণের কথা চিন্তা করে তার জন্য খুব সুন্দর একটি নাম বাছাই করবেন। একটি সুন্দর নাম পাবার অধিকার বাবা-মায়ের ওপর সন্তানের অন্যতম প্রধান অধিকার। এটি তার প্রশিক্ষণের জন্য ও সুসন্তান হিসেবে গড়ে ওঠার জন্যও খুবই জরুরি। উচ্চতর চিন্তা-চেতনার আলোকে সন্তানের জন্য সুন্দর ও উপযুক্ত নাম বাছাই করা ইসলামের দৃষ্টিতে বাবা মায়ের জন্য অন্যতম প্রধান বা জরুরি কর্তব্য।

একটি সুন্দর নামে কাউকে ডাকা বা আহ্বানের কারণে ওই ব্যক্তি নিজেকে ওই সুন্দর নামের বাস্তবতা ও অর্থগুলোর সঙ্গে যথাসম্ভব বেশি মানিয়ে চলার চেষ্টা করে। এমনকি সে নিজেকে ওই সুন্দর নামের আদর্শ দৃষ্টান্ত হিসেবেও ভাবার চেষ্টা করবে! একটি সুন্দর ও উপযুক্ত নাম সন্তানকে ভাবতে শেখায় যে সে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী ও বিশেষ গুরুত্বের অধিকারী।  আর এ বিষয়টি শিশুর মধ্যে আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দেয় এবং তার মনোবল থাকে সুস্থ ও প্রভাবদায়ক বা কার্যক্ষম।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয়জ অঙ্গরাজ্যের নর্থ-ওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষকের এক গবেষণায় বলা হয়েছে মানুষের নামকরণকে যেমনটা ভাবা হত তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে এখন মনে করা হচ্ছে।  ওই গবেষকরা বলছেন, একটি সুন্দর ও শ্রুতিমধুর নাম যে কেবলই ব্যক্তির আত্মবিশ্বাসের চেতনা বাড়িয়ে দেয় তা নয় একইসঙ্গে অন্যরাও অপেক্ষাকৃত বেশি ইতিবাচক দৃষ্টিতে তাকে দেখতে থাকে। এ প্রসঙ্গে ওই গবেষক টিমের সুপারভাইজার ডেভিড ফিলিও বলেছেন, 'যে পদ্ধতিতে আমাদের ডাকা হয় তা একটি সংকেত বা প্রতীক ও একটি দর্পণ। আসলে নাম একটি ভিজিটিং কার্ডের মত যা আমাদের ভেতরকার ব্যক্তিত্বগুলোর পরিচয় তুলে ধরে।  একটি নামের যে সুর বা ধ্বনি রয়েছে তা আমাদের সম্পর্কে অন্যদের আচরণ ও বিচার-বিশ্লেষণে সরাসরি প্রভাব রাখে।' তিনি আরও বলেছেন, 'একজন ছেলের নাম যদি অনেকটা বালিকাদের নামের মত কিছু হয় তাহলে তা ওই ছেলের নিরাপত্তার অনুভূতিতে নানা ধরনের মারাত্মক সমস্যা সৃষ্টি করবে। এ ছাড়াও খুব বেশি মৌলিক নাম বা খান্দানি নাম কিংবা দুর্লভ নাম ব্যাপক ভিন্নধর্মী বৈশিষ্ট্যের মানুষ গড়ে তুলবে।'

গবেষকরা এক হাজার ৭০০টি অক্ষরের মিশ্রণ ও ধ্বনি বিশ্লেষণ করে দেখেছেন যে মেয়েদের জন্য খুব শ্রুতিমধুর নাম রাখা হলে তাদের মধ্যে বেশি মাত্রায় নারীর ব্যক্তিত্বগুলো ও অপেক্ষাকৃত বেশি কোমল বা সূক্ষ্ম ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্যগুলো দেখা যায়। অন্যদিকে তাদের নাম যদি মেয়ে বা বালিকাদের নামের অনুরূপ না হয়, বরং তাদের নাম ছেলে বা বালকদের নামের অনুরূপ রাখা হয় কিংবা অপ্রচলিত ধরনের কোনও নাম রাখা হয় তাহলে তা তাদের ব্যক্তিত্বকে বেশি রুক্ষ এবং কঠোর প্রকৃতির করবে!

এভাবে দেখা যায় বিজ্ঞান সেই বিষয়কে আধুনিক যুগে স্বীকৃতি দিচ্ছে যা ইসলাম আজ থেকে প্রায় ১৪০০ বছর আগেই বলে রেখেছে। ইসলাম মানুষের জীবনের সব কিছু ও জীবনের খুব সূক্ষ্ম দিকগুলো যেমন – জন্মলাভের আগের প্রক্রিয়া থেকে মৃত্যুর পরের বিষয়ে দিক-নির্দেশনা দিয়েছে। মহানবী (সা) বলেছেন, 'সন্তানের জন্য সর্বপ্রথম উপহার হল তার জন্য সুন্দর নাম বাছাই। তাই সন্তানের জন্য  সর্বোত্তম নাম বাছাই করবে। '

শিশুকে ধর্মসহ নানা বিষয় শিক্ষা দেয়া যেমন জরুরি তেমনি তার একটি সুন্দর ইসলামী ধারার ঐতিহ্যবাহী নাম রাখাও বাবা মায়ের জন্য জরুরি কর্তব্য। সুন্দর নাম শিশুর ব্যক্তিত্বের প্রতি শ্রদ্ধা বৃদ্ধির পাশাপাশি পরিবারের চিন্তাধারা ও আগ্রহের বিষয়টিও ফুটিয়ে তোলে। শিশুর এমন অর্থপূর্ণ নাম রাখা উচিত যাতে খাঁটি ইসলামী সংস্কৃতির ও ইসলামের বার্তা ফুটে ওঠে।  সুন্দর নাম সন্তানের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে থাকে। বিশেষ করে সন্তান এতে বেশি বেশি ভালো কাজ করতে উৎসাহী হয় এবং তার মধ্যে প্রত্যাশিত আদর্শগুলোর প্রতি আগ্রহ জন্মে।

অন্যদিকে অবমাননাকর নাম ও তিরস্কারপূর্ণ নাম সন্তানের মধ্যে নেতিবাচক প্রবণতা, বিচ্ছিন্নতা বা একাকীত্ব, প্রতিশোধ-প্রবণতা বা হিংস্রতা ও সহিংসতার মনোভাব সৃষ্টি করে।

হযরত ইমাম বাক্বির আ. বলেছেন,

সেইসব নামই সবচেয়ে প্রিয় যেসব নাম আল্লাহ'র দাসত্বের অর্থ তুলে ধরে এবং সেসবের মধ্যে শ্রেষ্ঠ নামগুলো হল নবীদের নাম।  মুসলিম ও এমনকি অমুসলিম দেশগুলোতেও আমাদের প্রিয় মহানবীর (সা) নাম মুহাম্মাদ হচ্ছে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় নাম। ব্রিটেনের জাতীয় পরিসংখ্যান বিভাগ জানিয়েছে, মুহাম্মাদ সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রচলিত নাম। ব্রিটেনের নবজাতকদের মধ্যেও এ নাম তাঁর শীর্ষ অবস্থান ধরে রেখেছে।

মহান ব্যক্তিত্ব বা মহাপুরুষদের নামকে সন্তানের নাম হিসেবে বাছাইকরণ তাদের মধ্যে জন্ম দেয় নম্রতার অনুভূতি এবং তারা যত বেশি সম্ভব এই মহাপুরুষদের ব্যক্তিত্বের সাথে নিজ ব্যক্তিত্বের সমন্বয় ঘটার চেষ্টা করে ও পবিত্র এইসব নামের মর্যাদা রক্ষার জন্য সচেষ্ট থাকে।

ইতিহাসখ্যাত চরিত্র হুর ইবনে ইয়াজিদের কথা অনেকেই শুনেছেন। তার হুর নামের অর্থ মুক্ত। তিনি ইয়াজিদ বাহিনীর বড় জেনারেল ছিলেন। কিন্তু যখন দেখলেন তার কমাণ্ডাররা যুদ্ধ বাধিয়ে ইমাম হুসাইনকে শহীদ করতে চায় তখন তিনি আশুরার দিন তওবা করে ইমামের শিবিরে যোগ দেন এবং ইমামের বাহিনীর পক্ষে যুদ্ধ করে সর্বপ্রথম শহীদ হন। এ সময় ইমাম হুসাইন (আ) তাঁর পবিত্র হাত দিয়ে রক্তাপ্লুত হুরের চেহারা থেকে রক্ত মুছে দিয়ে বলেন: বাহ বাহ! কি চমৎকার কাজ করেছ হে হুর!  তুমি মুক্তভাবে মরেছ এমনভাবে যে দুনিয়া ও আখিরাতে তুমি মুক্ত হিসেবে অভিহিত হবে। আল্লাহর শপথ তোমার মা তোমার নাম হুর বা মুক্ত-স্বাধীন রেখে ভুল করেননি! আল্লাহর শপথ তুমি দুনিয়াতে মুক্ত মানব ছিলে এবং পরকালেও সৌভাগ্যের অধিকারীদের অন্যতম হবে। -ইসলাম সন্তানের প্রশিক্ষণকে তার জন্মের আগেই শুরু করে! সুন্দর নামের প্রভাব কেবল ইহকালে নয় পরকালেও বজায় থাকে।#

পার্সটুডে/এমএএইচ/আবুসাঈদ/১৫

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ