মার্চ ২৭, ২০২১ ১৯:৩০ Asia/Dhaka

গত আসরে আমরা কথা বলার চেষ্টা করেছি ইরানের গাড়ি নির্মাণ শিল্পের বিভিন্ন দিক নিয়ে। আশা করি মনে আছে আপনাদের। বলেছিলাম ইরানে ইসলামি বিপ্লব বিজয়ের আগে থেকেই অন্তত নয়টি গাড়ি নির্মাণ কোম্পানি গড়ে উঠেছিল।

বিপ্লব বিজয়ের পর এই শিল্পটি আরও বেশি গতি পায়। তবে  ইরাকের চাপিয়ে যুদ্ধের সময় ইরানের গাড়ি নির্মাণ শিল্পে ব্যাপক ধস নেমে আসে।

ওই ধস কিন্তু বেশিদিন স্থায়ী হয় নি।  যুদ্ধের পরিসমাপ্তির পর ইরান পুনরায় ঘুরে দাঁড়াবার চেষ্টা করে এবং সফল হয়। কেবল সংস্থাপন বা অ্যাসেম্বলিংই নয় বরং নিজেরাই গাড়ি নির্মাণের কাজ পুনরায় শুরু করে দেয়। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ইরানের গাড়ি তৈরির পরিমাণ অন্তত দশগুণ বেড়ে যায়। প্রায় চল্লিশটির মতো মডেলের যাত্রীবাহী গাড়ি তৈরি করে ইরান এবং ত্রিশটির মতো বাণিজ্যিক মডেলের গাড়ি তৈরি করে। ইরানের তৈরি এসব গাড়ি রপ্তানিও শুরু হয় বিভিন্ন দেশে। যেসব দেশে রপ্তানি হয় তার মধ্যে রয়েছে এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ। ভেনিজুয়েলা, কিউবায়ও রপ্তানি হয় ইরানের তৈরি বিভিন্ন মডেলের গাড়ি। বিগত পণর বছরে ইরানে দুই কোটিরও বেশি গাড়ি বিক্রি হয়েছে যার শতকরা নব্বুই ভাগেরও বেশি ইরানের নিজস্ব। যাই হোক গাড়ি নির্মাণ শিল্প নিয়ে আজকের আসরেও আমরা কথা বলার চেষ্টা করবো।

বর্তমানে পঁচিশটিরও বেশি গাড়ি নির্মাণ কোম্পানি রয়েছে ইরানে। এইসব কোম্পানির সহযোগী আরও বারো শ'রও বেশি পার্টস তৈরির বিভিন্ন কারখানা গড়ে উঠেছে। এই গাড়ি নির্মাণ শিল্পে এবং এই শিল্প সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সহযোগী কোম্পানিগুলোতে ইরানের মোট জনসংখ্যার দশ ভাগের মতো জনশক্তির কর্মসংস্থান হয়েছে। ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে ইরানে মোট গাড়ি বিক্রি এবং গাড়ির পার্টস ও অন্যান্য সরঞ্জাম বিক্রির মূল্যমান ছিল দুই হাজার তিন শ কোটি ডলারের বেশি। এর মধ্যে পার্টস বিক্রির পরিমাণ ছিল পাঁচ শ কোটি ডলারের উপরে। মনে করা হচ্ছে যে দুই হাজার পঁচিশ সাল নাগাদ ইরানে মোট গাড়ি বিক্রি এবং গাড়ির পার্টস ও অন্যান্য সরঞ্জাম বিক্রির মূল্যমান চার হাজার পাঁচ শ থেকে পাঁচ হাজার কোটি ডলারে পৌঁছে যাবে। এই লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছানোর জন্য যদিও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে তবু আশার বিষয় এই যে, ইসলামি বিপ্লব বিজয়ের পর থেকে দশকের পর দশক ধরে ইরানের ওপর অন্যায় অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা সত্ত্বেও ইরান অবিশ্বাস্য রকমের সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। এই সাফল্যের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অবশ্য ইরান গাড়ি নির্মাণ ক্ষেত্রে বেশ কিছু সাফল্য অর্জন করেছে। এইসব সাফল্যের মধ্যে উল্লেখ করার মতো হলো বিশ্ব মানের মোটর তৈরি ও উৎপাদন। ইরান খোদ্রো কোম্পানি গ্যাস-জ্বালানি ভিত্তিক প্রথম মোটর উৎপাদন শুরু করে। এই ঘটনা ছিল দেশের স্বনির্ভরতার পথে গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ ও সাফল্য। এই পণ্যটি বিশ্বের প্রথম গ্যাস-চালিত ইঞ্জিন যা ব্যাপকহারে উত্পাদনের পর্যায়ে পৌঁছেছে। এই প্রকল্পটিকে কাজে লাগিয়ে ইরান ইঞ্জিন নির্মাণকারী একটি দেশে পরিণত হবার সুযোগ লাভ করেছে। জ্বালানী খরচ হ্রাস করার জন্য আধুনিক প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে অনেক নতুন নতুন মডেলের গাড়ি বাজারে হাজির করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে বৈদ্যুতিক এবং হাইব্রিড যানবাহনগুলোর নাম উল্লেখযোগ্য।

আমরা নতুন প্রযুক্তির গাড়ির কথা বলছিলাম। বিশেষ করে হাইব্রিড গাড়ি। স্বয়ংচালিত হাইব্রিড গাড়ি বলা হয় এমন এক ধরনের গাড়িকে যে গাড়ির কমপক্ষে দুই রকমের অ্যানার্জি সোর্স ব্যবহারের সিস্টেম থাকে। নতুন প্রজন্মের হাইব্রিড গাড়ির দুটি মোটর থাকে। একটি জ্বালানি চালিত মোটর আরেকটি বিদ্যুৎ চালিত মোটর। গ্লোবাল ওয়ার্মিং, জলবায়ু পরিবর্তন, বিশ্বের বিভিন্ন শহরে বায়ু দূষণ বৃদ্ধি, জীবাশ্ম বা ফসিল জ্বালানীর উৎস হ্রাস, স্বয়ংচালিত গাড়ি শিল্প প্রকৌশলীদেরকে এসব সমস্যার সমাধানে চিন্তাভাবনা করতে বাধ্য করেছে। যানবাহনের জ্বালানী ব্যবহারের পরিমাণ হ্রাস করাসহ পরিবেশ অনুকূল জ্বালানীর উৎসের বিভিন্ন সমাধানের চেষ্টা করেছেন তারা। সেইসব সমাধান চিন্তারই একটি ফল হলো হাইব্রিড গাড়ি তৈরি।

এ ধরনের গাড়িতে মোটরের জন্য প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয় নতুন প্রজন্মের বাইপোলার ব্যাটারির মাধ্যমে। এই শ্রেণীর গাড়ীতে জ্বালানী ইঞ্জিনই গাড়ি চালনার প্রধান শক্তি বা উৎস আর ব্যাটারি সেক্ষেত্রে সহায়ক উত্স হিসাবে কাজ করে। বৈদ্যুতিক মোটরও এসব গাড়িতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করে। সাধারণত জ্বালানী ইঞ্জিন থেকে উৎপন্ন অতিরিক্ত অ্যানার্জি ডায়নামোর মাধ্যমে ব্যাটারিতে সংরক্ষিত হয়। এভাবে জ্বালানী খরচ যেমন কমে যায় তেমনি জ্বালানীর নির্গত ধোঁয়া থেকে সৃষ্ট বায়ু দূষণও হ্রাস পায়। ধারণা করা হয় যে দুই হাজার ত্রিশ সালের মধ্যে বিশ্বের গাড়ি নির্মাণ শিল্পের ডিজাইন হাইব্রিড এবং বৈদ্যুতিক মোটর চালিত ইঞ্জিন নির্ভর হয়ে উঠতে পারে। মজার ব্যাপার হলো হাইব্রিড গাড়ি অনেক আগেও নির্মিত হয়েছিল। প্রায় শত বছর আগে তৈরি করা হতো হাইব্রিড গাড়ি। পরে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু সম্প্রতি আবারও হাইব্রিড গাড়ি নিয়ে গবেষণা হয়েছে এবং এই শ্রেণীর গাড়ি নির্মাণের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠেছে গাড়ি নির্মাণ কোম্পানিগুলো।

আমরা নতুন প্রযুক্তি তথা হাইব্রিড প্রযুক্তির গাড়ির কথা বলছিলাম। বৈদ্যুতিক এবং হাইব্রিড গাড়ির সুবিধার দিকটি হলো পরিবেশ দূষণ কম হওয়া। সাধারণত ফসিল জ্বালানি ব্যবহারের কারণে পরিবেশ ব্যাপকভাবে দূষিত হয়ে যায়। হাইব্রিড গাড়ি পরিবেশ ততটা দূষিত করে না। দ্বিতীয় সুবিধাটি হলো এই শ্রেণীর গাড়ির জ্বালানি খরচ তুলনামূলকভাবে কম। একটি পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় উনিশ শ ছিয়ানব্বুই সাল থেকে দুই হাজার ছয় সাল পর্যন্ত বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারির দাম চার ভাগের এক ভাগ কমে গেছে। ইরানের গাড়ি নির্মাণকারী প্রকৌশলীরাও এ বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করেছেন এবং গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। যাই হোক, এক দশকেরও বেশি সময় আগে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে অ্যারিয়ানা-৮০০ মডেলের ইলেকট্রিক স্মার্ট গাড়ি উদ্বোধন করা হয়েছিল যার সর্বাধিক গতি ছিল ঘণ্টায় দুই শ কিলোমিটার।

অস্ট্রেলিয়ার এসবিএস টেলিভিশন চ্যানেল ওই গাড়ির নির্মাণ কৌশলসহ সকল দিক পর্যালোচনা করে ঘোষণা দিয়েছিল বিশ্বের সর্বপ্রথম ইলেকট্রিক স্মার্ট গাড়ি অ্যারিয়ানা-৮০০'র আবিষ্কারক ও নির্মাতা হলো একজন ইরানি। মোটরগাড়ি শিল্পের ক্ষেত্রে ইরানীদের আর একটি উদ্ভাবন হ'ল এক ধরণের ব্যাটারির নকশা এবং নির্মাণ যা মাধ্যাকর্ষণ শক্তি দ্বারা চার্জ করা হয়। ইরানিদের আরেকটি উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার হলো "ইউজ" ব্র্যান্ডের কোয়াড্রা কিউ-ওয়ান নামের চার চাকাযুক্ত মোটরসাইকেল যা দুইজন আরোহীর জন্য তৈরি করা হয়েছে।#

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/ মো:আবু সাঈদ/ ২৭

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ