মোদির সফরের সময় যা ঘটেছে তা দুঃখজনক: বদিউল আলম মজুমদার
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফর এবং পরবর্তী প্রতিক্রিয়া নিয়ে রেডিও তেহরানের সাথে কথা বলেছেন, অর্থনীতিবিদ, উন্নয়নকর্মী, রাজনীতি বিশ্লেষক, স্থানীয় সরকার ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ এবং সুজন সম্পাদক ড.বদিউল আলম মজুমদার।
নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরকালীন বিভিন্ন ঘটনাকে তিনি দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেছেন। তবে নানা কারণে ভারতের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষের ক্ষোভের বিষয়টি তিনি তুলে ধরেছেন।
পুরো সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো। এটি গ্রহণ, উপস্থাপনা ও তৈরি করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।
রেডিও তেহরান: জনাব, ড.বদিউল আলম মজুমদার ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকে কেন্দ্র করে সারা দেশে বিক্ষোভ-প্রতিবাদ হয়েছে। শেষ পর্যন্ত তা হত্যাকাণ্ডে গিয়ে পৌঁছেছে। ঘটনাটিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
ড.বদিউল আলম মজুমদার: অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা হিসেবে দেখছি। এই ঘটনাটি ঘটা উচিত ছিল না। ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক বহুদিনের এবং ঘনিষ্ট। বাংলাদেশ সৃষ্টির জন্য ভারতীয় নাগরিকরাও রক্ত দিয়েছেন। ফলে বাংলাদেশের সুবর্নজয়ন্তী এবং বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে যে অনুষ্ঠান সেটি এক অর্থে আনন্দের অন্য অর্থে বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের। এ সময়ে আমাদের বন্ধু রাষ্ট্রের সরকার প্রধানের এখানে আসার পর যে ঘটনা ঘটেছে সেটি খুবই দুঃখজনক।
এরমূল কারণ হিসেবে আমি মনে করি, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একজন হিন্দুত্ববাদী নেতা। তিনি যখন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন তখন তার কর্মকাণ্ড-সেখানে ধর্মীয় উগ্রবাদ মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে। ভারতে উগ্র হিন্দুত্ববাদের যে কর্মততপরতা তার বিরুদ্ধে তিনি কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি উপরন্তু তিনিই এর পৃষ্ঠপোষকতা করছে বলে মনে করা হয়। এছাড়াও ভারতের অসমে কিংবা ভারত জুড়ে যে নাগরিকত্ব আইন সেটি মুসলিমদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে বা হবে বলে অনেকের ধারনা। শুধু তাই নয় যখন ভারতে নতুন নাগরিকত্ব আইন পাস হয় তখন তারা বাংলাদেশিদের 'উইপোকা' থেকে শুরু করে বিভিন্ন অগ্রহণযোগ্য ভাষা ব্যবহার করেছে। এসব বিষয় আমাদের এখানকার মানুষকে ব্যথিত করেছে।
তবে হ্যাঁ- এটা হতে পারত যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির পরিবর্তে ভারতের রাষ্ট্রপতিকে আমন্ত্রণ জানানো উচিত ছিল। তাহলে আমার মনে হয় না এরকম দুঃখজনক ঘটনা ঘটত।
রেডিও তেহরান: জ্বি জনাব ড. বদিউল আলম মজুমদার, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে নিয়ে তার দেশের মধ্যে অনেক কথা রয়েছে এবং তার বিরোধিতা রয়েছে ব্যাপকভাবে হিন্দুত্ববাদী হিসেবে। গুজরাট দাঙ্গা, অসমে এনআরসিসহ নানা বিষয় নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তো সেই হিসেবে যারা নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে বিক্ষোভের ডাক দিয়েছেন তাদের অবস্থান কতটা যৌক্তিক?
ড.বদিউল আলম মজুমদার: দেখুন, আমরা যদি নিজেদেরকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে দাবি করি তাহলে যেকোনো নাগরিকেরই প্রতিবাদ করার অধিকার আছে। কিন্তু সেটি সহিংসভাবে নয়; শান্তিপূর্ণভাবে হতে হবে। অনেকেই দাবি করছে যদি সরকারি দলের পক্ষ থেকে বাড়াবাড়ি না করা হতো তাহলে হয়তো শান্তিপূর্ণভাবেই প্রতিবাদ হতো ।
রেডিও তেহরান: অনেকেই সমালোচনা করছেন যে, সরকার বিক্ষোভ মোকাবেলায় আরো সহনশীল হতে পারত। স্বাধীনতার মাসে এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা মোটেই কাঙ্ক্ষিত নয়। আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
ড.বদিউল আলম মজুমদার: দেখুন, বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে নানা ক্ষোভ আছে, অসন্তোষ ও অপমানবোধ আছে এবং এরকম একটা ধারনা রয়েছে ভারতকে আমরা এক তরফাভাবে সবকিছু দিয়েছি অথচ আমরা তেমন কিছু পাই নি। তাছাড়া সীমান্ত হত্যাকাণ্ড, তিস্তা চুক্তিসহ আরও অনেক কারণ রয়েছে।
তো যে বিষয়টি আপনি জানতে চাইলেন, আসলে বিক্ষোভের সময় যে ঘটনা ঘটেছে তাতে বলা যায় দুভার্গ্যবশত সরকার ও দলের মধ্যে যে পার্থক্য সেটি চলে গেছে। পুলিশের সাথে সরকারি দলের যারা সহিংস কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়েছে তারা অপরাধী। তাদের বিরুদ্ধে পুলিশের ব্যবস্থা নেয়া উচিত। সেটি না করে বরং মামলা হয়েছে অন্যদের বিরুদ্ধে। তারা যদি দায়িত্বশীল ও সহনশীল হতো তাহলে আমার মনে হয় এটা এড়ানো যেত।
রেডিও তেহরান: ড. বদিউল আলম মজুমদার, আপনি সুদীর্ঘকাল বাংলাদেশের সমাজ নিয়ে কাজ করছেন। তো সম্ভবত কোনো বিদেশি সরকার প্রধানের বাংলাদেশ সফরের বিরুদ্ধে এটিই প্রথম ও বড় ধরনের রক্তক্ষয়ী প্রতিবাদ যেখানে বহু মানুষ নিহতের ঘটনা ঘটলো। বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখবেন?
ড.বদিউল আলম মজুমদার: দেখুন, দুভার্গ্যবশত ভারতবিরোধীতা যেভাবে শুরু হয়েছে সেজন্য বর্তমান সরকারেরও বিতর্কিত কর্মকাণ্ডও দায়ী। একইসাথে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং তার দল বিজেপির যে মুসলিমবিরোধীতা এবং উগ্র হিন্দুত্ববাদিতার প্রতি তার যে পৃষ্ঠপোষকতা সেটাও রয়েছে। এবারের ঘটনার মাধ্যমে সেটি আরও গভীর হলো।
রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে কেউ কেউ বলবেন হয়তো সরকারি দলের জন্য এটি ইতিবাচক হয়েছে। এই অর্থে যে তারা হয়তো দেখাতে পারছে বাংলাদেশের ধর্মীয় দলগুলোর সাথে সরকারের একটা সাংঘর্ষিক অবস্থা বিরাজ করছে। অতএব তারা এটি দেখাতে পারবে যে উগ্রবাদের বিরুদ্ধে তারা লড়াই করছে। স্বল্পমেয়াদিভাবে এটি সত্য হলেও দীর্ঘমেয়াদিভাবে এর পরিণতি মঙ্গলজনক হবে না।
এর মাধ্যমে দুটো জিনিষ হলো- একটি হচ্ছে ডান-বাম একত্রিত হলো। তাদের মধ্যে কর্মসূচিভিত্তিক একটি ঐক্য সৃষ্টি হলো। অপর বিষয়টি হচ্ছে- দীর্ঘমেয়াদি ফল। আমরা গণমাধ্যমের সুবাদে জানতে পারলাম যে, যেসব মামলা হচ্ছে তাতে হেফাজতের নেতাদের আসামি করা হচ্ছে না। যদিও তারাই ঐ হরতাল ডেকেছিল তারাই আন্দোলনের সূচনা করেছিল। সরকার হেফাজতকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে আসছিল। অন্যদিকে মাঠের যে বিরোধী দল বিএনপি তাদের কোমর ভেঙে দিয়েছে। তারা এখন খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারছে না এবং আমাদের দেশে রাজনীতি বলা চলে অনুপস্থিত। এই সুযোগে হেফাজত বিরোধী দলের শূন্যস্থান পূরণ করতে পারে। তারমানে ধর্মীয় গোষ্ঠীই কিন্তু বাংলাদেশে শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়াতে পারে। আমি মনে করি না এটি দেশের জন্য কল্যানকার। তারমানে যারা মডারেট তাদের পরিবর্তে ধর্মভিত্তিক একটি গোষ্ঠী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হবে। এটি বাংলাদেশের জন্য দীর্ঘমেয়াদিভাবে কল্যান বয়ে আনবে বলে আমি মনে করি না।
রেডিও তেহরান: জনাব ড. বদিউল আলম মজুমদার, আপনি রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণের কথা বলছিলেন। তো ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ গোটা দেশে মোদির সফরের সময় যে বিক্ষোভ প্রতিবাদ হলো এবং হত্যার ঘটনা ঘটল কিন্তু ঐ ঘটনার দায় কেউ নিতে চাচ্ছে না। হেফাজতে ইসলাম বলছে, তারা করেনি সরকারি দল করেছে। আর সরকারি দল বলছে হেফাজতের পেছনে বিএনপিসহ অন্যান্য দলের হাত এবং ইন্ধন রয়েছে। বিএনপি বলছে এটি সরকারি দলের কর্মকাণ্ড। এভাবে পরস্পরের বিরুদ্ধে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ রয়েছে। তো আসলে এই পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগের কালচার এখনও চলছে। যেখানে আপনি রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণের কথা বলছিলেন, যেখানে বিরোধী দলের শূন্যতার জায়গা পূরণে হেফাজতে ইসলামের সামনে চলে আসা সেটাও ভালো নয়। তো এই সামগ্রিক বিষয়কে আপনি কিভাবে দেখছেন?
ড. বদিউল আলম মজুমদার: দেখুন, আমাদের দেশে যে বিচারহীনতার সংস্কৃতি বিরাজ করছে এটি তারই প্রতিফলন। এখানে আইনের শাসন নেই, আইনের দ্বারা শাসন হয়। অর্থাৎ কারা অন্যায় করল আর কারা করেনি সেটি গুরুত্বপূর্ণ নয়; সবকিছু নির্ধারিত হয় রাজনৈতিক বিবেচনায়। কারা ক্ষমতাসীনদের বন্ধু আর কারা তাদের শক্র, কাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে আর কাদেরকে পৃষ্ঠপোষকতা দিতে হবে এসব বিবেচনায় সিদ্ধান্ত হয়। এরও পরিণতি মঙ্গলকর নয়।
আইনের শাসন যদি না থাকে, সুশাসন যদি প্রতিষ্ঠিত না হয় তাহলে এক অর্থে কেউ নিরাপদ নয়। অন্যদিকে আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার জন্য এটি ক্ষতিকর।
রেডিও তেহরান: ড. বদিউল আলম মজুমদার, আমার সাক্ষাৎকারের শেষ প্রান্তে চলে এসেছি। সবশেষে আপনার কাছে যে বিষয়টি জানতে চাইব সেটি হচ্ছে, আপনি অর্থনেতিক অগ্রযাত্রার কথা বলছিলেন। তো একইসাথে আমি একটু দু দেশের মধ্যকার দেনা-পাওনা বা স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় আনতে চাইছি। সেটি হচ্ছে নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে কোনো সমাধান এলো না। সীমান্ত হত্যার বিষয়টি রয়েছে। বাণিজ্যিক বৈষম্যের একটা ব্যাপার আছে। এসব বিষয় নিয়ে বিভিন্ন মহলে এক রকমের হাতাশা আছে বলে কেউ কেউ উল্লেখ করছেন। আাপনারও কী তাই মনে হয়?
ড.বদিউল আলম মজুমদার: দেখুন, নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে যে বিক্ষোভ, ক্ষোভ এবং যে প্রতিবাদ তার পেছনে অনেকগুলো কারণ রয়েছে। একটি কারণ হিসেবে বলা যায় তাদের যে বঞ্চনা কিংবা বৈষম্যের দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে সেটি। বাংলাদেশ সবদিক থেকে তারা যা চেয়েছে তা দেয়া হয়েছে। তার পরিবর্তে আমাদের যা ন্যায্য প্রাপ্র্য তা থেকে আমরা বঞ্চিত হয়েছি। বাংলাদেশে ভারতের একচেটিয়া বাজার রয়েছে। শুধু তাই নয়-ভারত বাংলাদেশিদেরকে ' উইপোকা' বলে ডাকে। তারা বলে বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশ ঠেকাবে। অথচ বহু ভারতীয় এখানে উচ্চ পদে চাকরি করে অনেক রেমিটেন্স ভারতে নিয়ে যাচ্ছে। এটি দোষের কিছু নয়। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হওয়া উচিত। দুদেশে যাতায়াতসহ আরও অনেক রকমের স্বাধীনতা থাকা উচিত। অর্থাৎ দুদেশের, আর্থ-সামাজিক এবং রাজনৈতিক থেকে যদি আরও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হয়- সেটি হবে উইন উইন। সবার জন্য হবে মঙ্গলকর। কিন্তু সেটি হয়েছে একতরফা। আর সেটিও ভারতের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষের ক্ষোভের বড় কারণ বলে আমি মনে করি।
রেডিও তেহরান: তো জনাব ড. বদিউল আলম মজুমদার, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফর এবং সেসময় ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা এবং পরবর্তীতে তা নিয়ে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে রেডিও তেহরানের সাথে কথা বলার জন্য আপনাকে আবারও অনেক অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
ড.বদিউল আলম মজুমদার: আপনাকেও ধন্যবাদ।#
পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/৫
- বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।