এপ্রিল ১৪, ২০২১ ১৭:৩৫ Asia/Dhaka

শিশুদের তথা সন্তানের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে খেলাধুলার গুরুত্ব অপরিসীম। সন্তানকে সময়মত খেলাধুলার সুযোগ দেয়া বা সুযোগ করে দেয়া বাবা-মা ও অভিভাবকের জরুরি দায়িত্ব।

জীবনের যে সময়টায় তথা যে বয়সে শিশুদের খেলাধুলার প্রতি আগ্রহ থাকে সে সময় তাকে খেলাধুলা থেকে বঞ্চিত রাখলে তা তার ভবিষ্যতের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। খেলাধুলা শিশুর বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ ঘটায় ও এর মাধ্যমে তাদের সামাজিক জ্ঞান আর সচেতনতাও বাড়ে। অনেক খেলা এমনই যে সেসব শিশুকে ভবিষ্যৎ সমস্যা বা সংকট মোকাবেলার জন্যও প্রস্তুত করে।

খেলাধুলা শিশুর জীবনের সুন্দরতম মুহূর্তগুলোর অন্যতম। শিশুর শিশুসুলভ প্রকৃতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে মিশে রয়েছে খেলাধুলার প্রতি আকর্ষণ। শিশুকে খেলতে দেয়া তার অন্যতম প্রধান চাহিদা ও অধিকার। শিশুদের প্রধান বিনোদনই হল খেলাধুলা। বিশেষ করে স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগ পর্যন্ত খেলাধুলা ছাড়া অন্য কোনো বিনোদন শিশুকে তেমন একটা আকৃষ্ট করে না।

শিশুরা জানে না যে কেন তাদেরকে খেলতে হবে বা খেলার গুরুত্ব তারা মুখের ভাষায় তুলে ধরতেও হয়ত সক্ষম নয় কিন্তু খেলাধুলা না করাটা শিশুদের জন্য দুঃসাধ্য বা অসম্ভব বিষয়। মনোবিজ্ঞানীদের মতে পানি, আলো ও বাতাস যেমন শিশুদের জন্য অপরিহার্য তেমনি খেলাধুলা ও বিনোদনও তাদের জন্য জরুরি। 

আধুনিক গবেষণায় দেখা গেছে যে শিশুরা পর্যাপ্ত মাত্রায় খেলাধুলা করে না তাদের যথাযথ বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ ঘটে না। এইসব শিশু বড় হওয়ার পর ঘরকুনো বা একঘরে হয়ে থাকে। দলবদ্ধ খেলায় অংশ নিয়ে শিশুরা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, একে-অপরকে সহযোগিতা করা বা অন্যদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া, অন্যদের অধিকার রক্ষা করা, নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে চলা, নিজের অধিকার রক্ষা করতে শেখা ও অন্যদের ব্যাপারে দায়িত্ব-সচেতন হতে শেখাসহ আরও অনেক কিছু শিখতে পারে। সামষ্টিক খেলায় তরুণ ও শিশুরা নানা সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে আনন্দ উপভোগ করে এবং এতে ভবিষ্যতের প্রতি তারা আগের চেয়েও দিনকে দিন বেশি আশাবাদী হয়ে ওঠে।

ইসলাম জীবনের নানা পর্যায়ে মানুষের স্বাভাবিক বা প্রকৃতিগত চাহিদাগুলোর বিষয়ে ও অন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ সূক্ষ্ম বিষয়ের প্রতি মা-বাবাসহ অন্যদের সচেতন করে। শিশুরা খেলাধুলার সময় কেবল খেলার গভীর আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে অন্য সব কিছু ভুলে থাকলেও খেলাধুলা শিশুর বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইমাম জাফর আস সাদিক্ব (আ) বলেছেন, সন্তানকে জীবনের প্রথম সাত বছর পর্যন্ত খেলতে দাও, দ্বিতীয় সাত বছরে তাকে আদব-কায়দাসহ নানা বিষয়ে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দাও এবং তৃতীয় সাত বছরে তার ব্যাপারে যত্নশীল হও।

শিশুদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের জন্য ব্যবহার করা যায় অনেক বিচিত্রময় খেলা। যেমন, মেহমান-মেহমান খেলা শিশুদেরকে বন্ধুত্ব গড়া ও সামাজিক সম্পর্ক বিষয়ে সচেতন করে। অন্য অনেক খেলা রয়েছে যেসব খেলা শিশুদেরকে নানা পেশার বিষয়ে জ্ঞান দান করে। কল্পনা-কেন্দ্রিক খেলাধুলা শিশুকে নিজের বিষয়সহ নানা বিষয় এবং বর্তমান ও ভবিষ্যতের বিষয়গুলো পরিচালনা সম্পর্কে ধারণা দেয়। এভাবে শিশুরা খেলাধুলার মাধ্যমেই ভবিষ্যৎ জীবনের নানা চ্যালেঞ্জ ও দায়িত্ব সম্পর্কে প্রস্তুতি নেয়ার সুযোগ পায়। এ ধরনের খেলার মাধ্যমে শিশু নিজের বিষয়ে ও জীবনের নানা অবস্থা ও পর্যায় সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে শেখে। 

শিশুরা সমবয়সী অন্য শিশুদের সঙ্গে মিশতে চায়। তারা আশপাশের ব্যক্তিদের পারস্পরিক সম্পর্কে ব্যাপারে কখনও সতর্ক ও কখনও অসতর্ক এবং এ বিষয়ে স্পর্শকাতর। তারা আশপাশের ব্যক্তিদের অনুকরণ করে। তাই খেলাধুলা হচ্ছে শিশুদের জীবন ও চিন্তার অংশ। খেলাধুলা তাদের ব্যক্তিত্ব গড়ে তোলার অন্যতম প্রধান উপাদান। শিশু তারা খেলনা নিয়ে কেবল খেলাই করে না, সেসবকে জীবন্ত করে তোলে। সে খেলনার সঙ্গে বন্ধু হয়, ঝগড়া করে, খেলনাকে উপদেশ দেয় এবং তাকে তার দুশ্চিন্তাগুলোর কথা বলে ও  এভাবে খেলনার মাধ্যমে তার মানসিক চাপ কমায়। তাই শিশুদের নানা খেলনা খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং শিশুদের জন্য উপযুক্ত গঠনমূলক বা  শিক্ষণীয় খেলনা ও খেলা বাছাই করা  বাবা-মায়ের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। ইসলাম এ বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয় এবং এমনকি বাবা মাকেও শিশুদের সঙ্গে খেলায় অংশ নিতে বলে। মহানবী (সা) নিজেও শিশুদের সঙ্গে খেলতেন।

একবার শিশু হুসাইন (আ) মহানবীর নামাজের সিজদার সময় নানার পিঠে চড়ে বসলেন। মহানবী তখন সিজদা এত দীর্ঘ করলেন যে নামাজের জামাআতে শরিক সাহাবিদের অনেকেই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন! নামাজের পরে মহানবী (সা) এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন: আমার সন্তান আমাকে তাঁর বাহন করেছিল, তাই তাঁকে তাঁর ইচ্ছামত দীর্ঘক্ষণ সওয়ারি হওয়ার সুযোগ দিলাম এবং তাড়াহুড়া করে তাঁকে নিচে নামিয়ে দেয়াটা অপছন্দনীয় মনে করলাম।

মহানবী (সা) মদিনার আরও অনেক শিশুর খেলার সঙ্গী ছিলেন। অন্য কোনো কোনো সাহাবীও মহানবীর পাশাপাশি এভাবে শিশুদের ঘোড়া বা উট হতেন। একবার মহানবী (সা) সফর থেকে আসার পর জরুরি কাজ থাকায় মদিনার শিশুদের নিয়ে ঘোড়-সওয়ারি খেলা সম্ভব হচ্ছিল না। ফলে এ খেলার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষারত শিশুদের শান্ত করতে তাদের প্রস্তাব দেয়া হল তারা যেন খেজুরের বিনিময়ে এ যাত্রা তাদের বাহন বা ঘোড়াগুলোকে বিক্রি করে দেয়! শিশুরাও সানন্দে রাজি হয় এ প্রস্তাবে। তারা পরে একে-অপরকে বলছিল: আমি আমার ঘোড়া বিক্রি করে এতটা খেজুর পেয়েছি!

একবার একদল শিশু মাটি নিয়ে খেলছে দেখে একজন সাহাবি তাদের এ খেলা থেকে বিরত হতে বললেন। কিন্তু মহানবী (সা) বললেন, তাদেরকে খেলতে দিন। কারণ মাটি হচ্ছে শিশুদের বাগান। 

শিশুদের নানা ধরনের সজীবতা ও প্রাণবন্ততা ব্যয়ের মাধ্যম হল খেলাধুলা। ফলে খেলাধুলার সুযোগ না থাকলে শিশুদের মধ্যে অস্থিরতা ও নানা সমস্যা দেখা দেয়। শিশু ও কিশোরদের সৃষ্টিশীলতা বিকাশের মাধ্যম হল খেলাধুলা। তাদের আবেগ ও নানা অনুভূতির বিকাশ ঘটায় খেলাধুলা। শৈশব-কৈশরে আবেগের প্রকাশ ও তা নিয়ন্ত্রণ করতে শেখারও মাধ্যম হল খেলাধুলা। সংঘবদ্ধ খেলায় শরিক শিশু-কিশোররা অন্যদের চেয়ে বেশি মাত্রায় পারস্পরিক সহমর্মী হয়ে থাকে। খেলাধুলার মাধ্যমে শিশু-কিশোরদের ব্যায়াম ও শরীর-চর্চার কাজও সম্পন্ন হয় এবং এর ফলে তাদের শরীরের নানা অঙ্গের মধ্যে ভারসাম্য থাকে। খেলাধুলার সুযোগ পাওয়া শিশু-কিশোর অন্য শিশু-কিশোরদের চেয়ে বেশি দক্ষ হয় এবং জীবনের নানা প্রতিকূলতা মোকাবেলায় বেশি প্রস্তুত থাকে। 

বাবা-মা শিশুদের সঙ্গে মাঝে মধ্যে খেলায় অংশ নিয়ে তাদের সম্মান দেয়ার পাশাপাশি শৃঙ্খলা, খেলার নিয়ম-রীতি ও নৈতিক বিষয়াদিসহ তাদের অনেক কিছু শেখাতে পারেন। বড়রা যখন শিশুদের সঙ্গে খেলবেন তখন তাদেরকেও হতে হবে শিশুদের মতই। শিশুরা যেসব খেলা খেলতে চায় না তাদেরকে জোর করে সেসব খেলায় অংশ নিতে বাধ্য করা ঠিক নয়। যেসব খেলা ক্ষতিকর সেসব খেলার ক্ষতি ও মন্দ পরিণতির বিষয়টি ভালোভাবে তাদেরকে বোঝাতে হবে এবং ভালো খেলার বিষয়টিও একইভাবে তাদের বোঝাতে হবে। খেলাধুলার বিষয়ে শিশুদের রাজি করানোর এটাই হল সঠিক পদ্ধতি।

কম্পিউটার গেম ও ইন্টারনেটের নানা খেলা আজকাল শিশু-কিশোরদেরকে প্রাকৃতিক ও উপকারী নানা খেলাধুলা থেকে বঞ্চিত করছে এবং অনেক ক্ষেত্রে সৃষ্টি করছে নানা ধরনের মন্দ আসক্তি। ফলে ক্ষতি হচ্ছে তাদের মন ও শরীরের এবং শিক্ষা-প্রশিক্ষণ ও চিন্তার বিকাশের।  কম্পিউটার ও ইন্টারনেটে খেলাগুলোর নেতিবাচক ও ক্ষতিকর নানা দিকের সংশোধন করতে হবে অথবা এক্ষেত্রে বাবা-মা বা অভিভাবকদের নিয়ন্ত্রণাধীন এমনসব খেলা তৈরি জরুরি যা শিশু-কিশোরদের খুব বেশি সময় কেড়ে না নেয়  এবং সেগুলো হয় গঠনমূলক ও চিন্তা-উদ্দীপক শিক্ষার মাধ্যম হওয়ার পাশাপাশি শিশু-কিশোরদের জন্য ক্ষতিকর পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে তৈরি খেলাগুলোর চেয়ে বেশি আকর্ষণীয়।#

পার্সটুডে/এমএএইচ/আবুসাঈদ/১৪

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ