এপ্রিল ২৯, ২০২১ ০০:৫৪ Asia/Dhaka

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ একটি জাতীয় দুর্যোগ। এ দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য আমাদের জাতীয়ভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করার দরকার ছিল। সেটি হয় নি। ফলে এটি একটি বড় ধরনের ব্যর্থতা। রেডিও তেহরানকে দেয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে একথা বলেন বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল বা বাসদ এর কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক কমরেড খালেকুজ্জামান। তিনি বলেন, লকডাউন দেয়া হয়েছে তবে সাধারণ মানুষ যারা দিন আনে দিন খায় তাদের কথা ভাবা হয় নি, সেইসব মানুষের জীবন কীভাবে চলবে সে কথা ভাবা হয় নি।

পুরো সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো। এটি গ্রহণ, তৈরি ও উপস্থাপনা করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।

  • একটি সার্বিক বিশৃঙ্খলা চলছে
  • আজকের পরিস্থিতির জন্য সরকারের দায়িত্বহীনতা দায়ী।
  • করোনার দ্বিতীয় ঢেউ এল জানুয়ারিতে অথচ মার্চ মাস পর্যন্ত গোপন রাখা হল
  • ডাক্তার ও মেজিস্ট্রেটের ঘটনাটিতে উভয়পক্ষের বাড়াবাড়ি ছিল।।
  • বর্তমান আমলাতন্ত্রের দায়বোধ শাসকদলের প্রতি জনগণের প্রতি নয়।
  • ফলে এই আমলাতন্ত্র জনগণের উপর একধরনের বোঝায় পরিণত হয়েছে। সেবার পরিবর্তে নানাভাবে একটা হয়রানিমূলক পরিস্থিতি জনগণের সামনে এসে উপস্থিত হয়েছে।

রেডিও তেহরান: জনাব কমরেড খালেকুজ্জামান, করোনাভাইরাস মোকাবেলায় বংলাদেশ সরকার আবার লডকডাউন দিয়েছে এবং লকডাউন বাস্তবায়ন করতে গিয়ে নানা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে। সম্প্রতি রাজধানী ঢাকায় একজন নারী ডাক্তারের সঙ্গে পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রের বিতণ্ডা তার অন্যতম নজির। তো চলমান লকডাউন সম্পর্কে আপনি কি বলবেন?

সর্বাত্মক লকডাউন

কমরেড খালেকুজ্জামান: দেখুন, লকডাউন এবং কোয়ারেন্টিনের বিষয়টি নিয়ে বলব, যে ভাষায় এবং যে ভাবে ব্যবস্থা নিলে এগুলো যথাযথভাবে কার্যকর হবে, মানুষ সন্তুষ্টচিত্তে মেনে চলতে পারে সেভাবে সেটা এখানে হয় নি। যদি লকডাউনের কথা বলা হয় তারমানে মানুষ ঘরবন্দি থাকবে। ফলে যেসব মানুষ দিন আনে দিন খায় অথবা কর্মহীন মানুষ তাদের খাওয়ার ব্যবস্থাটা কি হবে? তাহলে এ বিষয়টি আগে ভাবার দরকার ছিল। ঢাকা শহরেই আছে প্রায় ৫০ লাখ মানুষ। এখানে ফেরিওয়ালা তিন লাখের বেশি, রিকশাচালক দশ লাখ,কাজের বুয়া আছেন ৫ লাখের বেশি, পরিবহন শ্রমিক সারা দেশে ৫০ থেকে ৬০ লাখের ওপর। উপকূলীয় অঞ্চলে লবণ শিল্পের সাথে সম্পৃক্ত প্রায় কয়েক লাখ মানুষ। এরবাইরে পল্ট্রি, ডেইরি, ছোটো ছোটো দোকান, ধোপা, নাপিত সব মিলিয়ে এসব মানুষের জীবন কীভাবে চলবে?

এছাড়া ৬ কোটি ৮ লাখ শ্রমিকের মধ্যে ৫ কোটি ১৭ লাখের ওপর অনানুষ্ঠানিক কাজের সাথে জড়িত। তাদের কাজের কোনো নিশ্চয়তা নেই। করোনায় প্রচুর মানুষ কর্ম হারিয়েছে, অনেকের আয় কমে গেছে। সবকিছু মিলিয়ে লকডাউনের আগে তাদের কথা ভাবা উচিত ছিল।

লকডাউনে দিন আনে দিন  খাওয়া মানুষের চিত্র

আরো একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরি, এরইমধ্যে আমাদের দেশে নতুন করে দরিদ্র হয়েছেন ২ কোটি ৪৫ লাখ মানুষ এবং শতকরা যে ৮ ভাগ মানুষ বেকার হয়েছিল তারা কিন্তু কাজ পায় নি এবং শহর থেকে যে  দশভাগ বস্তিবাসী গ্রামে গিয়েছিল তারা আর ফিরে আসে নি। আর যারা শহরে আছেন তাদেরও সে-ভাবে কর্মসংস্থান হয় নি। আমি মোটামুটি সংক্ষিপ্ত একটা চিত্র তুলে ধরলাম।

এর আগেও আমরা দেখেছি, করোনায় খাদ্য সহায়তার যে কথা বলা হয়েছিল সেটা মানুষের কাছে সেভাবে পৌঁছায় নি। দুর্নীতি হোক অথবা সঠিক পরিকল্পনার অভাবেই হোক সেই সহায়তা প্রকল্প যথাযথ বাস্তবায়ন হয় নি। বলা হয়েছিল ৫০ লাখ মানুষের খাদ্য সহায়তা দেয়া হবে। অথচ বিশ/ত্রিশ লাখ মানুষ বাদ পড়ে গেছে। আর যাদেরওকে দেয়া হয়েছে সেখানেও নানা অনিয়মের কথা উঠেছে। সবকিছু মিলিয়ে বলব একটি সার্বিক বিশৃঙ্খলা কাজ করছে।

এবার ২০২১ সালের জানুয়ারিতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ এল অথচ মার্চ মাস পর্যন্ত সে বিষয়টি গোপন রাখলাম। এক্ষেত্রে উচিত ছিল সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা। সেটা হয় নি। কারণ শাসন ক্ষমতায় যারা আছেন তাদের দৃষ্টি হয়ত ভিন্ন দিকে ছিল। অন্য কোনো কর্মসূচিকে তারা গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছিলেন। অথবা বিষয়টি নিয়ে আত্মতুষ্টিতে ভুগেছিলেন এই জন্য যে মৃত্যুর হার যেহেতু কমে গেছে। শাসকরা বলতে শুরু করলেন আমরা করোনা জয় করে ফেলেছি। অনেক উন্নত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র যা পারে নি আমরা তা করতে পেরেছি এই ধরনের আত্মতুষ্টিমূলক মনোভাব কাজ করেছিল। কিছু ছিল দায়িত্বহীনতা অন্যদিকে যথাসময়ে যথা কর্তব্য পালন করার বিষয়ে দুর্বলতা ছিল।

রেডিও তেহরান: জনাব খালেকুজ্জামান, আপনি সার্বিক বিশৃঙ্খলার কথা বলছিলেন। তো ডাক্তার- ও ম্যাজিস্ট্রেটের যে ঘটনার কথা বলছিলাম -দেখা গেছে সবাই প্রশাসনের লোক বলে নিজেকে দাবি করছেন এবং মুক্তিযোদ্ধার সন্তান বলে পরিচয় দিচ্ছেন। প্রশ্ন হচ্ছে- প্রশাসনের লোক কিংবা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান- এখানে এই পরিচয়গুলো মুখ্য করে তোলার কারণ কী?

লকডাউনে ঘটে যাওয়া ঘটনা-যা নিয়ে তোলপাড়

কমরেড খালেকুজ্জামান: দেখুন, এ বিষয়ে আমি বলব-লকডাউনে রাস্তায় গাড়ি চলছে, প্রাইভেট কার চলছে আবার পুলিশ আটকাচ্ছে, আইডি কার্ড চেক করছে। এসব ঘটনা যখন ঘটছে সেখানে ম্যাজিস্ট্রেট থাকছেন। তো এক্ষেত্রে একজন যখন পরিচয় দিচ্ছেন যে তিনি একজন ডাক্তার এবং তার গাড়িতে স্টিকার লাগানো আছে তখন তার বিষয়টিকে এভাবে বাড়াবাড়ি পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া উচিত হয় নি। এক্ষেত্রে আরও একটি বিষয় বলব করোনা পরিস্থিতিতে চিকিৎসকও অনেক মারা গেছেন দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আবার অনেক পুলিশও মারা গেছেন একইভাবে। ফলে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তাদের মধ্যে একটা অসহিষ্ণু মনোভাব বা একটা অস্বাভাবিক অবস্থা দেখা যাচ্ছে। এক্ষেত্রে তাদের মধ্যে সংযমের অভাব ঘটেছে কিংবা দায়িত্ব কর্তব্যবোধের যে সীমারেখা মেনে চলার দরকার ছিল তা লঙ্ঘিত হয়েছে। ফলে বিষয়টি নিয়ে এতটা উত্তেজিত হওয়া এবং বাক বিতণ্ডায় লিপ্ত হওয়া উচিত ছিল না। ঐ ঘটনার ফলে আমরা এখানে একটি সার্বিক অরাজকতা লক্ষ্য করছি।

রেডিও তেহরান: অনেকে বলছেন,শাসন করার ক্ষমতা আছে- এমন মানসকিতা কাজ করে আমাদের প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা কর্মচারীদের মাঝে। আমরা জানতে চাই- কেন তারা সবাই নিজেদেরকে দেশ ও জনগণের সেবক ভাবতে পারেন না?

বাংলাদেশের পুলিশ

কমরেড খালেকুজ্জামান: সাধারণভাবে বিট্রিশ আমলে যে উদ্দেশ্যে এবং যেভাবে আমলাতন্ত্র তৈরি হয়েছিল সেভাবেই আছে বলা চলে খুব একটা পরিবর্তন হয় নি। আমরা অনেক সময় বলি সরকারি কর্মচারী। আসলে তাঁরা গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রের কর্মচারী। কিন্তু এখানকার প্রশাসনিক যে নিয়ম-বিধি এবং সার্বিক যে আয়োজন তার সবকিছুই কিন্তু গণতান্ত্রিক নয়। রাষ্ট্রের কর্মচারী হিসেবে তারা জনগণের সেবক-পাবলিক সার্ভেন্ট। জণগনের টাকায় তাদের বেতন হয়। ফলে তাদের দায়বোধ থাকবে জনগণের প্রতি। কিন্তু বর্তমানে তাদের দায়বোধ চলে গেছে শাসকদলের প্রতি। এরফলে আমলাতন্ত্র জনগণের উপর একধরনের বোঝায় পরিণত হয়। সেবার পরিবর্তে নানাভাবে একটা হয়রানিমূলক পরিস্থিতি জনগণের সামনে এসে উপস্থিত হয়। একইভাবে পুলিশের বিষয়টি দেখব। ১৮৬১ সালে পুলিশের যে বৃটিশ বিধান তৈরি হয় সেই বিধান এখনও চলছে।

রেডিও তেহরান: জ্বি, পুলিশ নিয়ে ব্রিটিশ বিধান এখনও চলছে বলে আপনি আলোচনায় উল্লেখ করলেন, তো এ প্রসঙ্গেই জানতে চাইব, অনেকে অভিযোগ করেন- ব্রিটিশ ও পাকিস্তানিদের রেখে যাওয়া প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে যুগোপযোগী করা হয় নি। আসলে বাস্তবতা কী এবং এ ক্ষেত্রে করণীয় কী?

কমরেড খালেকুজ্জামান: দেখুন, শাসন ব্যবস্থা যদি গণতান্ত্রিক না হয় তাহলে তার অধীন প্রতিষ্ঠানগুলোও গণতান্ত্রিক হয় না। আবার প্রতিষ্ঠানগুলো যদি গণতান্ত্রিক না হয় তখন শাসন ব্যবস্থাও গণতান্ত্রিক হয় না। এরকমটি একটি অবস্থা বিরাজ করছে। আমাদের বিচার ব্যবস্থা পুরো স্বাধীনতা এখনও পায় নি। আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে গণতন্ত্রের আদলে দাঁড় করানো যায় নি। তাছাড়া আইন-কানুন বিধি বিধান বেশিরভাগই অনেক কাল আগের। একের পর এক কালা কানুন হচ্ছে। আমাদের এখানে কর্তৃত্ববাদী শাসন চলছে। আর যখন এরকম শাসন চলে তখন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও গণতান্ত্রিক বিধি বিধান মেনে কাজ করতে পারে না; সেগুলো সেভাবে তৈরিও হয় না। যেমন ধরুন আমাদের দেশে নির্বাচন কমিশন!এই প্রতিষ্ঠানটি এখন একটি তামাশার বস্তুতে পরিণত হয়েছে। কারণ এখন দিনের ভোট রাতে হয়ে যায়। ফলে আমাদের নির্বাচন কমিশনের কথাই বলি বা আমাদের বিচার ব্যবস্থার কথা বল,-অপশাসন আমলাতন্ত্রের কথা বলি বা পুলিশের কথা বলি, অর্থ ব্যবস্থার কথা বলি সব জায়গায় একটা অরাজক অবস্থা বিরাজ করছে। অর্থাৎ অগণতান্ত্রিক নিয়ম নীতি চলছে। কর্তৃত্ববাদী শাসনের অধীনস্ততা মেনে নেয়া চলছে। সাধারণভাবে একটা গণতান্ত্রিক শাসন বা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল যে চেতনা ছিল তার বিপরীত পথে হাঁটছি।

রেডিও তেহরান: আচ্ছা, রাজধানীর ওই বিতণ্ডায় দেখা গেছে কে বড় সেটা প্রমাণের একটা চেষ্টা ছিল। তো কমরেড খালেকুজ্জামান  সেই সূত্র ধরে জানতে চাই- আপনার কী মনে হয় আমাদের প্রশাসনিক কাঠামোতে ত্রুটি অথবা সমন্বয়হীনতা আছে?

কমরেড খালেকুজ্জামান: সমন্বয়হীনতা তো রয়েছে। যেমন ধরুন আজকের করোনা পরিস্থিতি আমাদের জন্য একটি জাতীয় দুর্যোগ। আর একে মোকাবেলার জন্য আমাদের জাতীয়ভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করার দরকার ছিল। সেটি হয় নি। ফলে এটি একটি বড় ধরনের ব্যর্থতা। তারসঙ্গে সরকারের যেসব আয়োজন আছে, নানা ধরনের কমিটি, উপ-কমিটি এসবের মধ্যেও কোনো সমন্বয় নেই।

একজন একধরনের বিবৃতি দিচ্ছেন আরেকজন ঠিক তার উল্টো আরেকধরনের বক্তব্য দিচ্ছেন। ফলে সমন্বয়হীনতা তো আছেই। যখন জবাবদিহিতা থাকে না, যখন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সত্যিকারভাবে অনুপস্থিত থাকে, জনগণের কাছে দায়বদ্ধতা থাকে না তখন শাসন ক্ষমতার মধ্যে কর্তৃত্ববাদী প্রবণতা বাড়তে থাকে। আর এটি যত বেশি বাড়তে থাকে ততই কিন্তু অপরাপর প্রতিষ্ঠানগুলো শাসক দলেকে সন্তুষ্ট করা বা শাসকগোষ্ঠীকে এবং ক্ষমতাবানদের সেবা করার দিকেই মনোযোগটা চলে যায় এবং জনসেবার দিকটি উপেক্ষিত হয়। মানুষ তখন নানাভাবে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। আর এমন পরিস্থিতিতে সমন্বয়হীনতা, অব্যবস্থা, দুর্নীতি, অকার্যকারিতা বাড়তেই থাকে। আর এটিই আমরা লক্ষ্য করছি। এজন্য সরকার বা শাসকদের জবাবদিহি করতে হবে।  

রেডিও তেহরান: তো জনাব কমরেড খালেকুজ্জামান- করোনা নিয়ন্ত্রণে চলমান লকডাউন এবং সে সময় ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা তার সাথে এ সম্পর্কিত অন্যান্য বিষয় নিয়ে রেডিও তেহরানের কথা বলার জন্য আপনাকে আবারও অনেক অনেক ধন্যবাদ।

কমরেড খালেকুজ্জামান: আপনাকেও ধন্যবাদ। #

পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/২৮

  • বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

 

 

ট্যাগ